একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ভিকটিমদের এখনও ভোলেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিবার ও আহতদের সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। হতাহতের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, বড় অঙ্কের এফডিআরের ব্যবস্থাসহ তাদের জীবন ধারণের জন্য যা যা করণীয়, নিয়মিত সেসব তিনি করে যাচ্ছেন। এমনকি সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করে, রাজউকের প্রকল্পে জমি বা ফ্ল্যাট দিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ নিয়ে অনেকের ত্যাগের প্রতিদান দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের স্থায়ী অর্থের উৎস হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পরিবার প্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার এফডিআর করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর ৬৬ জনের জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেন। পরে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু পরিবারের জন্য তিনি এ ব্যবস্থা করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদের জন্য এককালীন অনুদান দেওয়া হচ্ছে তাদের জন্য।
প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি দান করে গঠিত বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের বিভিন্ন সময় বড় অঙ্কের চিকিৎসা খরচসহ প্রতিমাসে আহতদের চিকিৎসা ও আহত নিহতদের সন্তানের শিক্ষার জন্য ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০০৪ সালে এই সহযোগিতার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এখনও তা চলছে। অবশ্য জরুরি অবস্থার সরকারের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণেদিত কারণে তৎকালীন সরকার ট্রাস্টের ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে রাখার কারণে সাময়িক সেই সময় এই সহযোগিতা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। জানা গেছে, ওই সময় জেলে থেকেও দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীর মাধ্যমে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের খোঁজ খবর রাখার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু কন্যা সচ্ছল নেতাদের মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা অব্যহত রখেছেন। পরে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সহযোগিতার কার্যক্রম আবারও পুরোদমে চালু হয়।
বর্তমানে গ্রেনেড হামলায় ভিকটিম শতাধিক ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ বাবদ মাসে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে বলে ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবার ও আহতদের সদস্যদের চাকরিসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। আহত অনেককে মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য করেছেন। কয়েকজন নারী নেত্রীকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করেছেন। অনুদান নিতে আগ্রহী নন এমন অনেককে রাষ্ট্রীয় সফরসঙ্গী করে বিদেশ নিয়েছেন। কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর কোটা থেকে রাজউকের পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে প্লট দিয়েছেন। জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরের ১৫ নম্বরে সরকার একটি ফ্ল্যাট তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার বড় একটি অংশ একুশ আগস্টের ভিকটিমদের দেওয়া হবে।
অনুদানের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাস্টের কর্মকর্তা এস এম কামরুল ইসলাম লিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ এবং আহত নিহতদের পরিবারের ছেলে মেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি হিসেবে প্রতিমাসে তারা বিভিন্ন অঙ্কে টাকা দিয়ে থাকেন। পরিবার প্রতি এর পরিমাণ ২ থেকে ১০ হাজার হবে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্টের মাধ্যমে নিয়মিতই এসব আহত-নিহতদের পরিবারের খবর নেন বলেও জানান লিটু। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবার ও আহতদের নাম ধরে ধরে কে কী অবস্থায় আছে, তার সর্বশেষ খবর আমাদের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। কোনও সময় আহতদের কারও অপারেশন বা চিকিৎসার জন্য বেশি পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী তার তহবিল বা ট্রাস্টের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এ বছর জানুয়ারিতে রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ভিকটিমদের সহযোগিতার কথা জানিয়ে বলেন, আমি এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহেনা উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি পেয়েছিলাম, তা বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে দিয়ে দিয়েছি। এই ট্রাস্ট থেকে আমরা প্রতি বছর ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিচ্ছি। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় আহত ১০৭ জনকে প্রতিমাসে ওষুধ কেনার টাকা দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কৃজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গ্রেনেড হামলায় আহত ধামরাইয়ের সেলিম চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য তার সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। অন্যদের মতো আমিও ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে ছেলে মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি এক হাজার এবং আমার চিকিৎসা খরচ হিসেবে তিন হাজার টাকা পাচ্ছি।
এর বাইরেও বিভিণ্ন সময় তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন উল্লেখ করে সেলিম বলেন, এ পর্যন্ত আমার ১৯ বার অপারেশন করতে হয়েছে। এসব অপারেশনের সময় নেত্রীর থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছি। ঘটনার পর নেত্রীর নির্দেশে আমাকে বিদেশ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছি। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা ওই সময় বিদেশ যাওয়ার মতো ছিল না। তাই দেশেই আমার চিকিৎসা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার মেয়ে এখন এমএ পড়ছে। তার পড়াশোনা শেষ হলে চাকরির জন্য যোগাযোগ করব। নিশ্চয় নেত্রী বিমুখ করবেন না।
লিটন মুন্সির বাবা আইয়ুব আলী বলেন, গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না তখনও শেখ হাসিনা আমাদের সহযোগিতা করেছেন। পরে সরকারে এলে আমাদের ১০ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্র করে দিয়েছেন। এর লাভের একটি অংশ আমার নাতির পড়াশোনার জন্য ব্যয় হচ্ছে। বাকিটা দিয়ে আমাদের সংসার চলছে।
অবশ্য বর্তমান বাজারে এই টাকায় সংসার চলা কষ্টকর উল্লেখ করে লিটনের মা আছিয়া বেগম বলেন, শেখ হাসিনা যেটা করেছেন তার জন্য আমরা খুশি। তবে, আমার নাতির জন্য আলাদা করে যদি কিছু পড়ার খরচ পেতাম এবং সরকারের পক্ষ থেকে যেসব ভাতা গ্রাম এলাকায় দেওয়া হয় তার কিছুটা পেলেও আরও একটু সচ্ছলভাবে চলতে পারতাম।
গ্রেনেড হামলা আহত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেত্রী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য উম্মে রাজিয়া কাজল বলেন, ঘটনার পর ওপারে ছিলেন আল্লাহ আর নিচে ছিলেন আমাদের নেত্রী। তিনি যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে আমাদের মধ্যে অনেকই এখন জীবিত থেকে কথা বলতে পারতাম না। নেত্রীর কারণে আমরা স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছি। তিনি জানান, ঘটনার পর তো তিনি চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছেন। অনেককে এখনও তিনি চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ দিচ্ছেন। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনোর ব্যবস্থা করছেন। অনেক হতাহতের স্বামী, স্ত্রী বা সন্তানদের চাকরি দিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের চাকরি দিয়েছেন। নিজেদের চিকিৎসার দিকে নজর না দিয়ে আগে আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আহত নিহতের কেউ বলতে পারবে না প্রধানমন্ত্রী কিছু করেননি। সন্তানের জন্য বাবা-মা যা করেন তিনি সে রকমই করেছেন।
কাজল বলেন, একুশ আগস্ট আহতদের মধ্য থেকে আমিসহ অন্য একজনকে তিনি সংরক্ষিত আসনে এমপি করেছেন। আগের সংসদেও আহত দু‘জনকে এমপি করেছিলেন। এছাড়া আরও কয়েকজনকে তিনি দলের নমিনেশন দিয়ে নির্বাচিত করেছেন।
/এমএনএইচ/আপ-এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয় যেভাবে
গ্রেনেড হামলার এক যুগ: আর মাত্র দুই সাক্ষী বাকি
কুদ্দুসের পরিবার পালিয়েছিল ৬ মাস
নেত্রীর জীবন বাঁচাতে শহীদ হয়েছিলেন মুলাদীর সেন্টু
জন্মদিনের জামা আনা হয়নি মিথিলার বাবার