X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সু চির বিজয় কি রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে পারবে?

আনিস আলমগীর
১৭ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৪৭আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৪৮

আনিস আলমগীর গত আট নভেম্বর ২০২০ অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) পুনরায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত হলেও বিরোধী দল ফলাফল মেনে না নেওয়ায় সমস্যা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। কারণ বিরোধীপক্ষ এবং সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ‌্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ফলাফল মেনে নিতে রাজি না, যদিও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল এবং দেশটির নির্বাচন কমিশন এটিকে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলছে। সু চি দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার প্রধান হতে যাচ্ছেন, তাতে সন্দেহ নেই। তবে মিয়ানমারের অদ্ভুত সংবিধানে এমনসব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যার কারণে অং সান সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নামে পরিচিত হতে পারবেন না, তার পদের নাম স্টেট কাউন্সিলর অব মিয়ানমার। 

দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর মিয়ানমারে এটি কার্যত দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মিয়ানমার ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। ২০১০ সালেও অবশ্য একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চির দল। নতুন সংবিধান অনুসারে নির্বাচনে শুধু ৭৫% আসন জনগণের ভোটে পূরণ করা হয়, বাকি ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর জন্য রিজার্ভ। এনএলডি যাতে বৈচিত্র্যময়, বহু-জাতিগত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কখনও ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্যই এমন একটি সংবিধান ডিজাইন করেছিল সেনাবাহিনী। তবে দেখে মনে হচ্ছে এনএলডি এটি সহজেই অর্জন করেছে।

সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সু চির এনএলডি পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য ৩২২টি আসনের চেয়ে বেশি আসন অর্জন করেছে। এনএলডি এ পর্যন্ত ৩৪৬টি আসন জিতেছে। প্রধান বিরোধী দল ইউএসডিপি ২৪টি আসন পেয়েছে। ৪১৬ আসনের পার্লামেন্টের ৪৬টি আসনের ভাগ্য এখনও নির্ধারিত হয়নি। সহসা হবেও মনে হচ্ছে না। ইউএসডিপি সরকারকে ভোটে অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত করেছে, যদিও তারা প্রমাণ দিয়েছে খুব কম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অবাধ, নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছে ইউএসডিপি।

মনে হচ্ছে এনএলডি গ্রামীণ অঞ্চল এবং দক্ষিণ অঞ্চলে তার কয়েকটি শক্ত ঘাঁটি থেকে সেনা- সমর্থিত ইউএসডিপিকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং ইয়াঙ্গুন এবং দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিন্দার ঝড় উঠেছে, এনএলডির জন্য নতুন এই ম্যান্ডেট তা একটুখানি হলেও সামাল দিতে পারবে বলে মনে করছে সু চি-র লাখ লাখ সমর্থকরা।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম ২০১৭ সালে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত। রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রশ্নে সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সু চির ব্যাপক কোনও অমিল নেই।  মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যে একটি গণহত্যা মামলা আনা হয়েছে সু চি সে আদালতে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার পক্ষে সাফাই দিয়েছেন। তার প্রথম মেয়াদকালে, সু চি বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একটি নতুন শান্তি চুক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দেশের রাজনীতিক জটিলতায় হতাশ হয়েছেন। এবারও সু চির দল বলছে জাতীয় ঐক্যের সরকারের পক্ষে তারা কাজ করবে। রয়টার্স জানিয়েছে দলটি ঘোষণা করেছে যে এটি জাতিগত সংখ্যালঘু দলগুলোকে এনএলডির সঙ্গে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে তারা এমন কথা বলেনি।

মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রয়েছে, এরা কেন্দ্রীয় সরকারের তোয়াক্কা করে না। এদের অনেক গ্রুপ অস্ত্রে সুসজ্জিত, অবৈধ ব্যবসা থেকে তাদের রয়েছে যথেষ্ট আর্থিক শক্তি। সে কারণে অঞ্চলগুলোতে তারা সরকারের আধিপত্য মানতে রাজি নয়। এর মধ্যে কয়েক জায়গায় চলমান লড়াইয়ের কারণে নির্বাচন কমিশন সম্ভবত ভোটগ্রহণ বাদ দিয়েছে। উত্তর রাখাইন রাজ্য এবং চীন, শান, কাচিন, কায়িন ও সোম রাজ্য এলাকা এবং বাগো অঞ্চলের এলাকাগুলো নির্বাচন বাতিলের মধ্যে পড়েছে। 

সার্বিকভাবে এই নির্বাচন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। রাখাইন রাজ্য এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারাসহ প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের ভোটদানের অধিকারই ছিল না। দেশটির সাড়ে পাঁচ কোটি জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ মুসলমান এবং তাদের কোনও মূলধারার রাজনৈতিক দল নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নির্বাচনকে ‘মৌলিকভাবে ত্রুটিযুক্ত’ বলে অভিহিত করেছে। 

এর আগের নির্বাচনে ভারত, জাপান এবং সিঙ্গাপুর এনএলডিকে তাদের জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিল। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট পরবর্তী এই বছরের নির্বাচনে এনএলডি এবং সু চি আরও জনপ্রিয় হয়েছে দেখা যাচ্ছে। সু চির বিরুদ্ধে বিরোধী দল ‘বাঙালি-মুসলিম’ (রোহিঙ্গা নাম এরা কেউই উচ্চারণ করে না) প্রীতির অভিযোগ করলেও তাতে কাজ হয়নি। গত পাঁচ বছর ধরে এনএলডি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সাধারণত মৈত্রী সম্পর্ক দেখা গেছে, এমনকি রাখাইন রাজ্যে মুসলিম-সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সামরিক বাহিনীর হত্যাকে সু চি নীরব সমর্থন দিয়েছেন।

এমন একটি বিজয়ের পর এটা কি ধরে দেওয়া যাবে যে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী সরকারের ওপর তার প্রভাব কমাবে? না, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তবে সেনাবাহিনী নির্বাচনি ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট না হলেও না পারতে নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেবে, বিশেষত যেখানে তার পক্ষের এজেন্ট ইউএসডিপি খুবই খারাপ ফলাফল করেছে। অবশ্য নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইং একটি বিবৃতি দিয়ে নানা অনিয়মের জন্য নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন। এনএলডিকেও দোষী করেছিলেন এবং বলেছিলেন সরকারের ‘অগ্রহণযোগ্য ভুলের’ কারণে  তিনি নির্বাচনের ফলাফলটি গ্রহণ নাও করতে পারেন।

রোহিঙ্গাদের প্রতি সু চির আচরণ, মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘনের পর সু চিকে আন্তর্জাতিক শক্তির গ্রহণ করা অসম্ভব ব্যাপার ছিল কিন্তু সদ্য ক্ষমতায়িত এনএলডি সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রাখা ছাড়া বিদেশি সরকারগুলোর কাছে বিকল্প ছিল না। এবারও তেমন পরিস্থিতি। তারপরও সু চি সরকারের ওপর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং বাকস্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা অব্যাহত রাখতে হবে।

সেনাবাহিনী যদি বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে না নেয়, তবে এটি হবে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ। যদি আমরা যুক্তি দেই যে, এনএলডির প্রথম মেয়াদে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে, তারপরও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে সেনাবাহিনী নিজেকে সব সময় মিয়ানমারের রাজনীতির কেন্দ্রে পুনঃস্থাপনের অজুহাত খুঁজে এবং আগামীতেও খুঁজবে। 

আর সব সংঘাত এড়িয়ে মিয়ানমার সরকারকে তার এই ম্যান্ডেট নিয়ে দ্রুত ব্যাপক ভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানবিক সুরক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে। এই নির্বাচনের ফলাফলটি মিয়ানমারের ট্র্যাজিক্যালি বিভক্ত ও দরিদ্র সমাজের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ কমিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করারও সুযোগ এনে দিয়েছে এনএলডিকে। সর্বোপরি সুযোগ দিয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করার। খুব সহসা চীনের মধ্যস্থতায় চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিদেশীয় আলোচনা শুরু হওয়ার কথা আছে। দেখা যাবে অং সান সু চি কতটা আন্তরিক তার দেশের জাতিগত সমস্যার সমাধান করতে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ