শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে ফয়জুর রহমান ফয়জুল নামে এক দুর্বৃত্ত। হত্যার উদ্দেশ্যেই তাকে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশ ও লেখার কারণে এর আগে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছেন। জাফর ইকবালকেও জঙ্গিরা বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভিন্নমত পোষণকারী ড. জাফর ইকবালও কি তাহলে জঙ্গি হামলার শিকার? নাকি সম্প্রতি র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলায় তার ওপর এ হামলা?
ঘটনার পর শাবির ছাত্ররা হামলাকারী ফয়জুলকে গণধোলাইয়ের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর তাকে র্যাবের হেফাজতে নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি।’
শনিবার রাতে র্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘হামলাকারী আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে। সে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। সে কোনও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিনা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য জানা যায়নি। তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
ভিন্নমত প্রকাশ করা ও লেখার কারণে প্রথম হামলার শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির সামনে দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। দেশে কিছুদিন চিকিৎসা দেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানিতে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১১ আগস্ট মারা যান তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুছ আলীকে হত্যা করা হয় ২০০৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। ওইদিন প্রাতঃভ্রমণের সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগেও ১৯৯৬ সালে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার বাসা থেকে নিখোঁজ হন। ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে বাসার পেছনের সেপটিক ট্যাংক থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে হাত-পা বেঁধে জবাই করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলামকে হত্যা করা হয় ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর। ওইদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটরসাইকেলে ক্যাম্পাস সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকার বাসায় ফিরছিলেন অধ্যাপক শফিউল। পথে বিহাসপল্লিতে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল নিজ বাসার পাশে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক শিক্ষককে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবির ও জেএমবি’র জঙ্গিরা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ হত্যার ঘটনায়ও জেএমবি ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের দায়ী করা হয়। পুলিশ, স্বজন ও সহকর্মীরা জঙ্গি ও জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অভিযোগ আনে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নিয়ে সম্প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান জাফর ইকবাল। র্যাগিংয়ের অভিযোগে পাঁচ ছাত্রকে শাস্তি দেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘দায়ী ছাত্রদের পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া জাফর ইকবাল সব সময় জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন। জঙ্গিরা তাকে হুমকিও দিয়েছিল এর আগে।
শনিবার (৩ মার্চ) জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী যুবকের মতাদর্শ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানা যায়নি। ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। মাওলানা আতিকুরের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। বছর দুয়েক আগে তিনি সিলেট জেলার টুকেরবাজার শেখপাড়ায় এসে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। তিন ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে এ বাড়িতেই বসবাস করেন তিনি।
টুকেরবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহীদ আহমদ বলেন, ‘মাওলানা আতিকুর রহমানের তিন ছেলে- আবুল, হাসান ও ফয়জুল। ফয়জুল সবার ছোট। হামলাকারীর পিতা টুকেরবাজারে মুখলেসিয়া মহিলা মাদ্রাসায় চাকরি করেন।’
মাওলানা আতিকুর রহমানের প্রতিবেশীরা জানান, এই পরিবারটি স্থানীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করতো না। এমনকি হামলাকারী ফয়জুল স্থানীয় মসজিদে নামাজও পড়তো না। শনিবার বিকালে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা ঘটনার পরপরই ফয়জুলের পরিবারের সদস্যরা সবাই ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যায়। রাতে ওই বাড়িতে পুলিশ ও র্যাবের তল্লাশির সময় পরিবারের কাউকেই পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এ সময় উপস্থিত ছিলেন শেখপাড়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন। তিনি জানান, র্যাব সদস্যরা তালা ভেঙে ফয়জুলদের ঘরে তল্লাশি চালিয়েছে। তল্লাশিকালে তারা ধর্মীয় বইপত্র ও সিডি উদ্ধার করে। আটকাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে দেওয়া হামলাকারী ফয়জুলের বক্তব্য এবং পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণ ও পালিয়ে যাওয়ার কারণে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এর আগে দেশের বিভিন্ন জায়গার ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলাগুলোর সঙ্গে এই ঘটনার মিল খুঁজে দেখছে র্যাব ও পুলিশ।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি ছিল। সে বিষয়টি মাথায় রেখে ছায়াতদন্ত শুরু করা হয়েছে। হামলার জন্য যে যুবককে আটক করা হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা থেকে সিটিটিসির কয়েকজন সদস্যের সিলেট যাওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
জাফর ইকবালকে সিএমএইচ-এ ভর্তি
ওটিতে ড. জাফর ইকবাল
জাফর ইকবালের চিকিৎসায় বোর্ড গঠন
শাবিতে ড. জাফর ইকবালের মাথায় ছুরিকাঘাত
জাফর ইকবালকে দেখতে শিক্ষামন্ত্রী হাসপাতালে
জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীকে র্যাবে হস্তান্তর
জাফর ইকবালের পেছনেই দাঁড়িয়েছিল হামলাকারী যুবক
হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিলেট যাচ্ছে সিটিটিসি
অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বলছে আ. লীগ, বিএনপি’র দাবি চক্রান্ত
জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভ
জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
জাফর ইকবালকে হত্যার টার্গেটে রাখা হয়েছিল সবসময়: গণজাগরণ মঞ্চ
‘নিরাপত্তার মধ্যে তাৎক্ষণিক সুযোগ পেয়ে জাফর ইকবালের ওপর হামলা করা হয়’
হামলাকারীর বাড়িতে অভিযান শেষ: মামা আটক, বইপত্র-ল্যাপটপ-সিডি জব্দ
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জাফর ইকবালের ওপর হামলা
ফয়জুলের পরিবার দিরাই থেকে সিলেটে আসে ১৫ বছর আগে
‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’
মুক্তমনা মানুষদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার দাবি ঢাবির বর্তমান ও সাবেক ভিসির
‘হামলাকারী ফয়জুল মিশতো না কারও সঙ্গে’
জাফর ইকবাল সিএমএইচে, হামলাকারী র্যাব হেফাজতে