X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের রাষ্ট্র

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৫০আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৫২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা উন্নয়ন বা অগ্রগতির কোনও অন্ত হয় না। তবে অগ্রগতিকে বহাল রাখতে হয়। দেশের উন্নয়ন কতটা নাগরিকের অগ্রগতি সেটা নিয়ে একটা ভাবনা তো অবশ্যই আছে। তবে এ কথা মানতেই হবে, বস্তুগত উন্নতি শুধু নয়, মূল্যবোধ, চিন্তাধারার উন্নয়নও জরুরি।

কাল আমাদের বিজয় দিবস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর-হায়েনাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী। অপরিসীম ত্যাগ ও উৎসর্গের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন যেকোনও রাষ্ট্রের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ, আর বাঙালির জন্য বিশেষ অর্থবহ।

পঞ্চাশ বছর আগে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করলাম। স্বাধীনতা পেলাম। কে আমাদের সেই স্বাধীনতা দিলো? স্বাধীনতা কি কেউ কাউকে দেয়? গচ্ছিত ধনের মতো অবয়ব ও ওজনদার কোনও বস্তু কি এই স্বাধীনতা, যার বিনিময় সম্ভব? নাকি স্বাধীনতা একটি ধারণা মাত্র, একটি নির্ধারিত পরিসরে, কিছু বিধিবন্ধন সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব? এমন সব প্রশ্নের উত্তর নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আজ বড় প্রয়োজন। পাকিস্তানি শোষণ ও শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার অহংকারই এই দিনটার মূল তাৎপর্য। কিন্তু আমরা সেটুকুতেই আটকে থাকতে চাই না। শৃঙ্খল মুক্তির আলোকে আমরা এগোতে চাই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়, গণতন্ত্র ও মানবিকতার চর্চায়, উদারতার চর্চায়।

১৯৭১-এ আমাদের চাওয়া পাকিস্তান নামের বিপজ্জনক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক এ মানবিক বাংলাদেশ গঠনে। গত ১২ বছরে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের এই শাসনামলে মানুষের মনে তীব্র উন্নয়ন স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন ছিল বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ এবং সেই স্বপ্ন তিনি সফল করেছিলেন। বাঙালি তার নামে যুদ্ধ করে অপরিসীম ত্যাগ ও উৎসর্গের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। এ বছর তার সুবর্ণজয়ন্তী। এমন ৫০ বছর উদযাপন আমাদের জন্য বড় অহংকারের বিষয়।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের হচ্ছে এবং এই করোনা অতিমারির সময়েও বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে খামতি হয়নি। মানুষের মনে মুক্তির আনন্দ এসেছিল ১৯৭১-এ। এখন আছে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য। কিন্তু অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ—এই রকম একের পর এক সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে। বিজয়ের ৫০ বছর এবার উদযাপিত হোক এসব সামাজিক বিষ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।

স্বাধীনতার মূল নিহিত রয়েছে মনোজগতে। স্বাধীনতা মানে জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। কারও কাছে সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, কারও কাছে সামাজিক, আবার কারও কাছে সেটা হতে পারে একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের মননের কাছে এর অর্থ হলো মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা। সমাজ কাঠামোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে নিজের মতো করে বলতে পারা চলতে পারা। বর্তমানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর খুব দ্রুততার সঙ্গে নিয়মিত পাল্টে যাচ্ছে। যেখানে যাদের জোর বেশি সেখানে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের, বিশেষ করে অতি সাধারণ মানুষের জায়গাটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষের রাষ্ট্রে এখন মানুষই এদের ভয়ে চুপসে থাকছে।

যে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন দেশকে পরাধীনতার করাল গ্রাস থেকে বের করার জন্য, যারা এখনও বেঁচে আছেন যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে, তাঁরা হয়তো কল্পনাও করেননি, এমন একটা জায়গায় এসে পড়বে প্রিয় জন্মভূমি, যেখানে মানুষ এত উপেক্ষিত থাকবে।

উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র চর্চার বাইরে যা হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। সেখানে কার কতটুকু দায় আছে সে খেলার চেয়ে বড় চাওয়া সামাজিক সব প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান বিজয় দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, এমন নয়। কিন্তু দিনটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে, যদি প্রত্যেক নাগরিককে এই দিনে নতুন কোনও লড়াইয়ের দিশা দেখানো যায়।

সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের শক্তি জানান দিচ্ছে তাদের কতটা শক্তি সঞ্চয় হয়েছে, কতটা তাদের অগ্রগতি হয়েছে। তারা এমন এক সমাজ চায় যা আলোর চেয়ে বেশি পছন্দ করে আইএস-এর সহিংসতা বা তালেবানি উন্মাদনা। তারা জঙ্গিবাদের চর্চা করে, বিদেশি হত্যা করে, লেখক ব্লগার হত্যা করে, তারা পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলে। এমতাবস্থায় বড় দাবি, বড় চাওয়া, মানুষ আরও বিজ্ঞানমনস্ক হোক। কিন্তু সেটাও করতে গেলে শাসন প্রণালির ভেতর মানুষের ভাবনাটা আসা জরুরি। 

আজ আমাদের রাজনীতি চর্চায়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় সর্বত্র সামাজিক বিষগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান থাকা জরুরি। বিজয় অর্জন করেছি, নানা কারণে সব আদর্শ ও লক্ষ্য ধরে রাখতে পারিনি। সেখানে ফিরে যাওয়ার একটা বার্তা থাকা জরুরি। নতুন নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা আরও বাড়িয়ে তোলাই এখনকার এক নতুন সংগ্রাম।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও ২-৩ দিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবনের আগুন লাগা এলাকা
আরও ২-৩ দিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবনের আগুন লাগা এলাকা
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা চালাতে ওআইসির সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা চালাতে ওআইসির সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
লাপাতা লেডিস: বিস্ময় জাগানো কে এই তরুণ
লাপাতা লেডিস: বিস্ময় জাগানো কে এই তরুণ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে পুরস্কার পেলো সানশাইন ব্রিকস
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে পুরস্কার পেলো সানশাইন ব্রিকস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ