‘যেসব সবজির দাম বেশি, সেগুলো তো কেনাই বন্ধ করে দিয়েছি। আর যেগুলোর দাম মোটামুটি কম, সেগুলো কম কম করে কিনছি। আগে যদি এক কেজি কিনতাম, এখন কিনি আধা কেজি। পারলে এর চেয়ও কম কিনতাম। কিন্তু না খেয়ে কি আর বাঁচা যায়?’
বাজারের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে হতাশামাখা কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলেন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করা হযরত আলী।
অতিরিক্ত সবজির দাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বাসায় প্রতিদিনই পেঁপের তরকারি, পেঁপেভাজি খাই। কারণ এখন এই তরকারিই সবচেয়ে কম দামি।’
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তারা বলছেন, সবজি ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি দেশে সৃষ্ট বন্যা ও বৃষ্টির অজুহাত দিয়ে উচ্চ দামে বিক্রি করছেন সব ধরনের সবজি। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া সব সবজিই বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। এতে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। খরচ কমাতে কেনাকাটাও কমিয়ে দিয়েছেন সীমিত আয়ের অনেক মানুষ।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর মিরপুর ১-এ কাঁচাবাজারে সরেজমিনে দেখা যায় ঊর্ধ্বগামী বাজারের চিত্র। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবু তাদের মনিটরিংয়েও প্রভাব পড়ছে না কোনও ধরনের পণ্যে।
কেনাকাটা কমিয়েছেন সাধারণ মানুষ
ফার্মাসিটিউক্যালস কোম্পানিতে চাকরি করেন মান্না মেহেদী। প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাজারে এসেছেন তিনি। জানতে চাইলে এই ক্রেতা বলেন, ‘যাদের সীমিত আয়, তারা এখন খরচ কমাতে কম করে কিনছেন। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। আমার নির্দিষ্ট বেতন। এর বাইরে আর কোনও আয় নেই। ওই টাকার মধ্যেই সংসার চালাতে হয়। তাই খরচ কমাতে কম করে কিনতে হচ্ছে।’
আরেক ক্রেতা হুমায়ূন রশীদ বলেন, ‘বাজারে সবজির যেই দাম, এতে আমাদের সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি এখন ভেতর (মূলবাজার) থেকে বাজার না করে রাস্তায় বসা বাজার থেকে কিনি। কারণ এখানে ভেতরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা কমে পাওয়া যায়। এই টাকাও এখন আমার জন্য অনেক কিছু।’
গণেশ চন্দ্র তরফদার বলেন, ‘আমার সংসার খরচ অনেক বেড়েছে। পরিবারে চারজন সদস্য। সবাই বড়। আমরা একজন যে পরিমাণ খাবার খেতাম, তার থেকে তো কম খেতে পারছি না। একই পরিমাণ খাই। কিন্তু একই পরিমাণ জিনিস কিনতে এখন আমার দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। আগে যদি একটা সবজি কেজি ৪০ টাকায় কিনতাম, সেটা এখন ৮০ টাকায় কিনি। এতে আমার খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে। আমাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। আর যারা দিনমজুরের কাজ করেন, তাদের কী অবস্থা হচ্ছে ভাবা যায় না।’
আজকের বাজারের দরদাম
বাজারে ভারতীয় টমেটো ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দেশি গাজর ১৫০ টাকা, চায়না গাজর ১৭০, লম্বা বেগুন ১২০, সাদা গোল বেগুন ১৪০, কালো গোল বেগুন ১৬০ থেকে ১৮০, শসা ৬০ থেকে ৮০, উচ্ছে ১২০, করল্লা ১০০ থেকে ১২০, কাঁকরোল ১০০, পেঁপে ৫০, মুলা ৮০, ঢেঁড়স ৮০, পটল ৮০ থেকে ১৪০, চিচিঙ্গা ৮০ থেকে ১০০, ধুন্দল ৮০ থেকে ১০০, ঝিঙা ১০০, বরবটি ১২০ থেকে ১৪০, কচুর লতি ১০০, কচুর মুখী ৮০, মিষ্টিকুমড়া ৭০ থেকে ৮০, কাঁচামরিচ ৩২০ থেকে ৩৬০ ও ধনেপাতা ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতিটি লাউ ৮০ থেকে ১০০ ও চালকুমড়া ১০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি হালি কাঁচা কলা ৫০ ও হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে।
সবজির দাম গড়ে ২০ টাকা কম-বেশি
গত সপ্তাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, চায়না গাজরের প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। সব ধরনের বেগুনের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, উচ্ছের দাম বেড়েছে ২০, করল্লার দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৪০, পটলের দাম বেড়েছে ২০, চিচিঙ্গার দাম বেড়েছে ১০, মিষ্টিকুমড়ার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা করে। আর প্রতি পিস লাউ ও চালকুমড়ার দাম বেড়েছে ২০ টাকা করে।
এদিকে প্রতি কেজি ভারতীয় টমেটোর দাম কমেছে ৬০ টাকা, শসার দাম কমেছে ২০, ঢেঁড়সের দাম কমেছে ২০, বরবটির দাম কমেছে ২০, কাঁচা মরিচের দাম কমেছে ৪০ থেকে ৮০ ও ধনেপাতার দাম কমেছে ১০০ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য সবজির দাম রয়েছে অপরিবর্তিত।
আকাশচুম্বী দাম নিয়ে বিক্রেতারা বলছেন, কাঁচা সবজির দাম প্রতিনিয়তই ওঠানামা করে। বৃষ্টি আর বন্যার প্রভাবে এখন সবজির দাম বেশি। পরিস্থিতি ঠিক হলেই সবজির দাম কমে যাবে।
আজকের বাজারে আকার ও মানভেদে ক্রস জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। এর মধ্যে ছোট পেঁয়াজ ১১৫ টাকা ও বড় সাইজের পেঁয়াজ ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা করে। এ ছাড়া লাল আলু ৬০ টাকা, সাদা আলু ৬০, বগুড়ার আলু ৭০, দেশি রসুন ২৪০, চায়না রসুন ২১০ থেকে ২২০, চায়না আদা ৩৪০ ও ভারতীয় নতুন আদা ২০০ দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে আদার দাম। চায়না ও ভারতীয় উভয় আদার দামই বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা করে। একই সঙ্গে বগুড়ার আলুর দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা করে। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম রয়েছে আগের মতোই।
দাম বেড়েছে সব ধরনের মুরগির, কমেছে ডিমের
আজকের বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজি ১১০০ টাকা করে। আর বিভিন্ন দোকানে মুরগির লাল ডিম ১৪৪ থেকে ১৫৫ টাকা এবং সাদা ডিম ১৩০ থেকে ১৪৪ টাকা দরে প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে। ওজন অনুযায়ী ব্রয়লার মুরগি ১৯৮ থেকে ২১৫ টাকা, কক মুরগি ৩২০, লেয়ার মুরগি ৩২০, দেশি মুরগি ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
গত সপ্তাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, প্রতি কেজিতে ব্রয়লার মুরগি দাম বেড়েছে ৩ থেকে ১০ টাকা, কক মুরগির দাম বেড়েছে ৩২ থেকে ৪০ টাকা এবং দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে কমেছে মুরগির লাল ও সাদা ডিমের দাম। প্রতি ডজনে মুরগির লাল ডিমের দাম কমেছে ৫ থেকে ৭ টাকা। আর সাদা ডিমের দাম কমেছে ১৬ থেকে ৩০ টাকা।
ডিমের খুচরা বিক্রেতারা জানান, তাদের ডিমের সংকট আগের থেকে কমলেও এখনও আছে।
এ ছাড়া আজকের বাজারে আকার ও ওজন অনুযায়ী রুই ৩৭০ থেকে ৫০০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৫৫০, কালিবাউশ ৪৫০ থেকে ৬০০, চিংড়ি ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকা, কাঁচকি ৫০০ থেকে ৬০০, কই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৮০০, শিং ৫০০ থেকে ৪০০ ও ১২০০, টেংরা ৬০০ থেকে ৮০০, বেলে ৮০০ থেকে ১২০০, বোয়াল ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, কাজলি ১০০০ থেকে ১২০০ ও রূপচাঁদা ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
মুদিপণ্যের দাম অপরিবর্তিত
বাজারে ছোট মুসরের ডাল ১৩৫ টাকা, মোটা মুসরের ডাল ১১০, বড় মুগডাল ১৪০, ছোট মুগডাল ১৭০, খেসারিডাল ১১০, বুটের ডাল ১৪৫ টাকা, মাষকলাই ডাল ১৯০, ডাবলি ৭৫, ছোলা ১৩০, প্যাকেট পোলাওর চাল ১৫০, খোলা পোলাওর চাল মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৫৩, প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫, খোলা চিনি ১৩০, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১১৫ ও খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত শুক্রবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ে আসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ফুয়ারা খাতুন। একই ধারাবাহিকতায় আজও অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের দুই সহকারী পরিচালক রোজিনা সুলতানা ও ফারহানা ইসলাম অজন্তা। এ সময় তারা সবজি, ডিম, মাছ, মুরগির বাজার পর্যবেক্ষণ করেন।
আজ বেশি দামে ডিম বিক্রি করছিলেন আব্দুল জব্বার ডিমের দোকানের বিক্রেতা। হঠাৎ এসে হাজির জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। অভিযান চলাকালে তারা বিক্রেতার কাছে ক্রয় রশিদ দেখতে চান। বিক্রেতা তা দেখাতে না পারায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ছাড়া পাইকারি বিক্রেতা রাজিব পুষ্টি বিতানকে জরিমানা করা হয় ৫০ হাজার টাকা। সরকার-নির্ধারিত মূল্যে ডিম না কেনায় এই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়।