X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কে বড়, কে ছোট

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২১ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৫৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সরকারি কর্মীর কর্তব্য কী? উত্তর সহজ। দেশের মানুষের সেবা। তবে বাস্তব চিত্র নিয়ে অনেক অনেক কথা আছে জনমনে। এ দেশে সরকারি অফিসে বা সরকারি কর্মীর কাছে সাধারণ মানুষের সেবা পাওয়ার যত প্রতিবন্ধকতা আছে তার সবই বিরাজমান। ব্যতিক্রম মেনে নিয়েই বলতে হচ্ছে, হয় প্রভাব থাকতে হবে, নয়তো বিত্তশালী হতে হবে, অন্যথায় কোনও সেবাই নাগরিকের প্রাপ্য নয়। অপচয়-বহুল এবং প্রটোকল প্রদর্শনের কর্মসংস্কৃতির মাঝে অবশ্য এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশাও করা যায় না।

আমলাতন্ত্রের অচলায়তন কীভাবে যেকোনও জনবান্ধব উদ্যোগ নষ্ট করতে পারে তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত হয়তো হাজির করা যাবে, কিন্তু এতে কর্মসংস্কতির কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। মুখে আনুগত্যের অভিনয় করে কার্যত সরকারি প্রক্রিয়ার জটিলতার ফাঁদে জনপ্রতিনিধিদেরও হেনস্তা করতে আমলাদের জুড়ি নেই, সেখানে জনগণ তো কোনও বিষয়ই না। ক্ষমতার দম্ভে নাগরিকের প্রতি সরকারি কর্মীর দুর্ব্যবহার এবং উদাসীনতার দৃষ্টান্তও অজস্র। তবু দিনান্তে নীতি ও সেবার জন্য সরকারি কর্মীর ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তাদের সততা, দক্ষতা ও সাহস গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। সেটা অনেকের যে নেই সেটাও অবশ্য বলা যাবে না।  

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও আমাদের সামনে নতুন করে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোভাব ও সংস্কৃতি উপস্থিত করেছে। এক নারী চিকিৎসককে পথ আগলে উচ্চস্বরে তর্ক করছেন বেশ কয়েকজন পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন প্রশাসনিক ব্যক্তি। সরকারি এই চিকিৎসকও কথা বলেছেন মেজাজ খারাপ করে। কে কার চেয়ে বড়, কোন ক্যাডারের ক্ষমতা বেশি তার এক মহড়া দেখলেন দেশবাসী।

পুরো ঘটনাটি সমাজের নানা স্তরে রেখাপাত করেছে। সরকারি কর্মীর ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা দেখানোর তরিকা কী সেটা উঠে এসেছে সাবেক সচিব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক হারুন রশিদের ফেসবুক পোস্টে। বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়েছে। অর্থনৈতিক নানা সূচকে এগিয়ে গেছে দেশ। কিন্তু এত বছরেও প্রশাসন ও সরকারি যন্ত্রে কে বড় কে ছোট, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কে কম গুরুত্বপূর্ণ, কার ক্ষমতা বেশি এসব নিয়ে ঝগড়া শেষ হলো না। এই ফলাফলবিহীন এবং যুক্তিহীন ও অপ্রয়োজনীয় বাহাস ক্ষতিগ্রস্ত করে সাধারণ মানুষকে। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় দেখেছি, আমাদের অনেক সহকর্মী পরীক্ষায় কতজনকে এক্সপেল্ড করেছে, মোবাইল কোর্টে কতজনকে জেল-জরিমানা করেছে, তা নিয়ে বাহাদুরি করতো। আমি পারতপক্ষে এক্সপেল্ড করি না এবং মোবাইল কোর্টের সামারি ট্রায়ালে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ভাষায় কঠোর ন ‘র জন্য আমাকে ভর্ৎসনা করতো তাদের কেউ কেউ। তারা বুঝতে চাইতো না পরীক্ষায় এক্সপেল করা এবং মোবাইল কোর্টে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা নিয়ে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা নেওয়া এবং মানুষকে আইন মানতে অনুপ্রাণিত করা হলো আসল কাজ।’

আরও একটি বক্তব্য তুলে ধরছি বিশিষ্ট সাংবাদিক, ক্র্যাব সভাপতি মিজান মালিকের পোস্ট থেকে। একজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাতে লিখেছেন, ‘ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে উভয় পক্ষেই অসংখ্য যুক্তি দেখানো যাবে। প্রশ্ন হলো আইন কার জন্য? আইনের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য আইন? ৩৪ বছর চাকরি করা একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে আমি শুধু এটুকুই বলবো, আইনের বই হাতে নিয়ে যদি আমরা আইন প্রয়োগ করি তাহলে রাস্তার অর্ধেকেরও বেশি গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। এই তো কিছু দিন আগে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য দেশ আমেরিকায় জজ ফ্লয়েড হত্যা নিয়ে কতই না তুলকালাম ঘটে গেলো। আমেরিকান পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করে যেটুকু জেনেছি তাতে দুষ্কৃতকারীকে এভাবে গলায় হাঁটু গেড়ে আটক করার প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়। তাহলে ওই পুলিশের অপরাধ কোথায়? ও তো প্রশিক্ষণে যা শিখেছে তা-ই করেছে। গতকালকের ভিডিও দেখে অবশ্যই যার যার অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করবেন এতে দোষের কিছু নাই, তবে অফিসে যাতায়াতকালে এবং বাজারে যে দৃশ্য দেখছি তাতে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, একজন অ্যাপ্রন পরা ডিউটি থেকে ফেরা স্টিকার লাগানো গাড়িতে বসা ডাক্তারের পরিচয়পত্র দেখার কি খুব অপরিহার্যতা ছিল? আমরা কি সর্ব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করি? রাত ১২টায় ৩৩ ব্যাচের একজন বিসিএস মহিলা ডাক্তার বাসায় দুটি কন্যাশিশু রেখে ৬০ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা দিয়ে মুগদা মেডিক্যাল থেকে ফার্মগেট নিজ ব্যবস্থায় টেক্সিতে করে যখন বাসায় ফিরে তার নিরাপত্তার বিষয়টি কি আমরা কখনও চিন্তা করি? অন্য ক্যাডারের অফিসাররা কি এভাবে নিজ ব্যবস্থায় সরকারি কাজে যাতায়াত করে? প্রশ্ন অনেক, উত্তর অজানা।’ এখানেই রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি বাতেন মোহাম্মদ বলেছেন,  we should be judicious in our mind.

এটাই প্রশ্ন। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাযোদ্ধা তকমা দিয়ে বিস্তর ঢাক পেটানো হয়েছে। বাস্তবে আমরা কতটা ‘জুডিশিয়াস’ হতে পেরেছি সেটা আরেকবার একটু নিজেদের জিজ্ঞেস করি আমরা। তবে একথাও ঠিক যে, শুধু চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী নন, করোনাকালে আরও অনেকে মাঠে রয়েছেন দায়িত্ব নিয়ে। করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ ছাড়াও মাঠে নেমেছেন পুলিশ-আনসার প্রশাসনের কর্তারা। রয়েছেন সামরিক বাহিনী এবং সাংবাদিকরাও।

সময়টি এখন সমন্বয়ের, পারস্পরিক শ্রদ্ধার আর ভালোবাসার। ক্ষমতা আছে, কিন্তু ক্ষমতার নিকট ঝুঁকে পড়লে দেশ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বাতেন সাহেবের কথাতেই বলতে হয়, ক্ষমতা প্রয়োগের নৈতিক জোরটি তখনই থাকে যখন তার প্রয়োগ জুডিশিয়াস হয়। ভ্রান্ত যুক্তি ও অস্বচ্ছ চিন্তা যেন গ্রাস না করে আমাদের।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ