X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় দে ও তাঁর সঙ্গে কথোপকথন 

গৌতম গুহ রায়
০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:২৫আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:২৫

সত্তরের দশকে যখন কম্পিত বাংলার মাটি, সেই সময় জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রকাশিত একটি লিটল ম্যাগাজিন পাঠকের সাহিত্যপাঠের রুচিকে আমূল টলিয়ে দিয়েছিল। বিজয় দে’র ‘পাগলা ঘোড়া’। তিন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, তিন স্বতন্ত্র স্বরের কবি। সবসময় একসঙ্গে : আড্ডায়, পত্রিকায়, রুচিতে, ঘোরাঘুরিতে। বিজয় দে, সমর রায়চৌধুরী ও শ্যামল সিংহ। গত চার দশকের এই আড্ডায় আমিও জড়িয়ে গেছি, অনতিক্রম্য বন্ধনে। শ্যামল সিংহ আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে, সমর রায়চৌধুরী অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি। বিজয় দে ও আমি নিয়মিত আড্ডায় আসি, সেখানেই কবিতা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। পাঠকের সামনে সেই কথোপকথনের কয়েক টুকরো রাখছি।

বিজয় দে, দেশভাগ-বিধ্বস্ত বাংলার এক উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম। সনটা ১৯৫১, ১ জানুয়ারি। ঠিকানা—উদ্বাস্তু অধ্যুষিত জলপাইগুড়ি শহরের পানপাড়া ‘গাঁ’। মা সুনীতিবালা বাবা গণেশ চন্দ্র দে। ফণীন্দ্রদেব স্কুল, আনন্দচন্দ্র কলেজ হয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। পেশায় ব্যাংক-কর্মী, এখন অবসরপ্রাপ্ত, পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মী।

কবি বিজয় দে’র স্বতন্ত্র স্বরের সঙ্গে পাঠকের আলাপ সেই ১৯৭৪’ ৭৫-এর রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থাকালীন অবদমনের কালে  সাহসী ভিন্ন মেজাজের ‘পাগলা ঘোড়া’ থেকেই। বিজয় দে’র হাতে প্রতিটি সংখ্যাই নির্মিত হতো পূর্ণ চমক নিয়ে, হইচই করে। আমি তখন নিছক কিশোর, একদিন হলদে কভারের লম্বামতো একটি লিটল ম্যাগাজিন হাতে এলো, চমকের শুরু কভার থেকেই, কাগজের লম্বা মুখোশে ঢাকা তিনটি মুখ, খবরের কাগজে বানানো মুখোশের চোখের জায়গাটায় ছিদ্র। আসলে এই তিনটি মুখ তিন কবির, বিজয়, সমর, শ্যামল। ভেতরে ১৩টি প্রশ্নোত্তরে এদের জীবনদর্শন, ভালো লাগা-মন্দ লাগা। ৩ নম্বর জিজ্ঞার উত্তরে বিজয় দে লিখেছিলে : ‘জীবনের প্রথম কবিতা # ফটো বাইন্ডিং এর দোকানে কাঁচ কাটা দেখা’। এর ঠিক আগের জিজ্ঞাসা সবচেয়ে কম বয়সের স্মৃতির উত্তরে লিখেছিলেন, ‘চার/পাঁচ বছর বয়স, এখনকার বাংলাদেশে আমার মায়ের বাপের বাড়ির পাশেই দিগন্ত বিস্তৃত পাটখেতের ভেতর হারিয়ে যাওয়া, আর স্বজন হারানোর মতো কান্না।’ মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার ক্ষীণতনু ‘পাগলা ঘোড়া’র এক একটি সংখ্যা সেদিন আমার মতো এই অঞ্চলের তারুণ্যকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। মনে আছে একটি সংখ্যার কথা, বাদামি কাগজে মোড়ানো সেই সংখ্যায় অরুণেশ ঘোষের সাক্ষাৎকার ছিল। খাকি পোশাকের পুলিশ নিয়ে অরুণেশ ঘোষ একটি মন্তব্য করেছিলেন, সেই নিয়ে ব্যারাকপুরের পুলিশ ফাড়ি থেকে সম্পাদক বিজয় দে’র কাছে হুমকি চিঠি আসে। কিন্তু কোনো হুমকিই সেদিন মেরুদণ্ড সোজা করে কাগজ করা থেকে তাঁকে বিরত করতে পারে নাই। আর একটি ঘটনা, ডিবিসি রোডের শামশের আনোয়ারের নানার বাড়ি ‘মুর্শিদাবাদ হাউস’, একবার ঠিক হলো সেই বাড়ির দেয়ালে কবিতা লেখা হবে। বিজয় দে, সমর রায়চৌধুরী প্রমুখ প্রধান উদ্যোগী। চুন রং করে দেয়াল প্রস্তুত করা হলো, কবিতা লেখা হলো, ইলাস্ট্রেশনসহ, কিন্তু রাজনীতির মানুষদের এ সহ্য হবে কেন? সেই কবিতার গ্যালারি মুছে স্লোগান লিখবার দাবি নিয়ে হাজির একদল। হুমকিকে অগ্রাহ্য করেই সেদিন কবিতা লেখা হয়েছিল। যদিও পরে সেই কবিতার গ্যালারি বন্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্বাসে মার্কসবাদী বিজয় দে সাহিত্যকর্মেও ছিলেন সক্রিয়বাদী, শৌখিন শিল্পচর্চার বিপ্রতীপে তিনি বরাবর। উল্লেখিত ‘পাগলা ঘোড়া’য় এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছিলেন, ‘এই মুহূর্তের রাজনৈতিক চিন্তা যা সক্রিয়ভাবে করতে পারলে খুব ভালো হতো...এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সমস্ত সমর্থ ভূমিহীন কৃষকের হাতে জমি/চাষ/ফসলের অধিকার ন্যাস্ত করার জন্য দেশজুড়ে তীব্র গণআন্দোলন। যার পেছনে থাকবে সমস্ত মার্কসবাদী বামপন্থি গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের একত্রিত সমর্থন।’ তাঁর কাছে বেঁচে থাকার উদ্যেশ্য : ‘নিজেকে না বেচে যতটা সম্ভব বেঁচে থাকা যায়’। এই ‘বেঁচে’ থাকাটাই কবিতার বিজয় দে’কেও স্বতন্ত্র রেখেছে। কবিতাকে তিনি মানুষের যাবতীয় আশা স্বপ্ন ভালোবাসা ভালোলাগা হাসি কান্না ক্ষোভ প্রেম অপ্রেম স্লোগানের সঙ্গে জুড়ে রেখেছেন, কিন্তু সেটা ‘বিজয় দে’র মতোই, কোনো আপস নেই, উচ্চকিত স্লোগানের মতো তাৎক্ষণিক চিৎকার নয়; মানুষের হৃদয়ের, শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে তাল রেখে সেই কবিতা স্পন্দিত হয়। বিজয় দে লেখেন,

‘ভাঙ্গা উনানের মতো নতজানু, একা, যেন আগুনের ঠাণ্ডা কঙ্কাল/যেন আমি/তিস্তার শাদা ও শূন্য হাড়, সুদূর সীমান্তফলক, যেন অস্ত্রনালীর মৃত ঘুম/যেন আমি জেলাশহরের পেটের ভিতরে পাথরের কঠিন ব্যর্থতা/যেন আমি/জলাপাহাড়ের হিম প্রেত, বরফের প্রত্নশরীর/আর লেবঙ্গের নিঝুম আস্তাবল/যেন পাথরের সাথে পাথরের সাথে পাথরের চতুর সমকাম...’

পত্রিকার নাম ‘পাগলা ঘোড়া’ কীভাবে হলো এর পেছনেও একটা দারুণ গল্প আছে। একবার শ্যামল ও বিজয় দুজনে শিলিগুড়িতে ‘বহুরূপী’র নাটক ‘পাগলা ঘোড়া’ দেখতে গিয়েছিলেন। সেদিন দুই বন্ধু নাটক দেখে অভিভূত, সেদিন আর জলপাইগুড়ি ফিরে আসা হয় নাই, তখন বন্ধু আত্মীয়হীন শিলিগুড়িতে রাত্রিবাসের জায়গা ছিল না বলে রাতে হিলিকার্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিউ-জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন, সেখানেই দুজনে প্লাটফর্মে রাত কাটান। বিজয় দে’র বয়ানে, ‘যাতে পরদিন বিনে পয়সায় ট্রেনে বাড়ি ফিরতে পারি। ওই রাতেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিই, যদি বেকার অবস্থার অবসান হয়, তারপর যদি কোনোদিন কাগজ করি, তার নাম রাখবো ‘পাগলা ঘোড়া’। ১৯৭৫-এ এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।

যেদিন শ্যামল সিংহ চলে গেলেন সেদিন সাত সকালে হাসপাতালে গিয়েও বন্ধুর জন্য কিছু করতে পারেননি, তার আগেই চির বিদায় নিয়েছেন কবি শ্যামল সিং। বন্ধুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া তাঁকে অনেকদিন যন্ত্রণা দিয়েছে, সঙ্গে থেকে তা আমিও অনুভব করেছি। সামাজিক ও মানবিক বিজয় দে নাকি কবি বিজয় দে, কাকে এগিয়ে রাখব আজও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

‘হাতের মুঠোর মধ্যে অক্ষর, অহ্নগকার, হরফের ঘাম

শীত চলে গেছে, এবার কি বাণিজ্যও উড়ে যাবে সুদূর?

চামরায় ফুটে উঠল অবাক বিষাদ

কা’র, কা’র গো, কেউ যাচ্ছে কোথাও

নাকি কেউ এসেছে এই শহরে

নগর জলপাইগুড়িতে সব চাইতে সুখী পুরুষ কে?

লজ্জা করে বলতে/আমি...’

বিজয় দে’র কবিতায় ‘দর্শনের ভার নেই, বদলে আছে এক প্রখর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। পক্ষপাত গোপনও করে না, প্রচারও করে না।’ আসলে এটা সত্যিই, বিজয়ের কবিতায় থাকে কৌতুক প্রিয়তার অন্তঃস্থলে থাকা বিষাদের ঝলমলিয়ে ওঠা আলো।

তেভাগার চারণ কবি লাল শুক্রা ওড়াও-এর মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে চালসা গিয়েছিলাম। পথে অনেক কথা, বুঝেছিলাম শুধু কবিতা নয় তিনি একজন সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানীও। মনে পড়ে একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় ভূমিপুত্রের কলামে লিখেছিলেন, ‘...ডায়না নদীর বালুচরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, ‘এই নদী আমার।’ গভীর রাতে ত্রিদিবের সঙ্গে হাসিমারা থেকে রাজাভাতখাওয়া, শুধু একটা স্টিম-ইঞ্জিনে যেতে যেতে মনে হয়, ‘এই জঙ্গল এই অন্ধকার আমার’। মূর্তি নদীর কোল থেকে ধূপঝোড়ার পথে যেতে যেতে মনে হয়, ‘এই পথ তেভাগার লালা শুঁক্ররা ওরাঁওয়ের পথ, এই পথ আমার’।

এই লেখারই একটি মর্মস্পর্শী জায়গা, ‘স্বাধীনতার দেড়-দশক পরে, আমার ঠাকুমা তখন পাকাপাকিভাবে পাকিস্তান ছেড়ে আমাদের কাছে চলে এলেন, তখন সীমান্তের পুলিশকে সর্বস্ব দিয়ে আসতে হয়েছিল। শুধু এক টুকরো ক্ষীর হাতে মুঠো করে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। বোধহয় জীবনে প্রথম ক্ষীর খাওয়া, ছয় ভাই-বোন ভাগ করে খেয়েছিলাম। স্বাধীনতার মূ্ল্যে কেনা সেই এক টুকরো ক্ষীর, সেই এক কণা ক্ষীর আজও যে আমার আত্মায় লেগে আছে।’ দেশভাগের যন্ত্রণা লাখ লাখ বাংলাভাষীর মতো তিনিও বহন করেন, এই যন্ত্রণার ছোঁয়া তাঁর কবিতাতেও পাওয়া যায়। এমনই একটি কবিতা ‘শামশের আনোয়ারের নানী’। বিজয় দে’র আমাদের দেশ ও নিজস্ব গৃহকোণ এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়, উদাহরণ ‘কাঁটাতার’ কবিতাটি।  ‘নীলফামারি থেকে যে চাঁদ একদিন চিলের মতো উড়ে এসে/আমাদের উঠোনে ভেঙ্গে পড়েছিল/আমি তার ডাকনাম থেকে মুছে দিতে চাই কাঁটাতার।’ দেশভাগ থেকেই প্রসঙ্গে আসে ‘দেশ’, এই ভারতবর্ষ, দেশ নিয়ে তার অভিব্যক্তি অসাধারণ এক চিলতে গদ্যে, ‘অনেক দিন আগে, রাজস্থানের এক কৃষ্ণ মন্দিরে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা একজন পূজারিণীকে দেখেছিলাম মীরার ভজন গাইতে। তাঁর ভক্তিমূলক চোখে ভারতবর্ষের চেহারাটা কীরকম, আমি জানি না। চাউলহাটির কমলা মছিরুদ্দিন যে প্রতিদিন কাজ পাবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে কোনোদিন খালি পেটে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। এই মছিরুদ্দিনের চোখে ভারতবর্ষটা ঠিক কীরকম? কিংবা নদীয়া জেলার আড়ংঘাটায় রেললাইনের পাশে বাউল সুবল দাশের আখড়ায়, একজন নিবিষ্ট ভক্ত আমাদের জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা আপনাদের ওখান থেকে পাঞ্জাবের ট্রেন পাওয়া যাবে? বোঝা যায়, তার এখনও ভূগোল-জ্ঞান তৈরি হয়নি। তার চোখে ভারতবর্ষটা কীরকম? আমি ওদের চোখ দিয়ে দেখা একটা ভারতবর্ষ আঁকার চেষ্টা করি।’ এই চিত্রটা শুধুমাত্র তিনি দেশের নয় ভাষারও আঁকেন। তাঁর ‘দেশের বাড়ির ঠিকানা’¾‘চোখের জল। এই নামে চোখের ভেতরে একখনি দেশের বাড়ি আছে। ... ছোট মাসির শেষ ঠিকানা লামডিং। একটা যেমন তেমন টিলা, মনে হয় এখানে ভূগোল/কারো বাড়ি খুঁজতে এসে কোথাও যেন হারিয়ে গেছে, সেই ভূগোল হারা একটা ন্যাড়া/মাঠের ওপরে ছোট মাসির ঘর। এমন জায়গা, যে চিঠি দিলে মনে হয়, চিঠির উত্তর/হারাতে হারাতে এক সময় লেখাও ফুরিয়ে যাবে। ওখানে যাবো।/... শূন্যতা একা নয়। তারও সঙ্গী চাই/কিন্তু তুমি বললেও আমি একা কোথাও যাবো না/আমার সঙ্গে শীতকাল যাবে। দুধভাত যাবে। বকফুল যাবে।/দেশের বাড়ির ঠিকানাও যাবে।’ 

নিজের বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন:

—‘১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়, বাবা প্রায় প্রাণ হাতে নিয়ে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর পেছনে ফেলে এক-কাপড়ে ঢাকা থেকে চলে এলেন অচেনা অজানা উত্তরবঙ্গে, তারপর নানা পথ ঘুরে জলপাইগুড়ি শহরে এসে থিতু হলেন, কিন্তু নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, এর মধ্যে তিনি একা থেকে দোকা হলেন। ৫১-তে আমার জন্মের পর থেকে ১৯৬৮-র মাঝামাঝি পর্যন্ত, অন্তত সাত-আটটা বাড়ি পালটাতে পালটাতে অবশেষে একতা স্থায়ী ঠিকানা আমরা পেলাম। কোনো পাড়াতেই বেশিদিন নয়, সংসার বড় হচ্ছে, জায়গার সংকুলান হচ্ছে না, ভাড়াবাড়িতে আরও অনেক অসুবিধা। কোথাও পাকা বাড়ি, কোথাও মাটির মেঝে, কখনো মুলি বাঁশ, কখনো টিনের দেয়াল আর সর্বত্র খাটা পাউখান এবং বৈদ্যুতিক আলোহীন জীবন। ১৯৬৮’র বন্যার কয়েকদিন আগে আমাদের নিজস্ব বাড়ি, সে যেমনই হোক, জীবনে প্রথম স্যানিটারি ল্যাট্রিন এলো, ইলেক্ট্রিসিটি এলো। মায়ের অনেক দিনের একটা স্বপ্ন পূরণ হলো, আমরা যেন একটু একটু শেকড় ও ডানার গল্প শুনতে পেলাম।’ (কবিসম্মেলন—ডিসেম্বর’১৯)

নিজের শৈশব ও কৈশোর নিয়ে খুব সুন্দর করে বলেছিলেন:

—‘আমার ছেলেবেলা বা শৈশবকাল কিংবা কৈশোর...যাই বলি না কেন, সব মিলেমিশে যেন বৃষ্টি-ভেজা কয়েকটি দিন ও রাতের যোগফল। ছেলেবেলা গেছে কাগজের নৌকো বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতে, শৈশব তার কচি পা দিয়ে জল নাড়িয়ে দিচ্ছে আর কৈশোর-কাল বৃষ্টি-ভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে, শোনো ভাই, কাগজের গায়ে অন্যের শৈশব লেগে না থাকলে নিজের শৈশব-কালকেও যেন ঠিকমতো বোঝানো যায় না...নিজেকে কিছুটা ভূতুড়ে কিছুটা বোকা বোকা নির্জন মনে হয়...।’

কবিতার নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি নিজের ঠিকানা নিজের মতো করে খুঁজে নেওয়ার পক্ষপাতি। তাঁর কাছে কবিতা¾

—‘পাঠকপ্রিয় হলেও দিনের শেষে সবই ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলে মনে হতে পারে। নিজেকে একটা প্রশ্ন করা, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, উত্তর পেয়ে গেলে সেই উত্তরের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা, থিসিস-আয়ন্টিথিসিস সিন্থেসিসে পৌঁছানো, এটা আমার একটা মজার খেলা। একজন কবির উদ্দেশ্য অন্যরকম, সে ঠিকানা খুঁজে পেলেও, সেই ঠিকানার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে।’

গত চার দশক বছর ধরে এই নির্মাণ ও প্রতি-নির্মাণ তাঁর। বিজ্ঞানের ছাত্র বিজয় দে কবিতাকে দেখেন বাস্তব ও পরাবস্তবের যৌথ ভিত্তিভূমি থেকে। তিনি বিশ্বাস করেন—

—‘কবি কোনোরকম ম্যানিফেস্টো মাথায় নিয়ে কবিতা লিখতে বসে না।’ তাঁর মতে, ‘কোন লেখাটা শেষ পর্যন্ত ‘স্ট্রাকচার অফ বেঞ্জিন’ হবে আর কোন লেখাটা শেষে গিয়ে ‘সিম্পল হারমনিক মোশন’ হবে, তার কোনো সহজ ফর্মুলা এখনও মনে হয় জানা যায়নি।...তবে সচেতনভাবে যেটা চেষ্টা করছি, সেটা হচ্ছে গদ্য ও কবিতার সীমারেখাটা মুছে দেওয়া। ন্যারেটিভ স্টাইল ছাড়া এসব করতে পারতাম না।’

—আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো দেশবন্ধুনগড় কলোনি থেকে প্রকাশিত ‘অঙ্কুর’ সাহিত্যপত্রে । সম্পাদক ছিলেন রমেন্দ্রনাথ রায়। ৬৮, দেশবন্ধুনগড় উদ্বাস্তু কলোনি। সাতের দশকের শুরুতে, এরপর একে একে পাঁচ দশক...!’

বিজয় দে’র নির্মাণকাণ্ডের এক একটি মাইলফলক—‘হে থুতু হে ডাকটিকিট হে অরণ্য’ (১৯৮৫), ‘কাঠুরিয়া আন্তর্জাতিক’ (১৯৯৮), ‘বম্বে টকি’ (২০০০), ‘জঙ্গল সূত্র’ (২০১৫), ‘কামরাঙ্গা এবং ট্রামলাইন’ (২০১৬), ‘বাবলিবাগান’ (২০১৬), ‘হাতবোমা’ (২০১৭), ‘কবির স্বপ্ন জ্বলে সাপের মাথায়’ (২০১৭), ‘সকল বৃক্ষের চুমুক’ (২০১৮), ‘টুকটুকি বাড়ি নেই’ (২০১৯) ‘বৃষ্টিমাতরম’ (২০২০), ‘সকল মধুবালা কেবিন’ (২০২২)... ... ... এই অনন্তের চিরকালীন শব্দ-শক্তি বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করছে সেই কবির নিজের কথা :

—‘... আমার জীবনের তুলনায় এইসব লেখা যেন অনেক অনেক বেশি। অসংগতি থেকেই কৌতুকের জন্ম হয়। ব্যক্তিজীবনের অসংগতি, লেখক-জীবনের অসংগতি, জন-জীবনের অসংগতি, সব কিছু থেকেই এক দুর্মর পরিহাসপ্রিয়তার জন্ম নিয়েছে, আসলে হয়তো হাসি বা কৌতুক দিয়ে নিজের চোখের জল ঢাকার চেষ্টা। সমাজ বহির্ভূত নই ঠিকই, তবু এই সমাজের ভেতরে থেকে, এক ধরনের অসামাজিক, অন্তর্ঘাত চালানোর চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। কখনো হয়তো সফল হয়েছি, কখনো একেবারেই হইনি।’ 

প্রায় দুই দশক আগে বিজয় দে লিখেছিলেন—‘এই শহর, এই জেলা, এই উত্তরবঙ্গ হয়তো দুহাত বাড়িয়ে কোনোদিন ডাকেনি। কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ, তাদের পায়ের কাছে আমাকে একটু বসায় জায়গা দিয়েছে। আমি ঘুম স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝখানে কখনো উঁকি দিয়ে দেখি আমাকেই...।’ আজ গোটা বাংলাভাষা সাম্রাজ্য আপনাকেই দেখছে, আমাদের কবি বিজয় দে।

‘...নদী পেরোলে নদীমাতৃক নামতা শেখার স্কুল। নদী পেরিয়ে

এখন একজন যন্ত্রহারা বাউল আসছে

বাউল শিখবে ভোলা মন’ এর স্কুল পালানো গান। আর

একতা সেলাইকল বাউলের কাছে ঘর গেরস্তি শিখবে

তারপর’ গান থেকে শুধু সেলাইকলের সুতো টানাপোড়েন

নদী তার সহজ নামতা ভুলে যায়...’  (খোলা গান/ বিজয় দে)

কবিতা ও রাজনীতি নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? কলকাতার কাগজ ‘কবিসম্মেলন’-এ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন—

—‘... এই পৃথিবীটা যতটা রাজনৈতিক একজন কবিও ততটাই। দ্বিতীয়ত : কবি কখনো কমিটমেন্টের আপিসে বসে চাকরি করতে পারে না, বা সে কমিটমেন্টের ‘হোলটাইমার’ নয়। তৃতীয়ত : দলে থাকুন আর নাই থাকুন, কোনো আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি থাকুক আর না থাকুক, সব লেখাই সব কবিতাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক।...কবির একতা আলাদা নিজস্ব ‘নর্মাল লাইফ’ আছে।...আর যখনই কোনো কারণে তার ‘নর্মাল লাইফ’ বিঘ্নিত হয়, তখন তিনি কবিতা লেখেন ‘স্বদেশ’। সেই বিঘ্নিত সময়ের তাপ-উত্তাপবিদ্যার চেহারাটাই শেষ পর্যন্ত কবির রাজনৈতিক কবিতা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে