X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ শতকের ইতালির গল্প

চাঁদের আরেকটা দিক ।। আলবের্তো মোরাভিয়া

অনুবাদ : ওয়াহিদ কায়সার
০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৯আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৯

আমি একজনের ভেতরে থাকা দুইজন মানুষ কিংবা, যদি তুমি কথাটা পছন্দ করো, একজন দ্বিমুখী মানুষ, যার দুটো দিক আছে, চাঁদের মতো। আর চাঁদের মতো, আমার একটা দিক আছে যা সবাই জানে, সবসময় একই, আর একটা দিক কেবল অন্যদের কাছে নয়, এক অর্থে, আমার নিজের কাছেও অজানা। এই দ্বিতীয় সম্পূর্ণ অজানা দিকটা হয়তো বা নাও থাকতে পারে : এটার ব্যাপারে তুমি চিন্তা করে দেখো, আমরা যে জিনিসগুলোকে উপেক্ষা করি সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে তারপরও সেগুলো থাকে। এমনকি যদি আমি এটা জানি না বা এটা জানার অনুমতি নেই, চাঁদের অন্য দিকটা এমন কিছু যা আমি ‘অনুভব’ করি। আর এই অস্পষ্ট অনুভূতির যে আরেকটা দিক বিদ্যমান, অদৃশ্য এবং ভিন্ন, আমার বাহ্যিক চেহারার পেছনে, আমার মাথার পেছনের দিকে, আর আমার পেছনের জগৎটার দিকে তাকাচ্ছে, এর অর্থ হলো যে আমি দৈনন্দিন জীবনে সবসময় বিচক্ষণভাবে, দায়িত্বশীল আর, একই সময়ে—কীভাবে আমি এটা প্রকাশ করতে পারি?—‘আলগা’। হ্যাঁ, আলগা। অর্থাৎ, আমি যা করছি সে মুহূর্তে আমি যে কাজগুলো করছি তা থেকে বিচ্ছিন্ন। তুমি কি কখনো এমন একটা পুরনো টেবিল দেখেছ যেখান থেকে একটা অংশ হঠাৎ করে আলগা হয়ে পড়ে? একটা টুকরো তখন পর্যন্ত যেটাকে পুরোটাই মনে হচ্ছিল? যখন তুমি এটার দিকে তাকাও তুমি দেখো যে পুরনো শুকনো কাঠের উপরিভাগে পুরনো আঠার এক ধরনের নিস্তেজ আভা আছে। কত শতাব্দী আগে টেবিলটা নষ্ট হয়েছিল কে জানে। কেউ, যে একইভাবে শতাব্দী ধরে মৃত, এটায় আবার আঠা লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো একদিন, আঠা আর ধরে থাকে না আর ভাঙা টুকরোটা আলগা হয়ে আসে। এখন এটায় আবার নতুন করে আঠা লাগানোর প্রয়োজন পড়ে, আগের তুলনায় ভালো, কিন্তু কী ধরনের কে জানে? প্রতিদিনকার জীবনে, আমি সেই টুকরো যেটা মনে হয় ঠিকভাবে জোড়া দেওয়া আছে কিন্তু, বাস্তবে, বিচ্ছিন্ন।

বিচ্ছিন্ন আর পরিশ্রমী, সন্ধ্যা আটটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত আমি বয়স্ক এক বিচারকের নিখুঁত সুন্দরী যুবতী স্ত্রী; সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বিচারকের প্রথম পক্ষের দুই সন্তানের নিখুঁত সৎ-মা; আর আট-ত্রিশ থেকে এক-ত্রিশ পর্যন্ত নিখুঁত ব্যাংকের নিখুঁত কর্মচারী। কেন আমি এই সময়সূচি তৈরি করে রাখি? কারণ আমি আমার ঘড়িতে যে সময় দেখি সেটা ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো সময় নেই; অন্য সব সময় আমার হাতের মুঠোয় নেই। প্রতিদিন আমি সকাল ছয়টায় উঠি, গোসল সেরে পোশাক পরি, বাচ্চাদের জাগিয়ে দিই, তাদের গোসল করতে এবং পোশাক পরতে সাহায্য করি আর তারপর সবার জন্য নাশতা বানাই। এ্ররপরে আমার স্বামী নিজের গাড়িতে চলে যায়। প্রথমে সে বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দেবে, নানদের সাথে, যেখানে তারা দিনের ছাত্রী। তারপর সে গাড়ি নিয়ে আদালতে যায়। আমি হেঁটে ব্যাংকে যাই, বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় সেটা। ব্যাংকে, আমি এত সিরিয়াস আর পরিশ্রমী যে আমার সহকর্মীরা মজা করে আমাকে মিস দায়িত্বশীল বলে ডাকে, আমি একটা তিরিশ নাগাদ নিজেকে ব্যস্ত রাখি। তারপর হেঁটে বাড়ি ফিরে যাই। খণ্ডকালীন কাজের মেয়েটা ইতোমধ্যে একটা তালিকা থেকে কেনাকাটা করে ফেলেছে যেটা আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে প্রস্তুত করি। আমি রান্নাঘরে যাই, ব্যাগ আর বাক্সগুলো খুলি, বার্নার চালু করি আর আমার স্বামী আর আমার জন্য দুপুরের হালকা খাবার তৈরি করি। আমার স্বামী চলে আসে। আমরা টেবিলে বসি। খাওয়া শেষ করে থালাবাসন ধুয়ে সবকিছু তাদের নিজেদের জায়গায় রেখে দিই। তারপর আমরা বেডরুমে চলে যাই। এটা ভালোবাসার সময়, আর আমার স্বামী এ সময়ে এটা পছন্দ করে কারণ রাতে সে খুব ক্লান্ত থাকে। চারটার দিকে সে চলে যায় আর কয়েক মিনিট পরে বাচ্চারা চলে আসে। কোনো বিরতি না নিয়ে আমি তাদের জন্য স্ন্যাকস বানাই, তাদের সাথে টিভি দেখি, তাদের হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করি, তাদের রাতের খাবার রান্না করি, তাদের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিই। এতক্ষণে আটটা বেজে গেছে আর আমার স্বামী বাড়িতে চলে এসেছে। সে খবরের কাগজ পড়তে বসে গেছে। আমি বেডরুমে ছুটে যাই, একটা ফ্যান্সি পোশাক পরে মেক-আপ করি, নিজের চুল ঠিক করি আর তারপরে আমরা কোনো এক রেস্তোরাঁ অথবা বন্ধুর বাড়িতে ডিনার করি আর তারপরে সিনেমা দেখতে যাই। এই মুহূর্তটায় আমি ভেঙে পড়ি কারণ বছরের পর বছর ধরে আমি দিনে প্রায় দুই ঘণ্টার ঘুম হারাচ্ছি। তাই আমি যেখানেই থাকি না কেন আমি ঘুমিয়ে পড়ি : ডিনার টেবিলে, কোনো রেস্তোরাঁয়, সিনেমা হলে আমার সিটে, আমার স্বামীর পাশে যখন সে গাড়ি চালাচ্ছে। আমার স্বামীকে কি আমি ভালোবাসি? এটা বলা যায় যে তাকে আমি পছন্দ করি। তাছাড়া, এই ধরনের চিন্তা করার জন্যও আমার হাতে সময় নেই।

আর তবুও, মিস দায়িত্বশীল হিসেবে এই জীবন থাকা সত্ত্বেও, আমি যে জিনিসগুলো করি সেগুলোতে লেগে থাকি না। আমার সবসময় মনে হয়, যেমনটা আমি বলেছি, আমি আলগা হয়ে পড়েছি। যাই হোক, আমি বলেছিলাম যে আমার চাঁদের অন্য দিকটা কেবল অন্যদেরই নয়, আমার নিজের কাছেও অজানা। এটা ঠিক সত্য নয় : যদি তুমি এটা পড়তে জানো তবে এই অজানা দিকটা আমার মুখের বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে অনুমান করা যাবে। আমি নিজের বর্ণনা দিচ্ছি, বিচারক তুমিই হয়ো। আমি স্বর্ণকেশী, লম্বা আর পাতলা, মুখ খানিকটা জার্মানদের মতো, পুরনো গথিক চার্চের কুলুঙ্গি থেকে দেখতে পাওয়া লোকের মতো। আমার ত্রিভুজাকার একটা চেহারা আছে, যার প্রশস্ত অংশটা আমার কপাল, শক্ত আর রোগাটে, এবং বিন্দুযুক্ত অংশ, আমার চিবুক, মাংসল আর নরম। আমার নাকটা দেখতে ঈগলের মুখের মতো এবং ঠোঁট পাতলা, দুটোতেই চমৎকার নকশা। কিন্তু আমার বিচ্ছিরি চোখ, একটা নিস্তেজ নীল, আমার মুখের তীব্র আভিজাত্যের বিরুদ্ধে এমনভাবে বিষণ্ন দেখায় যেটা দেখতে ভয়ংকর। আমার চোখের ক্ষণস্থায়ী, ক্ষিপ্ত, ঠাণ্ডা একটা অভিব্যক্তি আছে, যেন সেটা কোনো অপেক্ষায় শুয়ে আছে, একটা প্রাণীর দৃষ্টির মতো যা প্রথম সুযোগেই কামড় দেবে।

সেই সুযোগটা আসে অবশেষে, আমার বিয়ের চতুর্থ বছরে। নভেম্বর মাসের এক সকালে, ধূসর বৃষ্টির নিচে কাজ করার পথে, আমি কালো একটা গাড়ির চাকার স্টিয়ারিং উইলে একজন লোককে দেখলাম, আমার ব্যাংকের সামনে পার্ক করা, ছবি তুলছে। আমি ইতোমধ্যে তাকে দূর থেকে দেখেছি : সে নিজের চোখের কাছে ছোট একটা ক্যামেরা ধরবে আর ছবি তুলবে—তিন, চার, পাঁচটা—শান্ত আর কুশলী একটা ক্রোধের সাথে। এর পরে সে নিজের হাত লুকিয়ে কয়েক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু হঠাৎ করেই সে আবার ছবি তোলা শুরু করবে। কী ছবি সে তুলছিল? এটা স্পষ্ট ছিল : ব্যাংকের প্রবেশদ্বার। আমি একটু কাছে এসে তাকে ভালো করে দেখতে পেলাম। পেছন থেকে দেখলে মনে হয় সে একজন খাটো আকৃতির মানুষ। তার প্রশস্ত একটা কপাল, একটা হুক নাক আর টানা মুখ ছিল। আমাকে সে তরুণ নেপোলিয়নের ছবি আঁকা কিছু প্রিন্টের কথা মনে করিয়ে দিল। তারপর আমি তাকে অতিক্রম করে গেলাম। নিজের হাত নামিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, যেন আমার অদৃশ্য হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর, অব্যক্তভাবে, আমি জানি না কোন জিনিসটার প্ররোচনায় তার দিকে তাকাতে আমাকে বাধ্য করেছিল। সে চোখের পলক দেখতে পেয়ে নিজের মাথা নাড়ল, আমাকে দেখানোর জন্য যে সে লক্ষ করেছে। উজ্জ্বল লাল ট্রেঞ্চ কোট পরা অবস্থায় দৃঢ় একটা পদক্ষেপ নিয়ে আমি এভিনিউটা পার হলাম। ব্যাংকে ঢুকে কর্মচারীদের দলে যোগ দিলাম। ঘুরে ফিরতেই দেখলাম গাড়িটা চলে গেছে।

পনেরো দিন কেটে গেল। বাসায় যাওয়ার জন্য একদিন সকালে ব্যাংক থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, রোববারে রাস্তায় যে স্বস্তি ও আনন্দের ঢেউ বয়ে গেছে, তার কোনো কিছুই আমি অনুভব করতে পারিনি, অফিস ও স্কুল যখন ছুটি থাকে আর সেসব লোকেদের মধ্যে যারা কাজ অথবা পড়ার জন্য আটকে ছিল, মুক্তি পেয়েছিল, হেঁটে যাচ্ছিল, আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিল। আমি কোনো ধরনের স্বস্তি বা আনন্দ অনুভব করতে পারছিলাম না : ইতোমধ্যে দুপুরের খাবারের কথা ভেবে মনে করলাম আমি রান্না করব, থালাবাসন ধুয়ে ফেলব, আর ভালোবাসা, যেটায় আমার অংশ নিতে হবে। তারপর, হঠাৎ, আমি সামনের দিকে তাকালাম আর দেখলাম, আমার ঠিক পাশে, সে ফটোগ্রাফার, যে নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং উইলে, আমার প্রতিটা ধাপে আমাকে অনুসরণ করছে। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকালাম। আর তারপর সে আরেকবার বলা যাবে না এমন অশ্লীল ছোট একটা কথা বলে একটা প্রস্তাব দিল। আমি দ্বিধা করিনি। আমি মাথা নাড়লাম। গাড়ি থামাল সে, দরজা খুলল, আর আমি গাড়ির ভেতর গিয়ে বসলাম।

কিছুদূর সামনে লুঙ্গোটেভারের একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে গাড়ি পার্ক করলাম, আর সাথে সাথে সে আমাকে চুমু দেওয়ার চেষ্টা করল, যেন আগেই করে রাখা একটা পরিকল্পনা সে অনুসরণ করছে মাত্র। যখন সে নড়ছিল না, যেমনটা আমি আগেই বলেছিলাম, তখন তাকে দেখতে একজন তরুণ নেপোলিয়নের মতো লাগছিল। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি তার মুখ কোনো অভিব্যক্তিতে আলোকিত হয়, সেটা সাথে সাথে ছোট একটা শহরের গ্যাংস্টারের অশ্লীলতা প্রকাশ করে, কোনো মাধুর্য ছাড়া নয় যদিও। আমি তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বললাম, ‘আমার ওপর জোর খাটানো বন্ধ করো, এর জন্য সময় আছে। এখন বলো তুমি আমার কাছ থেকে কী চাও।’

নিরুৎসাহিত হয়ে সে উত্তর দিল, ‘আমি তোমাকে চাই।’

‘না, তুমি আমাকে চাও না। যদি তুমি শুধু আমাকেই চেয়ে থাকো, তার মানে তুমি একজন ফেটিশিস্ট।’

‘একজন ফেটিশিস্ট। এর মানেটা কী?’

‘এমন কেউ তোমার মতো, কেবল কোনো মানুষকে না, তার চারপাশের জিনিসগুলোকেও ভালোবাসে। যেমন, আমি যেখানে কাজ করি সেই ব্যাংকের দরজা।’

‘কী কথা বলছ?’

‘তোমাকে তাহলে বলছি। দুই সপ্তাহ আগে সকাল সাড়ে আটটায়। কতগুলো ছবি তুলেছ? আমি বলব অন্তত বিশটা।’

‘তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই লুকাতে পারব না। কে তুমি? শয়তান?’

এভাবেই আমাদের গল্প শুরু হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত, সেটা দুঃসাহসিক শিরোনামে সংবাদপত্রগুলো ভরে ফেলেছিল। কীভাবে ডাকাতিটা হয়েছে তা বলার আর কোনো মানে নেই। সাংবাদিকদের মতে, এটা এই ধরনের অপরাধের মধ্যে একটা ‘ক্লাসিক’ ছিল। তুমি যদি জানতে চাও যে এটা কীভাবে হয়েছে, সে বছরের সংবাদপত্রের অপরাধ সংক্রান্ত পাতাগুলো পরীক্ষা করতে পারো। আমি যে বিশিষ্ট অংশে অভিনয় করেছি সেটাও আমি তোমাকে বলতে চাই না। এটা আমার জন্য বিপজ্জনক হবে, যেহেতু কাগজপত্রে এটার আর কোনো উল্লেখ নেই। ব্যাংকে আমার সহকর্মীদের জন্য, আমি এখনও সেই পুরনো মিস দায়িত্বশীল। আমি কেবল একটা জিনিস যোগ করতে চাই যে ডাকাতিটা হয়েছিল বিকেলের প্রথম দিকে, যখন সেখানে মাত্র কয়েকজন কর্মচারী ছিল আর ব্যাংকটা গ্রাহকদের জন্য বন্ধ ছিল। প্রায় চারটা বাজে আর আমি আমার স্বামীর সাথে স্বাভাবিক ভালোবাসার অংশ শেষ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি আছে স্কুল থেকে বাসায় ফেরত যাবার আগে। আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, চুরি যাওয়া ক্লাসিক গাড়ির স্টিয়ারিং উইলে, নির্জন রাস্তায়, আমার গ্যাংস্টার আর তার বন্ধু ডাকাতির ঠিক পরে পৌঁছানোর জন্য। আচ্ছা, তুমি কি জানবে না? আমার ধড়ফড়ানি সত্ত্বেও, স্বাভাবিক ক্লান্তিতে স্টিয়ারিং উইলে হাত রেখেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আশ্চর্যজনক, অজেয়, আশীর্বাদপূর্ণ একটা ঘুমে। ঘুমের মধ্যে নিজের মতো করে ডাকাতিতে অংশ নিলাম। আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে আমি ব্যাংকের ভল্টে তালাবদ্ধ ছিলাম আর তারপরে, হঠাৎ করে, আমার গ্যাংস্টার দরজাটা খুলল আর আমি আনন্দের কান্নার সাথে তার হাতে গিয়ে জড়ালাম। কিন্তু সেই একই মুহূর্তে, ভয়লা, আমাকে সে জাগিয়ে তুলছিল, আমাকে হাত দিয়ে নাড়াচ্ছিল, তার মনের মধ্যে অভিশাপ দিচ্ছিল। তখনই, রোবটের মতো, আশপাশে না তাকিয়ে, আমি গাড়ি স্টার্ট করে রওনা দিয়ে দিলাম।

ডাকাতির পর ছয় মাস আমরা আর একে অপরকে দেখিনি। এটা সে করতেও চায়নি। সে বলল, পুলিশ অবশ্যই ব্যাংকের প্রতিটি কর্মচারীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে। যাই হোক, আমরা ঠিক করেছিলাম যে এই ছয় মাস পরে, আমি তার সাথে যাব এবং থাকব, নিজেকে মিস দায়িত্বশীল থেকে মেশিনগান মামাতে পরিণত করব, বা সন্দেহ ছাড়াই একই রকম একজন মনিকার যা, আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা আমাকে দেবে, একটা চাপা হাসির সাথে, ব্যাপারটা বুঝে ফেলার সাথে সাথে।

তাই আমি আমার স্বাভাবিক জীবন আবার শুরু করলাম, বাড়ি এবং ব্যাংকের মধ্যে যাওয়া-আসার ভেতর। এমনই এক দিনে, আমি বুঝতে পারি আমার কোলন শেষ হয়ে গেছে। সেই একই বিকেলে আমি আমার স্বামীর সাথে বিমানবন্দরে যাই। একটা ব্যবসায়িক সফরে ক্যাগলিয়ারিতে যাচ্ছিল সে। ফেরার পথে আমার কোলনের কথা মনে পড়ল এবং তাই আমি শহরতলির রাস্তায় গাড়ি থামালাম, প্যারিসিয়ান পারফিউম হাউসের নামানুসারে একটা প্রসাধনী দোকানের সামনে যা আমার কোলন তৈরি করেছিল। প্রবেশ করার মুহূর্তে, প্রতিটি দেয়ালের বিপরীতে কাচের ক্যাবিনেটে সারিবদ্ধ উও ডু টয়লেট এবং লোশনের অনেকগুলো ডিক্যান্টার, ফিয়াল এবং টিয়ারড্রপ আকৃতির বোতলগুলোর ঝলক দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তাই এক মুহূর্তের জন্যও আমি আমার গ্যাংস্টারকে খেয়াল করিনি। কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী একজন গ্রাহককে সাহায্য করছিল সে যে কয়েকটা বিরল শেইডের লিপস্টিক চাচ্ছিল। আমার গ্যাংস্টারের নিজের আর গ্রাহকের মধ্যে থাকা কাউন্টারে বিভিন্ন ছোট টিউব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিল। আর যখন সে ধীরে ধীরে একটা আর তারপরে অন্যটাকে খুলে ফেলল আর তার হাতের পেছনে ছোট একটা দাগ ঘষল, তখন সে নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে চিহ্নটি বড় করল আর তারপর গ্রাহককে দেখাল, তার সাথে দীর্ঘক্ষণ, হালকা কথাবার্তা বলে যাচ্ছিল, ধৈর্য সহকারে। কিন্তু গ্রাহক সবগুলো পরীক্ষা করবে আর তারপরে তার মাথা নাড়বে : এটা এখনও সে শেইড না যেটা সে খুঁজছিল।

আমার গ্যাংস্টার আমাকে বলেনি যে সে এই দারুণ দোকানের মালিক। আমি তার সম্পর্কে এটাই জানতাম যে সে তার বৃদ্ধ মা আর দুই সন্তানের সাথে থাকত আর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে মিলানে বসবাস করছে। কিন্তু তারপর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কিছু সময়ের জন্য সে কসমেটিকসের বিক্রয়কর্মী ছিল, হতে পারে কয়েক বছর ধরে, কারণ গ্রাহকের সাথে তার কথোপকথন দেখে মনে হচ্ছিল সে পেশাদার একজন; এর থেকে ভালো আর তুমি বলতে পারবে না। আমার কাছে তার কথাবার্তার নির্ভুলতা ছিল রাতে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো, ল্যান্ডস্কেপের একটা ক্ষুদ্রতম বিবরণকে আলোকিত করে, এমনকি যদি সেটা ক্ষণিকের জন্যও হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, অন্যভাবে বললে, আমি ভুল করেছি। আমি তাকে শিকারি বাজ বলে ভুল করেছিলাম। এটার পরিবর্তে সে একটা ধূর্ত ছুঁচো ছিল। তাই সচেতনতার সেই ঝলকানিতে, আমি দ্রুত হিসাব করেছিলাম আর বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার স্বামীর চেয়ে সে খুব বেশি ভালো হবে না। তারও দুটো সন্তান ছিল যাদের যত্ন আমাকে নিতে হবে। সেও আশা করবে যেন আমি ঘরের দাস হয়ে থাকি। কাজের ক্ষেত্রে, কসমেটিকসের বিক্রয়কারীর চেয়ে ব্যাংকের কর্মচারী হওয়া ভালো, যদি সেটা ছাড়া অন্য কোনো কারণে আমাকে কেবল সকালে ব্যাংকে কাজ করতে না হয়। প্রেম ছিল, এটা সত্য। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পেরেছি, দোকানটা আবিষ্কার করার পর, আমি আমার স্বামীর চারপাশে যেভাবে ছিলাম, ঠিক তেমনি তার চারপাশেও আমি আলগা হয়ে পড়েছি। আমি তাই গ্রাহকের সঠিক লিপস্টিকটা খুঁজে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করিনি। মুখটা ঘুরিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম। তবে দরজার কাছে এসে আমি ফিরে তাকালাম। এখন সে তার গ্রাহকের কাঁধের ওপর থেকে মাথা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আর আমি আমার মাথা নাড়লাম। সে বোকা ছিল না, আর সে অবশ্যই বুঝতে পেরেছিল, কারণ এরপরে সে আর কখনো আমাকে খুঁজতে আসেনি। হয়তো, কে জানে, আমাকে কসমেটিকসের বিক্রয়কারী হিসেবে সে বিশ্বাস করেনি। মোটের ওপর, একটা দোকান আর একটা ব্যাংকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সে নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিল যে আমি, ক্ষমার অযোগ্য, ডাকাতিটার পুনরাবৃত্তি করব, কিন্তু এবার তারই বিরুদ্ধে, আর সম্ভবত একজন সত্যিকারের গ্যাংস্টারের সাথে মিলে, যে একটা ব্যাংকে পড়ে থাকে সত্যিকারের একটা অপরাধ করার জন্য যেন কসমেটিকসের একটা দোকান কেনার দরকার না পড়ে।


আলবের্তো মোরাভিয়া (১৯০৭-১৯৯০)

একজন বিশুদ্ধ রোমান লেখক, আলবের্তো মোরাভিয়া, অন্য যেকোনো লেখকের চেয়ে শহরের মানুষ আর আত্মার কথা লিখেছেন সবচেয়ে বেশি। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। মোরাভিয়া বিংশ শতাব্দীর একজন নেতৃস্থানীয় ইতালীয় ঔপন্যাসিক যার উপন্যাসে আধুনিক যৌনতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর অস্তিত্ববাদের বিষয়গুলো অন্বেষণ করা হয়েছে।

তার লেখা গল্পের বিখ্যাত সংকলন হচ্ছে রোমান কাহিনি, যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। এখানে সব গল্প নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। একসাথে সবগুলো গল্প চিরাচরিত ভূমিকা আর নতুন নারীবাদী চেতনার মাঝে পড়ে যাওয়া রোমান নারীদের একটা সামগ্রিক চিত্র দেখায়। তার লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত বইগুলো হচ্ছে উদাসীনতার সময় (১৯২৯), অবজ্ঞা (১৯৫৪), দুই নারী (১৯৫৭)। একই সঙ্গে মোরাভিয়া মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত চরিত্র, যেমন দোকানদার, ব্যাংকের কর্মচারী, নিয়ে লিখেছেন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন লেখিকা এলসা মোরান্তের স্বামী, এরপর অনেক বছর আরেক বিখ্যাত লেখিকা দাসিয়া মারাইনির সঙ্গী। মোরাভিয়ার জন্ম ১৯০৭ সালে, আর মারা যান ১৯৯০ সালে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সৈকতে জনসমুদ্র!
চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল
জঞ্জালের নগরে প্রাণ ভরানো সবুজের খোঁজে...
সর্বশেষ খবর
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে