X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ শতকের ইতালির গল্প

টুপিওয়ালি ।। আন্তোনিও দেলফিনি

অনুবাদ : আলম খোরশেদ
০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:০৬আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:০৬

সিনোরা এলভিরার বয়স ষাট পেরিয়েছে। একটি নরম, ফুলের নকশা করা, আরামদায়ক হাতলবিশিষ্ট চেয়ারে বসে তিনি মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দেন। তাঁকে এমন একটা জায়গায় হারিয়ে গেছেন মনে হয়, যেখানে যাওয়াটা সহজ কিন্তু ফেরা কষ্টকর। তাঁর যৌবনের দিনগুলোতে, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, তিনি কত রাত সেই চেয়ারটিতে বসে থেকেছেন? বড়সড়, লেসওয়ালা একটা সাদা চাদর বিছানো চওড়া বিছানাটার দিকে তাকান তিনি। চাদরটা একটু অগোছাল। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। যদি আর্তুরো প্রতিরাতে বাড়ি ফিরে আসত। তার কাজটাও অত জরুরি ছিল না। প্রধান সড়কে অবস্থিত টুপি বানানোর দোকানের ব্যবসা কমিয়ে ফেলা যেত সহজেই। বাঁচার জন্য যেটুকু দরকার সেটাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর্তুরো ভালো আয় করত এবং তার জন্য তাকে কিছু সরিয়েও রাখতে হতো না। কেবল যদি বাসাটা আরেকটু পরিষ্কার রাখা যেত, প্রতিবছর আরও বেশি লেসওয়ালা একটা নতুন চাদর কিনতে পারা যেত, প্রত্যেক সন্ধ্যায় সুগন্ধে ভরা উঁচুমানের কফি বানানোর সাধ্য থাকত (উৎসবের সময় সারা রাত খোলা থাকা বিশাল ব্রাসিল বারের মতো), তাহলেই জীবন সবচেয়ে সুখের হতে পারত।

আর্তুরো নিঃসন্দেহে সুদর্শন, শক্তপোক্ত ও ক্লান্তিহীন এক পুরুষ ছিল। পোশাক নির্মাতা গোল্ডেনা মেয়েটি তাকে কী হিংসাই না করত! আর্তুরোকে পাওয়ার জন্য সে তার অফিসার স্বামীকে ছেড়ে আসতেও দুবার ভাবত না। পোশাক নির্মাতা গোল্ডেনা, যদিও সে সুন্দরী ছিল, আর্তুরোকে পাওয়ার বিষয়ে কখনো সফল হয়নি। সে, এলভিরা, একটি এতিম মেয়ে, একজন স্বনির্মিত নারী, তাকে কবজা করেছিল এবং কখনোই তাকে হাতছাড়া করতে চাইত না। তার মতো অমন সাইকেল চালাত আর কে? কে তার মতো অমন সিগারেট টানত আর দুই টানের মাঝখানে অমন গমগমে গলায় আমুদে স্তুতিবাক্য ছুড়ে দিতে পারত? আর্তুরোর সেই উচ্চকণ্ঠ, ভরাট গলা এলভিরার মনটাকে ঘোলাটে করে দিত আর সে তার কথা ভাবতে গিয়ে টুপির নকশা পণ্ড করত। তার চওড়া বুকের জামাটি (তারই সেলাই করা) সুন্দরভাবে লেপটে থাকার দৃশ্যখানি কী সুখকরই না ছিল!

‘সিনোরা যদি জানতে...’ তার দোকানের একজন কর্মী একদিন তাকে বলে।

‘কী জানতাম?’ এলভিরা বিরক্তভাবে বলে।

‘কিছু না,’ সে বলে, কিছু একটা বলার জন্যই।

‘তবু বলো, তুমি নিশ্চয়ই কাল রাতে তার সাথে কোথাও দেখা করেছ?’

দোকানি মেয়েটা হাসিতে ফেটে পড়ে কী একটা গুনগুন করতে করতে পেছনের ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল। এলভিরা তার হাতের দিকে তাকায়, যেগুলো সে প্রায় নষ্ট করে ফেলেছে এর আগের দিন একগাদা চাদর ও তোয়ালে ধুয়ে। তাকে চিন্তিত দেখায়। সে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছে, আর্তুরো কিছুদিনের মধ্যে তার এখনকার সামান্য চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারে, কেননা তাকে একজন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মানুষ বলেই গণ্য করা হয়ে থাকে। হে ভগবান, তাহলে সে কীভাবে থাকবে? সেও তো তাহলে বিখ্যাত হতে পারে, পারে মিলান শহরে দারুণ একটা ফ্যাশনঘর খুলতে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই : তাকে আর্তুরোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে। পেছনে পড়ে থাকলে চলবে না। সে রাতে মার্চেসা ই কী অবাকই না হয়েছিলেন তাঁর পালকঅলা হ্যাটখানি দেখে, যেটি তিনি মাত্র এর আগের দিনই ফরমাশ করে গিয়েছিলেন। (তরুণ সেই ঘোড়সওয়ার অফিসার তাঁর সম্মানে ঘোড়াটিকে দিয়ে কী দারুণ চৌকস ও উল্লম্ফ অভিবাদনই না জানাবেন তাঁকে!) টুপিটা কী দুর্দান্তই না হয়েছে দেখতে! ওতে কী চমৎকার মানিয়েছেও তাঁকে! আর তাঁকে কী অভিজাতই না লাগছিল! পরদিন বিশালবপু মার্চেস, ক্যাফেতে বসে তাঁর ছড়ির রুপালি চাকতিতে হাত রেখে, তাঁর সুগন্ধি সিগারের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে পত্নীর টুপির পালকের কম্পন দেখছিলেন। ভদ্রলোকেরা চোখ টিপে তাঁকে অভিনন্দিত করল। এরপর ভদ্রমহিলাদের ঢল নামে দোকানে, তাঁরা বলেন : তুমি মার্চেসপত্নীর জন্য কী দারুণ একখানা টুপিই না বানিয়েছ! আমাদেরও ওরকম একটি চাই, তবে অত দামি নয়, আমাদের তো আর অত পয়সা নেই। শহরটি যেন অসংখ্য বর্ণীল পালকের আগ্রাসনের শিকার হয়, তার চারপাশ দিয়ে এক অদ্ভুত কমনীয়তা বয়ে যায়; পুরুষেরা তাদের ওয়েস্টকোটের পকেটে রাখা সোনার ঘড়ির স্পর্শ নিতে নিতে খুশিমনে নারীদের দেখে। তারা আলতোভাবে নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে যায়, ব্যথায় কাতর পায়ের সামান্য ঝলক দেখিয়ে, বাতাসে তখন পালকের দোলা আর তাদের বুকে গুচ্ছ গুচ্ছ ভায়োলেট ফুল আঁটা।

শহরের বাইরের তৃণভূমিতে ভায়োলেট ফুল তুলতে গিয়ে একদিন তার পা হড়কে যায়, আর তখনই এক সুদর্শন পুরুষ তাকে বলে ওঠে : ‘কী দারুণ পা তোমার, সিনোরা!’ সে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে এবং প্রশংসার তুবড়ির মাঝখানে তার বাহুতে বেশ জোরেই চাপ দিয়ে ফেলে। সে তাকে বাড়ি অবধি নিয়ে আসার সুযোগ দেয়। তার বুড়ি খালা, রাতের খাবার বানানোর মাঝখানে লক্ষ করেন : ‘তোর জামার হাতায় দেখি বিশাল ছেঁড়া। এই ত্রিশ বছর বয়সেও কি লোকজন রাস্তাঘাটে তোর পিছু নেবে?’ কেউ একজন তার জামার হাতা ছিঁড়ে ফেলেছে মনে করে সে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। ত্রিশ বছর বয়সে সে এখনও অবিবাহিত, এবং যদিও সে যথেষ্ট আকর্ষণীয়, তবু তার পেছনে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়ে না অন্যেরা।

সতেরো বছর বয়সে সে একবার একলাই এক মেডিকেল ছাত্রের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল। তার পরনে সুন্দর একটা টাই ছিল, যদিও গা থেকে তামাকের গন্ধ বেরোচ্ছিল আর তার দাঁতগুলো ছিল বিচ্ছিরি। সাত দিন অপেক্ষা করার পর তার প্রথম শিক্ষকের, মায়ের যৌবনকালের বন্ধু এক বয়স্কা পোশাক নির্মাতা, কারখানা থেকে বেরোনোর মুখে সে এলভিরার দেখা পায়। সেই শিক্ষক তখনও কার্নিভালের পার্টিতে যাচ্ছিলেন, সত্তর বছর বয়সী এক সিনেটরের সঙ্গে, যিনি ফুর্তি করতে, অন্তত সেটা দেখাতে পছন্দ করতেন। সেই সব দিনে তিনি বাড়িতে ছোটখাটো ডিনার প্রস্তুত করাতেন, যার মধ্যে থাকত মাংসের পাই, আসপিক, ফলের টার্ট, তাঁর পাহাড়ি খামার থেকে আনা রেড ওয়াইন, সাসোরিনো লিকর ইত্যাদি। তাঁর গাড়িচালক, এই সব দিনে পরিচারকের পোশাক পরে, ডিনারের পাত্রখানি থিয়েটারে নিয়ে আসত এবং বক্সের পেছনে সিনেটর ও পোশাক নির্মাতা শিক্ষককে তা পরিবেশন করত। বৃদ্ধা হলেও মদ তাকে চাঙা করে তুলত, তিনি সিঁড়ির রেলিং বেয়ে অর্কেস্ট্রা দলের মাঝখানে গিয়ে অবতরণ করতেন, প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায়। তারপর দুদিন তিনি কারখানায় আসতেন না এবং মেয়েরা তখন বুঝতে পারত তিনি সেই ডিনারের রেশ কাটিয়ে ধাতস্থ হয়ে উঠছেন।

সেসব দিনেরই কোনো একটিতে এলভিরা তার স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে একটা অস্বাভাবিক সময়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়, যা অন্য কোনো সময়ে হয়তো পারা যেত না। ছাত্রটি তাকে সঙ্গ দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে এবং সে তার অনুমোদন দিয়ে জনশূন্য পেছনগলি ধরে তার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে, যেখানে সন্ধ্যায় একটা গ্যাসের বাতি খুব ক্ষীণভাবে জ্বলে থাকে (বাতিওয়ালা তার বাতি জ্বালাতে এলে তারা পোর্টিকোর কলামের পেছনে নিজেদের লুকায়)। সেই প্রথম সে কোনো পুরুষের সঙ্গে বাইরে যায় এবং প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতাও হয় তার। কেউ হয়তো তার এই রোমাঞ্চ অভিযানের কথা জেনে গিয়ে থাকবে, কেননা পরেরদিন প্রত্যেকেই তার দিকে ভিন্নভাবে তাকাচ্ছিল যেন। সেই রাতে অন্য কোনো একজনের মুখের লালা এবং তাসকান সিগারের কড়া স্বাদ তার মুখে লেগে থাকে, ফলে খালা যখন কী হয়েছে জানতে চান, তখন সে ‘এই খাবারটা খুব বাজে’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সে আর সেই ছেলেটিকে কোনোদিন দেখেনি। সে ওই ফ্যাকাশে, অসুস্থপ্রায় ছেলেটিকে ছাড়াই দিব্যি চলতে পারত, যে কিনা তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের শেষেই থুতু ফেলত (যদিও তাকে নতুন শাল কিনে দেওয়ার পয়সা ছিল তার)।

সেই ঘটনার পর কী লম্বা সময়ই না পেরিয়ে যায় যখন সে আরেকজন পুরুষের সঙ্গে বাইরে বেরোয়। তার জন্য অনেক প্রস্তাব আসত, ভালো প্রস্তাবও। এবং ধনী দোকানিরাও তাকে প্রেমিকা হিসেবে পাওয়ার জন্য অনেক ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল। না, সে কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারত না, কে জানে কেন। একবার এমনকি সে অনেক নিচেও নামিয়ে এনেছিল নিজেকে। এক শীতে, সেই ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্কের কয়েক বছর পর, তার এক কাজিন, এম সিটির অপেরা নাট্যদলের নাচিয়ে, তাকে কার্নিভালের সময় কয়েকটা দিন তার সঙ্গে কাটিয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে কোনো এক সন্ধ্যায় একজনের স্টুডিওতে, যে কিনা শিল্পী হবার ভান করত, সে, তার কাজিন ও আরেকজন নাচিয়ে মিলে কী মচ্ছবই না করেছিল; আরেক সন্ধ্যায় মেয়েদের ছবিতে পূর্ণ একটি অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে, যার মালিক ছিল এক তরুণ, যে কিনা প্রত্যেককেই টাকা দিত, তা সে যে-ই হোক না কেন। এলভিরা এই সব কামকেলিতে অংশ নিত অনেকটা আবেগহীনভাবেই, উপযুক্ত মুহূর্তে আনন্দ পাবার ভানও করত কিংবা যখন তার নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ত তখন ভীত কিংবা রাগান্বিত হতো। সে সঙ্গের পুরুষদের বলত, ‘আমি আমার বন্ধুদের মতো নই’ এবং তারা হাসতে হাসতে কয়েকবার চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিত এবং খুশিমনেই অন্য দুইজনের শরণাপন্ন হতো, যারা হাসিখুশি ও সহজলভ্য ছিল। শত হলেও, তারা স্রেফ আনন্দের মধ্যেই সন্ধ্যাটা কাটাতে চাইত। অন্য মেয়েদের যা চাওয়া ছিল তারা তা-ই পেত, বিনেপয়সার নৈশভোজ ও কিছু উপহারসামগ্রী, যা কিনা এলভিরাকে ছাড়া সম্ভব হতো না, কেননা সে ছিল কমবয়সী ও বেশি আকর্ষণীয়। তার বন্ধুরা এলভিরার উদাসীনতাকে ঈর্ষা করত : ‘তোমার ভাগ্য ভালো তুমি এমন ঠাণ্ডা, অনেক কষ্ট থেকে বেঁচে গেছ সে জন্য।’

কোনো এক থিয়েটারের সাজগৃহে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়েই তার মাথায় টুপি বানানোর ভাবনাটা আসে, যা এর আগে সে কখনো বানায়নি। পোশাক নির্মাতার দোকানে তার কাজের মধ্যে ছিল সাধারণ ছোটখাটো সেলাই, বোতামঘর বানানো, বোতাম লাগানো এই সব...টুপিটা তার বেশ ভালোই হয় : একটা বড়সড় হ্যাট, তখনকার যেটা কেতা ছিল, একটা বিশাল গোলাপি রিবন ও বো-সমেত। তার কাজিন যখন সেটা দেখে তখন সেও সেরকম একটা চায়, এবং তার বন্ধুও আরেকটার ফরমাশ করে। এলভিরা সেটা একটু অন্যরকমভাবে তৈরি করে : পুঁতির মালার ঝালরসহ। সে তৃতীয় শ্রেণিতে চড়ে বাড়ি যায় এবং সেই যাত্রার সময় যাজিকা হবার কথা ভাবে। সে চোখ নিচু করে থাকে এবং তার ভাবতে ভালো লাগে যে, অন্যরা তার দিকে তাকিয়ে আছে : ‘সিস্টার এলভিরা, অমন গোড়ালি ঢাকা সুন্দর জুতো পরা তোমাকে আমি চুমুই খেতাম, যদি তুমি সাধারণ নারী হতে’; ‘হেইল মেরি, আমাদের পাপ মোচন করে দাও, লর্ড, হেইল মেরি।’ এরই মধ্যে তার ত্যক্তবিরক্ত, ঘেন্না ধরে যাওয়া খালাটি, এলভিরার জন্য অপেক্ষা করেন : তিনি তখনও তার জীবনের একটা গতি করে চিরদিনের মতো তার হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হননি। এলভিরা ফিরে আসে : হাতে জপমালা এবং একই সঙ্গে পালিয়ে যাবার প্রবল বাসনা নিয়ে। বছর গড়ায়, খালা আরও বুড়ো হয়, এবং টুপি, ফরমাশ, উপার্জন মিলিয়ে এলভিরা আরও স্বাবলম্বী হয়; তারপর একদিন বসন্তদিনে মাঠে ভায়োলেট তুলতে যাবার মতো স্বাধীন হতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়, তাতে পরনের স্কার্ট ওপরে উঠে এলে তার পা-জোড়া বেরিয়ে পড়ে। ‘কী সুন্দর পা, সিনোরা!’ সে তার জামার হাতা ছিঁড়ে ফেলে। কালকের দিনটা আরেকটা নতুন জামায় কী দুর্দান্তই না হবে!

গ্যাস কোম্পানির প্রথম দিকের একজন কর্মী ছিল আর্তুরো। সে প্রচুর টাকা আয় করত। সে-ই এলভিরাকে তার ব্যবসা শুরু করার প্রাথমিক পুঁজির টাকাটা দিয়েছিল। তৃপ্ত, বড়সড় মানুষ সে তার মাথা ও লাঠি দোলাতে দোলাতে দোকানে আসে। এলভিরা সেলাই করছিল, পা-জোড়া ফাঁক করে বসে, সহকর্মীদের মঙ্গে আঞ্চলিক ভাষায় ধীরে সুস্থে গল্প করছিল, তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকে উপভোগ করে। তুরীয়ানন্দে নিমজ্জিত সে প্রায়শই লা ট্রাভিয়াতা থেকে কয়েক লাইন সুর করে গাইত : ‘আজ রাতে আমি তোমার কাছে আসব, চুমু।’ আর্তুরো হেলেদুলে দোকানে প্রবেশ করে, দরজাটা সামান্য ফাঁক করে, ওই মুহূর্তে সেখান দিয়ে যাওয়া ধোপদুরস্ত অফিসারদের শরীরের হালকা ঘ্রাণের রেশটুক ভেতরে ঢুকতে দিয়ে। তারা সেলেস্তিনার প্যাস্ট্রির দোকান থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরছিল। সন্ধ্যা সাতটার জনতার জোয়ার আর্তুরোকে গিলে নেয়, যে সময়টায় তারা সিনোরা আলতানির সঙ্গে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর এক অফিসারের সঙ্গে প্রণয়ের কথা ফিসফাস করে। এলভিরা আগেভাগেই কাজ শেষ করে দোকান বন্ধ করে দেয়, আহা কী সুন্দর সন্ধ্যা! ‘আজ রাতে আমি তোমার কাছে আসব, চুমু, অনেকগুলো মজাদার ক্রিমের পাফ নিয়ে, যার সবকটা তোমার জন্য।’ তাকে প্যাস্ট্রি কেনার জন্য সেলেস্তিনায় যেতে হয়, কফি কেনার জন্য ব্রাসিলে, বুদবুদ ওঠা সাদা ওয়াইনের জন্য তসকানায় আর মিনঘেত্তি কেনার জন্য সিগারের দোকানে। তাপর পোশাক পালটাতে ও গায়ে পার্ফুম মাখতে রীতিমতো দৌড়ে বাড়ি ফিরতে হয়। তখন তার প্রতিটি আনন্দের ফোঁটা গোলাকার ল্যাম্পশেডের নিচ দিয়ে, বহুবর্ণা পুঁতির ঝালর বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। রাত দুটোর দিকে আর্তুরো বিছানা থেকে উঠে পড়ে। হয় তাকে জরুরি কোনো কাজের জন্য ট্রেন ধরতে হবে, অথবা সে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল, কেননা সে বলে, কেউ যদি তার প্রেমাস্পদের কাছে বেশিক্ষণ থাকে, লোকেরা তখন সমালোচনা করার সুযোগ পায়; সে তাকে একা ফেলে যায় চাদরের উষ্ণতা ও চরম তৃপ্তির রেশটুকু উপভোগ করার জন্য। আরও ঘণ্টাখানেক পরে সে ঘুমিয়ে পড়ে, এমন সব সুখকল্পনার দ্বারা আন্দোলিত হতে হতে, যার সমাপ্তি ঘটে অবশ্যম্ভাবীভাবে আর্তুরোর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে। তারপর সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়, এবং ঘুমুতেই থাকে যতক্ষণ না একটি চমৎকার পালকের টুপি তাকে বাস্তবে টেনে আনে। ‘ওহ এলভিরা, ও সুন্দরী এলভিরা’, পাড়ার ছেলেরা গান গায়। সকালে সে দোকানে যায়, এবং তার শক্তিশালী, সুদৃঢ় পদক্ষেপসমূহ ফুটপাতে প্রতিধ্বনি তোলে। যে ধনী যুবাটি ওপরে কোথাও তখনও ঘুমাচ্ছিল, সে যদি শুনতে চাইত, তাহলে একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারত, সেই পদযুগল আসলে কার। কিন্তু সে সেই তরুণ প্রভুদের কিছুই উপহার দেয় না, এমনকি সামান্য চাহনিও নয়। তারা দোকানের জানালার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জটলা পাকাতে পারত, কেননা সে কখনোই তা নিয়ে বিরক্ত হতো না। আহা, তারপরও, তার নিজেরই পায়ের আওয়াজটুকু তাদেরকে শোনানোটা কী আনন্দেরই না বিষয়! কী শক্তি, কী টানটান, (আর্তুরো যেমন বলে), কী বেদনাজাগানিয়া, সেই পা-জোড়া। এবং সে ফুটপাতে আরও জোরে পা ফেলে গর্বিতভাবে এগিয়ে যায়, কথ্যবুরিতে নিজেই নিজেকে কী একটা অশ্লীল কথা বলে।

গ্রীষ্মের কোনো এক সময় (আর্তুরো কর্মব্যপদেশে দূরে ছিল) এলভিরা ফুলের নকশাকাটা নরম আরাম কেদারাটায় বসে ছিল, জানালার সামনে, এবং তীব্র গরমের কারণে অর্ধনগ্ন প্রায়, স্বপ্ন দেখছিল সে মেঘের মাঝখানে ঝুলছে আর আর্তুরো তাকে ঘিরে বাতাস করছে। সে এমনকি প্যারিসে একটা বনেদি ফ্যাশন হাউসের পরিচালিকা হিসেবেও নিজেকে দেখতে পায় : শেজ আর্তুর নামে। অথবা পাড়া থেকে ভেসে আসা গুমোট গরমে সে নিজেকে স্বর্গতুল্য এক হাটবারে আইসক্রিমওয়ালাদের গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেখে; এবং প্রত্যেক আইসক্রিমওয়ালার মুখেই দেখে একই অদ্ভুত, অস্পষ্ট, আর্তুরো-প্রায় অভিব্যক্তি। বিশেষ উপলক্ষ্যের দিনগুলোতে তাদের সেই জুড়িগাড়িতে চড়ে মজা করে বেড়ানো, একদিন নদীর ধারে, অন্যদিন চার-মিনারের প্রাসাদে। ঈর্ষান্বিত বোচি খেলোয়াড়েরা খেলা থামিয়ে তাদেরকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে। তাদের একজন বলে : ‘আমি এই সুন্দরী রক্ষিতা নারীটিকে পেতে কী ভালোই না বাসতাম, আমি তাকে মিলান নিয়ে গিয়ে আমোদে ভাসিয়ে দিতাম, আমার কাছ থেকে কোনোভাবেই নিস্তার পেত না সে।’ আর অন্যেরা হেসে উঠত, তখন আর্তুরো তার কোমর জড়িয়ে থাকে শক্তহাতে। কোনো এক বছর মধ্যআগস্টে তারা সমুদ্রসৈকতে যায়। কিন্তু এলভিরার সেটা পছন্দ হয় না এবং সে বাড়ি ফিরে আসতে চায় তক্ষুনি, তার সুন্দর ঝালরঅলা বিছানার চাদরটাকে আবার দেখবে বলে। আর্তুরো তার গোঁফজোড়াকে বাড়তে দেয়, তার কালো গোঁফ। এক রাতে, যথারীতি, সে বিদায় নেয় এবং বলে যায় দুদিনের জন্য সে ব্যবসার কাজে দূরে যাচ্ছে। এলভিরা শান্তিতে ঘুমায়, সকালে জেগে ওঠে, এবং দুটো দিন বিরামহীন কাজ করে; যেহেতু, সুন্দরী, অভিজাত নারীরা তাঁদের টুপির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আর্তুরো আর ফিরে আসেনি, সে তাকে আর কোনোদিন দেখেনি, তার সম্পর্কে কিছু শুনতেও পায়নি। শহরের নারীদেরকে নতুন এক টুপিওয়ালি খুঁজে নিতে হয়েছিল। এলভিরা তার দোকানই গুটিয়ে ফেলেছিল।

তিনি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান : বড় ও ভারী, একটা লম্বা, কালো ডোরাকাটা ছাইরঙা স্কার্ট ও গাঢ় রঙের নকশা তোলা শার্ট পরনে, যেটা থেকে বন্ধ আলমারির গন্ধ আসছিল যার মধ্যে কেউ একজন একটা বিস্কুট ভুলে ফেলে গিয়েছিল। তিনি এলোমেলো পায়ে ঘরের আরেক পাশে যান। কোনোমতে তাঁর কাজের টেবিলের কাছে যেতে পারেন, তাঁর বুক ধড়ফড় করে আর গলা বুজে আসে। তিনি দূর থেকে এবং চকিতে দেয়াল আয়নার দিকে দেখেন : এত লম্বা তিনি, আর তাঁর চোখ এত ঘনকালো। টেবিলের ড্রয়ারে একটা বাজারের ফর্দের কাগজ। তার ওপর কিছু একটা লেখা। হয়তো : ‘কী দারুণ পা, সিনোরা,’ অথবা ‘আজ রাতে আমি তোমার কাছে আসব, চুমু।’ তিনি অনেকক্ষণ ধরে সেটা পড়েন। তারপর ধীরে ধীরে নরম ফুলঅলা চেয়ারটায় গিয়ে বসেন। হলদেটে হয়ে যাওয়া সাদা ঝালরঅলা বিছানার চাদরটা থেকে, যার দিকে কেউ হয়তো চেয়েও দেখে না, একটা বাজে গন্ধ আসে। চারপাশ দম বন্ধ করা। এলভিরার পক্ষে সময়ের ডানায় ভর দিয়ে আর অতীতে ফিরে যাওয়া হয় না।


আন্তোনিও দেলফিনি (১৯০৭-১৯৬৩)

আন্তোনিও দেলফিনি ইতালির একজন প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক, যিনি খুব বেশি না লিখলেও ঐতালিক সাহিত্যে তাঁর পরিচিতি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিপুল। মূলত গদ্যকার হলেও দেল্ফিনি দুটি কাব্যগ্রন্থেরও রচয়িতা। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ Memories of the Basque Country’র জন্য তিনি দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। এই গ্রন্থের গল্পসমূহের পরাবাস্তব চেতনা, নিরীক্ষাধর্মী গদ্য, অস্তিত্ববাদী জীবনজিজ্ঞাসা তরুণ ও বোদ্ধা পাঠকদের মাঝে বিপুল সাড়া ফেলে। প্রথাবিরোধী জীবনযাপনে অভ্যস্ত দেল্ফিনি সাহিত্য নিয়ে নানাবিধ নিরীক্ষা করেছেন, বেশকিছু সাময়িকপত্র ও সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং তাঁর দিনলিপি থেকে জানা যায়, প্রায় শখানেক লেখা অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে গেছেন। দিনলিপিটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রখ্যাত ইতালীয় সাহিত্যিক নাতালিয়া গিন্সবার্গ কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে : The Lost Rosina (১৯৫৭), Modena 1831, City of Chartreuse (১৯৬২), The Stories (১৯৬৩) ইত্যাদি। তাঁর জন্মশহর মোদেনার গণপাঠাগার থেকে তাঁর নামে তরুণ কবিদের জন্য একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। অনূদিত গল্পটি La Modista নামে ১৯৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় Oggi পত্রিকায়, এবং পরে তাঁর গল্পগ্রন্থ Memories of the Basque Country-তে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি ঝুম্পা লাহিড়ী সম্পাদিত The Penguin Book of Italian Short Stories গ্রন্থভুক্ত Ann Goldstein কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে পুনরনূদিত।] 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সৈকতে জনসমুদ্র!
চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল
জঞ্জালের নগরে প্রাণ ভরানো সবুজের খোঁজে...
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার