X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আফগানিস্তানে একটি বাতি বদলাতে ক’জন লাগবে?

ধ্রুব নীল
২১ আগস্ট ২০২১, ২০:৪৭আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২১, ২১:২০

ধ্রুব নীল বৈদ্যুতিক বাতি বদলানো সংক্রান্ত কিছু জোকস পশ্চিমা বিশ্বে বেশ চলে। প্রশ্নটা থাকে এমন—হোল্ডারে একটি নষ্ট বাতি বদলে নতুন বাতি লাগাতে ক’জন লাগে? এ প্রশ্ন করার হেতু হলো অতি সহজ একটি কাজে আমলাতান্ত্রিক বা অন্য সব হাস্যকর জটিলতা বোঝানো। জোকসটা নির্ভর করে বাতি লাগানোর দায়িত্ব কার হবে সেটার ওপর। যেমন ধরুন, একটি বৈদ্যুতিক বাতি বদলাতে ক’জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লাগবে? উত্তরটা হবে—আগে জেনে নিন নষ্ট বাতিটা নিজেকে বদলাতে চায় কিনা। আবার ধরুন, একটি বাতি বদলাতে ক’জন প্রোগ্রামার দরকার? তারা বলবে, সমস্যাটা হার্ডওয়্যার সংক্রান্ত। প্রোগ্রামারের এখানে কিছু করার নেই। সেই সাপেক্ষে যদি বলা হয় আফগানিস্তানে একটি বাতি বদলাতে কী লাগবে? উত্তর—সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি ডলার, ২০টি বছর ও চার জন প্রেসিডেন্ট। তারপরও দেখা গেলো, নষ্ট বাতি বদলে ফের আরেকটি নষ্ট বাতিই লাগানো হলো।

‘বাতি’ বদলাতে না পেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আপাতত এয়ারফোর্সের বিমান পাঠিয়ে হলেও তার ‘ইলেকট্রিশিয়ানদের’ নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। ট্রাম্পপন্থী মার্কিন মিডিয়াসহ সবাই যেভাবে তাকে ইদানীং ছেঁকে ধরেছে, তাতে বাইডেনের আর কী-ই বা করার আছে। সেনা ফেরত আনার গ্রাউন্ড ওয়ার্কটা তো আরও আগেই শুরু হয়েছিল। তিনি শুধু শেষ পেরেকটা ঠুকেছেন। এখন বোরকার মতো দেশটিতে কফিনের দাম না বাড়লেই বাঁচেন।

বাইডেনের দোষ সরাসরি দেওয়াও যাবে না। জরিপে বেশিরভাগ আমেরিকানই বলেছে, আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনাদের ফেরত আনা উচিত (৭০ শতাংশ)। কেনই বা বলবেন না! ট্যাক্সের লক্ষ কোটি ডলার যে এভাবে জলেই যাচ্ছে, সেটা তারা গত কয়েক বছর ধরে ভালোই বুঝতে পেরেছেন।

সুতরাং কিছু দিন আগে ক্ষমতায় আসা বাইডেন এখানে গণতন্ত্রের কথা বলে বেঁচে যেতে পারতেন সহজে। কিন্তু তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলেই যাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হারেনি। আফগানিস্তানের পরিস্থিতিতে মার্কিন বাহিনী তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এমনটাও মানতে নারাজ তিনি।

বাইডেন যা-ই বলুন, নষ্ট বাতি আলো ছড়ায় না। অন্ধকারে ডুবে আছে হাজার হাজার আফগান ও বিদেশির ভবিষ্যৎ। জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে নির্মম মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাটা কতটা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, সেটা বোঝার মতো মেরুদণ্ড এখনও বিশ্বনেতাদের গজায়নি। রাশিয়া আর চীন তাই দেশ ছেড়ে পালাতে চাওয়া আফগানদের নিয়ে টুঁ-শব্দটি করছে না। তারা তাদের অভিসন্ধি নিয়েই ব্যস্ত। কারণ, আফগানিস্তান একদিকে যেমন ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্র, তেমনি আবার বিলিয়ন ডলারের খনিজের ওপরও ভাসছে দেশটি।

এই বিচারে আপাতত যুক্তরাজ্যকে দরদিয়া বলা যায়। আফগান শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে এরইমধ্যে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়ালেসের জন্য ৫০ লাখ পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছে বরিস জনসন সরকার। এ তালিকায় সব আফগান নেই। যারা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অফিসের দোভাষীর কাজ করেছে তাদের জন্যই এ ব্যবস্থা। অবশ্য অন্য একটি স্কিমে ঝুঁকিতে থাকা ২০ হাজার আফগানের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করার কাজও এগিয়ে নিচ্ছে দেশটি। যুক্তরাজ্যের মতো বাকিরা এগিয়ে আসছে না, যুক্তরাষ্ট্র তো নয়ই।

মধ্যপ্রাচ্যে ব্ল্যাকআউট

একটি বাতি বদলানোর মিশনে এসে যুক্তরাষ্ট্র এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে মেঘ ছড়িয়ে দিয়ে গেলো। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র-খ্যাত দেশগুলোর পিঠ বেয়ে এখন ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আল জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দি বাহিনী বুঝে উঠতে পারছে না, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটার পরিণতিও এমন হবে কিনা। আফগান বাহিনীর চেয়ে ঢের শক্তিশালী কুর্দিরাও এখন ঘন ঘন ঘাম মুছছেন।

রাজনীতির সরলরৈখিক সমীকরণ মোতাবেক এখন লেবানন ও ইরাক সরকারের দুশ্চিন্তার আরেক বড় কারণ ইরান। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন ‘পরাজয়’-এর জের ধরে আবার আলোর মুখ দেখতে পারে ওয়াশিংটন-তেহরান চুক্তি। মানে, আফগানিস্তানে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র পেরে ওঠেনি তাই তারা ভবিষ্যতে ইরানের ভেতর নাক গলাতে সাহস পাবে না। আর ইরানও এ সুযোগে নিউক্লিয়ার সমৃদ্ধ হতে থাকবে। যার সুফল ভোগ করবে লেবানন ও ইরাকে থাকা ইরানের ‘বন্ধুরা’।

যদিও ইরাক ও লেবাননে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সমর্থন এখনও চলমান, তথাপি আচমকা তাদের ওপর থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে কতক্ষণ! মোটকথা, যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত পররাষ্ট্রনীতির কথা এখন মধ্যপ্রাচ্যের সব সরকারের মাথাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

চেইন রিঅ্যাকশন

লেবাননের আংশিক পতন কিংবা ‘ঝামেলা’ দেখা দিলেই নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে হিজবুল্লাহ। ততদিন টিকে থাকলে সংগঠনটি নিজেদের মতো করে সরকার গঠনের ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারে।

ইয়েমেনের হুতিরাও অনুপ্রেরণা পেয়ে গেছে ঢের। গত ১৫ আগস্ট হুতির মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদেল সালাম দেশটির সরকারকে পরোক্ষ হুমকি দিয়ে টুইটে বলেছেন, ‘দেখলেনই তো, বিদেশের হস্তক্ষেপ চাওয়াটা হলো এমন একটা অপরাধ, যা আপনাকে কোনও দেশ কিংবা সেনাবাহিনী তৈরি করে দেবে না। উল্টো ক্ষতি, অপমান ও লজ্জা পেতে হবে।’

এটার উল্টো বার্তাও আছে। ওয়াশিংটনের সেনা প্রত্যাহারের ফলে আরব দেশের স্বৈরশাসকদের কাছেও কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেন নীরবে বলে গেলো, তোমরা তোমাদের জনগণকে মারো আর কাটো, তাতে আমাদের আর কিছু যায় আসে না, যতক্ষণ না তোমরা আমাদের স্বার্থে আঘাত না হানছো।

এর ফলে আবার সিরিয়ার বাশার আল আসাদের মতো নেতারাও ভাবতে পারেন, তালেবানের মতো দলও যেখানে আমেরিকার সঙ্গে আপস রফায় চলে আসতে পেরেছে, সেখানে আমরাও তো চাইলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলায় অংশ নিতে পারি।

শূন্যস্থান থাকে না

মহাবিশ্বে থাকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। এ কারণে আফগানিস্তানে যে ইউএস-ভ্যাকুম তথা মার্কিনশূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটা দখল করতে ইতোমধ্যে বাতাসের গতিতে কাজ শুরু করেছে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। আনুষ্ঠানিক সরকার ঘোষণা আসতেই দেখা যাবে স্বীকৃতির জোয়ারে ভাসছে তালেবানরা। বাইডেন কিন্তু কাবুল এয়ারপোর্টের নিয়ন্ত্রণটা তুরস্কের হাতে দিয়ে যেতে পারেনি। এখন তুরস্ক নিজেই আফগানিস্তানে (বিশেষ করে বিমানবন্দরে) বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানাচ্ছে বারবার।

অন্যদিকে ইরান চাচ্ছে তাদের পূর্ব সীমান্তে মার্কিন বাহিনী না থাকুক। রাশিয়াও হাতে নতুন টেক্কা পেয়েছে। আফগানিস্তানকে হাতে নিয়ে সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও খানিকটা চাপে রাখতে পারবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও মাথা নিচু করে রাশিয়া ও চীনকে বলতে হবে, তারা যেন তালেবানকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখে।

বাকি বিশ্বের আপাতত চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। আফগান নারীদের স্বাধীনতা, চাকরি করা, খেলাধুলা করা, আফগানদের মত প্রকাশের অধিকার; আপাতত এসব বাতি ফিউজই থাক।

পরিশেষে আরেকটা জোকস- একটি বাতি বদলাতে ক’জন আশাবাদী লোক লাগে?

উত্তর—মাত্র একজন। তিনি বাতিটা ধরে বসে থাকবেন অনন্তকাল, আর ধরে নেবেন একদিন না একদিন বাকি দুনিয়াটা ঘুরতে শুরু করবে আর বাতিটিও লেগে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
বাজেট ২০২৪-২৫পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ