রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় ২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল বিকালে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন যুবলীগের সোনারগাঁও (তেজগাঁও ও শাহবাগ থানা মিলে) ইউনিটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। ওই ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে ববিন ও রবিন নামে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের একযুগ পার হলেও এখনও শেষ হয়নি মিজানুর হত্যার বিচার। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, মামলাটি প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। দুই-এক মাসের মধ্যে মামলার রায় ঘোষণার তারিখ দিতে পারেন বিচারক।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক নজরুল ইসলামের আদালতে যুক্তিতর্ক শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ জুন এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন বিচারক ছুটিতে থাকায় যুক্তিতর্ক হয়নি। এজন্য সংশ্লিষ্ট আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক আগামী ২ জুলাই পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন।
মামলার বাদী ভিকটিমের বাবা মো. খোরশেদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। বড় ছেলে মিজানুর রহমানের মৃত্যু পর আমার পরিবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা খরচ করেও ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। এমন হতভাগ্য বাবা আমি।’
তিনি আরও বলেন, মিজানুরের মৃত্যুর পর কোনও রকমে দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব প্রায়। ছেলের মৃত্যুর সময় তার এক বছরের একটি কন্যা সন্তান ছিল। বাবা ছাড়া মেয়েটি অনেক কষ্টে বড় হয়েছে। যাদের জন্য আমার ছেলেকে হারাতে হয়েছে, তাদের কঠিন শাস্তি দেখে যেতে চাই।’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান ভিকটিমের বাবা খোরশেদ আলম।
ভিকটিমের ছোট ভাই মোশারফ জানান, আমার ভাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতি করতেন তিনি। ওই সময়ে যুবলীগ বা ছাত্রলীগের নেতাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। কিন্তু আমার ভাই প্রকাশ্যে যুবলীগ করায় বিএনপি সমর্থিত লোকজন তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আমাদের একটাই দাবি— আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যেন হয়। প্রকৃতি অপরাধীরা সাজা পেলেই ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান বলেন, আসামিরা শুরু থেকেই পলাতক ছিল। যে কারণে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করতে কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিচার শুরু হতে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। এ মামলায় ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামিরা গ্রেফতার হয়। পরবর্তী সময়ে আসামিদের পক্ষের আইনজীবীরা পুনরায় সাক্ষীদের রি-কলের আবেদন করেন। আদালত সেই আবেদনও মঞ্জুর করেন। এছাড়া সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ঠিকমতো আদালতে হাজির হননি। এসব কারণে মামলাটির বিচার শেষ করতে কিছুটা বিলম্বিত হয় করণ বলে উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী আরও বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সফল হয়েছি। আশা করি, এই মামলায় সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, আসামিরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। ঘটনার সঙ্গে আদৌও তাদের কেউ জড়িত না। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে এজাহারে তাদের নাম এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আশা করছি, মামলার রায়ে তারা খালাস পাবেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ভিকটিম মিজানুর রহমান শান্ত বাসা থেকে বের হয়ে কলাবাগান থানার ৩৭৩/২৭ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পুকুরপাড়ের উত্তর পাশের রাস্তায় পৌঁছালে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আসামি ববিন ও রবিন সহোদর ভাই মিজানুরের গতিপথ রোধ করে। এরপর আসামি ববিন তার হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে ভিকটিমের মাথায় হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করে। এতে মিজানুর গুরুতর আহত ও রক্তাক্ত হন। ভিকটিমের চিৎকারে আশপাশের লোকজনসহ তার বাসার লোকেরা এগিয়ে আসেন। এরপর মিজানুরকে ঢাকা মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ওই ঘটনায় ভিকটিমের বাবা রাজধানীর কলাবাগান থানায় বাদী হয়ে হত্যারচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিজানুর রহমান ওই বছরের ২৯ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা যান। এরপর মামলাটি হত্যার চেষ্টা থেকে হত্যায় রূপ নেয়।
২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামি মো. ববিন ও রবিনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরের বছর ১১ নভেম্বর আসামি বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ-১০ এর বিচারক।
মামলাটির বিচার চলাকলীন ১৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। সহোদর ভাইদের মধ্যে রবিন জামিনে, আর ববিন কারাগারে রয়েছে।