ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের হাতে ছিল। যেকোনও অনিয়মের ঘটনা ঘটলে সেটার দেখভাল করতো ছাত্রলীগ। এ ক্ষেত্রে হল প্রশাসনের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই হলের নিয়ন্ত্রণ আবার চলে যায় শিক্ষার্থীদের হাতে।
এর মধ্যেই গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন তোফাজ্জল। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে যান। মোবাইল চুরির অভিযোগে তারা তাকে এলোপাতাড়ি ও বেধড়ক মারা হয়। এতে তিনি নিহত হন।
এ ঘটনার পর উচ্চশিক্ষালয়টির হল ‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হল প্রশাসনের অবহেলার কারণেই শিক্ষার্থীদের মারধরে তোফাজ্জলের প্রাণ যায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় ফজলুল হক মুসলিম হলের এক সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তিনি হল প্রশাসনের দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার কথা জানিয়ে বলেন, আগে হল প্রশাসন যেকোনও বিষয় ছাত্রলীগের হাতে ছেড়ে দিতো। এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে।
যেভাবে ঘটনার শুরু
এ বিষয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, বুধবার আমাদের হলে একটা টুর্নামেন্ট ছিল, এত বড় টুর্নামেন্ট আগে হয়নি। তাই জাঁকজমকভাবে আয়োজন করা হয়েছিল। সকালবেলা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ছিল। সে সময় সকাল ৬টা ফোন আর কয়েকটা মানিব্যাগ চুরি হয়। কিন্তু তখন চোরকে ধরতে পারেনি, তখন সবাই ক্ষিপ্ত ছিল। এরপর বিকালে আবার ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছিল। সে সময় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী (প্রাণিবিদ্যা বিভাগের) সর্বপ্রথম ‘চোর’ সাব্যস্ত করে তাকে অতিথিকক্ষে নিয়ে যায়। তখন তাকে গেস্টরুমে নিয়ে পেটানো হয়। কিন্তু বেশি মারা হয়নি। এরপর তাকে ক্যানটিনে নিয়ে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে তাকে এক্সটেনশনের অতিথিকক্ষে নিয়ে মারাত্মকভাবে মারা হয়। এতে তিনি মারা যান।
হল সূত্র জানায়, ‘চোর’ সন্দেহে তোফাজ্জলকে ধরা হয়েছে শুনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে হলের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষক অতিথিকক্ষে আসেন কিন্তু তখন শিক্ষার্থীরা তাকে শিক্ষকদের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। পরে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা হলে আসেন। এরপর পাঁচ-ছয় জন শিক্ষার্থী তাকে আহত অবস্থায় শাহবাগ থানায় নিয়ে যান। সেখান থেকে রাত ১২টার দিকে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করলে ওই শিক্ষার্থীরা সটকে পড়েন।
চপ-থাপ্পড় দিয়ে শুরু
মারধরের বর্ণনা দিয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলের এক শিক্ষার্থী জানান, সন্ধ্যায় তোফাজ্জলকে আটকের পর খেলার মাঠ থেকে ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছুটে আসে। তখন তাকে পুরনো বিল্ডিংয়ের অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে তাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, মোবাইল চুরি করেছে কি না। তিনি কয়েকটা নম্বর দেন এবং বলেন ফিরিয়ে দিতে পারবেন। তাদের মধ্যে একটি নম্বরে কল দিলে জানা যায় যে তিনি ‘মোবাইল চোর’। পরে সেই নম্বরটি আর ধরেনি। আরেকটি নম্বর ছিল কোনও এক নারীর। যত নম্বর দিচ্ছিলেন, সব কটিই সঠিক। যে কারণে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মানতে নারাজ ছিল।
প্রাথমিক পর্যায়ে চড়-থাপ্পড়ের পর তোফাজ্জলকে খাওয়া-দাওয়া করানো হয়। এরপর পুরাতন বিল্ডিংয়ের অতিথি পক্ষ থেকে তাকে এক্সটেনশনের অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছু অতি উৎসাহী জুনিয়র, বিশেষ করে ২০২০-২১ ও ২০২১ সেশনের শিক্ষার্থী তাকে বের করে এনে তাকে বেধড়ক মারে। তদন্ত কমিটির প্রাথমিকভাবে যে ৮ জনকে দেখেছে, মোটামুটি তাদের সবাই অভিযুক্ত।
অন্যদের নাম জানতে চাইলে এই শিক্ষার্থী তাদের নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তিনি বলেন, আপনারা অন্য নামগুলো তদন্ত কমিটির কাছ থেকে জেনে নেবেন।
এটিকে তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে চার জনকে থানায় সোপর্দ করেন। তারা হলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জালাল, সুমন, সাকিন ও সাজ্জাদ।
হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রদের হাতে
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় এক সহকারী প্রক্টরের। তিনি বলেন, গত ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে হলের নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের হাতে, তারাই হল নিয়ন্ত্রণ করতো। এখনও ঠিক একইভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে তারা বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি এই পর্যায়ে চলে যাবে, তারাও ভাবেননি।
তোফাজ্জলকে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানান শিক্ষার্থীরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের এক হাউস টিউটর জানান, ঘটনা শুরুর পর তিনি অতিথিকক্ষের বাইরে অবস্থান করছিলেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অভিযুক্তকে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে তুলে দিতে বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অস্বীকৃতি জানান। তারা বলেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার চোর ধরে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে কোনও বিচার হয় না, চুরিও বন্ধ হয় না।
তিনি আরও বলেন, এরপর রাত সাড়ে ৯টার দিকে তোফাজ্জলকে তার হাতে তুলে দিতে একবার বের করেন শিক্ষার্থীরা, পরে আবার তারা অস্বীকৃতি জানান। পরে এক্সটেনশনের অতিথিকক্ষে নিয়ে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়।
প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে দিনভর উত্তাল ঢাবি
তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই প্রতিবাদে উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভোর ৪টায় বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রথমে প্রতিবাদ ও বিচার দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর বেলা ১১টায় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ করেন।
শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল শুরু নিয়ে ফজলুল হক হল প্রাঙ্গণ হয়ে প্রক্টর অফিসের সামনে সমাবেশ করেন। বেলা ১১টায় প্রতিবাদ জানিয়ে জুলাই বিপ্লবীদের ব্যানারে ‘ব্রিং ব্যাক জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেন একদল শিক্ষার্থী।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন একদল শিক্ষার্থী। তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থান নেন
বিষয়টি নিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল করে তারা।
এ ছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সাত দফা দাবিতে প্রক্টর অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল শিক্ষার্থী।
ঘোষিত সাত দফা দাবি
১. প্রমাণসাপেক্ষে গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করতে হবে।
২. ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরদের পদত্যাগ করতে হবে।
৩. এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির অকার্যকর ভূমিকার যথাযথ উত্তর দিতে হবে।
৪. যেকোনও ধরনের মব বা ভায়োলেন্স ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক বিশেষ নিরাপত্তা সেল গঠন করতে হবে।
৫. ক্যাম্পাসের ফুটপাতে অবস্থানকারী উদ্বাস্তু ও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ অপসারণ করতে হবে।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বিধানে প্রক্টরিয়াল বডিকে স্থায়ীভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিকে এই ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করে এর যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ ব্যক্ত করে ১২ ঘণ্টার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হবে।