X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহনে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিকার কি নেই?

মোস্তফা হোসেইন
১০ জুন ২০২১, ১৫:৪২আপডেট : ১০ জুন ২০২১, ১৭:৩৪

মোস্তফা হোসেইন আবারও চলন্ত বাসে তরুণী ধর্ষণ আলোচনায়। এলাকা আশুলিয়া। এখানেও দলবদ্ধ ধর্ষণ। গ্রেফতার হয়েছে ছয় জন। তারপর কী? এটাই কি গণপরিবহনে দলবদ্ধ ধর্ষণের শেষ সংবাদ হবে? নাকি আবারও আমাদের সংবাদে পড়তে হবে, চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ! ধর্ষক গাড়ির চালক ও সহকারী, এলাকা আশুলিয়া কিংবা আশপাশে এবং ভিকটিম গার্মেন্ট কর্মী কিংবা এমনই কেউ।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে ভারতে একটি যাত্রীবাহী বাসে ধর্ষণে এক তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো উপমহাদেশে আলোচনার ঝড় বয়েছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এমন নৃশংসতায়। কিন্তু বছর না যেতেই সংক্রমিত হলো বাংলাদেশও। আমাদের দেশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এক নারীকে বাসের ভেতর চালক, হেল্পার মিলে ধর্ষণ করলো। তারপর থেকে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হলো পরিবহনে নারী নির্যাতনের। একদিকে নির্যাতন-ধর্ষণ পাশাপাশি গ্রেফতার, স্বাভাবিক ঘটনা যেন। বিচারে দুয়েকজনের শাস্তির আদেশও হচ্ছে। যদিও আইনি জটিলতায় অভিযুক্তরা কারান্তরে থাকলেও তাদের শাস্তি কার্যকর হচ্ছে না। অনেকেই রায়ের আগেই জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু থামছে না ওই দুর্বৃত্তরা। বাড়ছে করোনাভাইরাসের মতো।

কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বুঝা যাবে অবস্থার কতটা অবনতি হয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেওয়া ২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৩ মাসে ২১ নারী যাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০২০ সালেও তারা পরিসংখ্যান দিয়েছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৫৯ নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় ৪৪ মামলায় ৯৩ আসামিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালে চাঞ্চল্যকর রূপা দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। বোধ করি সাম্প্রতিক ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে সেটি ছিল ব্যাপকতর। মাত্র ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় হয়েছিল। যেখানে চার জনকে ফাঁসির আদেশ ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। রূপা হত্যা ঘটনা যেমন ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল, তেমনি তার হত্যাকারীদের বিচারের রায়েও তেমনি আলোচনার জন্ম হয়েছিল। মানুষ কিছুটা স্বস্তিবোধ করেছিল। আশা করা গিয়েছিল, হয়তো এবার আর এমন নৃশংসতার খবর হওয়ার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বন্ধ হয়নি গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা।

পরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে অধিকাংশই জড়িত থাকে পরিবহন শ্রমিকরা। ভিকটিমদের অধিকাংশই গার্মেন্ট কর্মী কিংবা নিম্ন আয়ের পরিবারের নারী। ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের এলাকার কথা বিবেচনা করলেও দেখা যাবে সাভার, আশুলিয়া কিংবা কাছাকাছি এলাকাগুলোই বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আশুলিয়া, টঙ্গী কিংবা সাভার এলাকায় হাজার হাজার গার্মেন্ট কর্মীর বসবাস। কাজ শেষে এমনিতেই তাদের পরিবহনের সাহায্য নিতে হয়। দুর্বৃত্তরা সেই সুযোগটিই গ্রহণ করে।

পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে এই প্রবণতার কারণও দেখতে হবে। একজন পরিবহন শ্রমিককে কাকডাকা ভোরে বাসে চড়তে হয় চাকরির প্রয়োজনে। ফিরতে হয় ঘুমের পূর্বক্ষণে। একজন বাস কন্ডাক্টরের জীবন যেন গাড়ির চাকার মতোই। শুধু ঘুরছে। একমাত্র সিগারেটই তার ‘বিনোদন’ মাধ্যম, যা ক্ষতিকর জেনেও তারা গ্রহণ করে। পারিবারিক জীবন বলতে তাদের তেমন কিছু নেই। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা সরকারি ছুটিগুলোও তাদের ভাগ্যে জুটে না। একটানা কাজ করার একঘেয়েমি কাটাতে গিয়ে তাদের খুঁজতে হয় অস্বাভাবিক পথ। দুর্বৃত্তপনা তাদের পেয়ে বসে। এই শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ব্যাপারে মালিক পক্ষ কিংবা সরকার কেউই নজর দেয় না। গণপরিবহনে এসব ঘটনার পেছনের সূত্র হিসেবে বিনোদনহীন জীবনকে দায়ী করলে কি খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে?

গণপরিবহনের কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। তাদের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা মোটিভেশনাল কর্মসূচিরও ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় তাদের দ্বারা অনৈতিক কাজ করা অসম্ভব বলে মনে হয় না। গণপরিবহনে ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনে মানুষ শ্রমিকদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু শ্রমিকদের এই মানসিকতা থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। যে কারণে দুর্বৃত্তপনা বন্ধ হয় না।

গণপরিবহনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু বাস মালিকরা মোটেও কান দিচ্ছে না এদিকটিতে। সরকারিভাবে কোনও নির্দেশনা আছে বলেও জানা নেই। যদিও দুর্বৃত্তদের নিবৃত করার জন্য সিসি ক্যামেরা সর্বতো সহায়ক এমনটা বলা যায় না। কিন্তু কিছুটা হলেও উপকারে আসতে পারে তা বলা যায়।

একসময় বিআরটিসি বাসের কর্মীদের জন্য নিজস্ব পোশাক ছিল। বহু বছর তাদেরও ইউনিফর্মে দেখা যায় না। এই মুহূর্তে সব পরিবহন শ্রমিকের জন্য একই রকম ইউনিফর্ম দেওয়া উচিত। শুধু তা-ই নয়, তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য সবার নেমপ্লেট থাকার বিষয়টিও জরুরিভাবে চিন্তা করা উচিত। একইসঙ্গে চালক হেল্পার কিংবা কন্ডাক্টরদের আইডেন্টি কার্ড সার্বক্ষণিক ঝুলিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করাও জরুরি।

যতটা জানা যায়, বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকদের কোনও ডাটাবেজ নেই কোনও সংস্থা বা দফতরে। যে কারণে শুধু ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনই নয়, দুর্ঘটনা ঘটিয়েও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে তাদের ডাটাবেজ তৈরির বিষয়েও যাত্রী কল্যাণ সমিতি দাবি জানিয়েছিল অনেক আগেই। বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি।
যখনই কোনও পরিবহনে দলবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আর জানাজানি হয়, তখন মামলাও হয়। গ্রেফতার হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে বছরের পর বছর চলে গেলেও বিচারের রায় হয় না। শাস্তি পায় না দুর্বৃত্তদের অনেকেই। রূপা হত্যা মামলার রায় হয়েছিল রেকর্ড সময়ের মধ্যে। অনেকেই আশার আলো দেখছিলেন ওই রায় দেখে। কিন্তু মামলাগুলোর রায় কার্যকর হতে কত বছর লাগবে? কেউ জানে না এর জবাব। অসংখ্য মামলা ঝুলছে গণপরিবহনে দলবদ্ধ ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের। মামলা হওয়া মানেই বিচার নিশ্চিত নয়। মামলা হওয়ার পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে বের হয়ে আসছে। আবার গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত লাগাচ্ছে। যে মানুষটি দেখে ধর্ষণ করেও শাস্তি ভোগ করতে হয় না, সে আবার ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনে যুক্ত হবে না, এটা বলা যায় না।
 
এক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাও আলোচনায় আসতে পারে। নির্যাতনের প্রতিবাদ করার বিষয়টি কঠিন হওয়ার পরও মেয়েদের সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবাদ করলে অনেক সময় পুরুষ সহযাত্রী নারীর পক্ষাবলম্বন করে যৌক্তিক কারণে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করার পর অভিযুক্তকে ক্ষমা চাইতেও দেখা গেছে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্যাতনের শিকার নারী প্রতিবাদ করে না কেন? সেখানেও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। সে জানে বিচার পাওয়া যাবে না। আবার পুরুষ সহযাত্রীরাও যে সব সময়ই এগিয়ে আসবে তারও নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে মুখ বুঝে অত্যাচার সয়ে যাওয়াকেই উত্তম মনে করে তারা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

চূড়ান্ত শাস্তি কার্যকর হলে আশা করা যায় হয়তো এসিড নিক্ষেপের মতো গণপরিবহনেও ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। আইন কার্যকর করার পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তোলা। প্রতিটি বাসে এতদবিষয়ক স্টিকার, পোস্টার যুক্ত করা যেতে পারে। শ্রমিকদের মোটিভেশনাল কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে। এবং তা হওয়া উচিত সরকারি উদ্যোগে এবং গণপরিবহন মালিকদের সহযোগিতায়। তাহলে হয়তো কিছুটা হ্রাস পেতে পারে গণপরিবহনে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ