X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘কিছুই করা’ মানে কি জ্বালাও-পোড়াও?

গোলাম মোর্তোজা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:১৯আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:২২

গোলাম মোর্তোজা ‘কিছুই তো করতে পারলেন না’- মাঝেমধ্যেই কথাটি শুনতে হয়। ‘সরকার তো রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করেই ফেলল, আনু মুহাম্মদরা তো ঠেকাতে পারলেন না’- সুনির্দিষ্ট করে এমন কথাও বলেন কেউ কেউ।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন, কিছু করতে পারা, না পারা বিষয়ে কিছু কথা।
১. ‘কিছুই করতে পারলেন না’- বলতে আসলে কী বোঝানো হয়? আন্দোলন করছে ‘তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। ‘কিছু করা’ বলতে তাদের কাছে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে আর জাতীয় কমিটি কী করছে? জাতীয় কমিটি তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হলে, সুন্দরবন ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখে পড়বে। তারা সভা-সমাবেশ করেছেন, লংমার্চ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সুন্দরবনের গুরুত্ব, রামপালের ভয়াবহতার দিকগুলো তুলে ধরেছেন। সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, দেশের এত বড় ক্ষতি করবেন না। সবই করেছেন, করছেন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। দেশের প্রায় সকল স্বীকৃত শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞ জাতীয় কমিটির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন। যাদের অনেকে সরাসরি জাতীয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সুপরিচিত পরিবেশ ও বণ্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান থেকে ভূ-তত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম পর্যন্ত।
২. জনমানুষ, যারা রামপালের ক্ষতি বিষয়ে জানতেন না, তারা জেনেছেন বুঝেছেন। আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। দেশব্যাপী রামপাল বিরোধী একটি গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। জনসম্পৃক্ত বিষয় থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকা বিএনপি অনেক দেরিতে হলেও রামপাল বিরোধী অবস্থান নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে সরকারিভাবে যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তিনি তার ভিত্তিতে কথা বলেছেন। ফলে জনমানুষের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেনি তার কথায়। প্রধানমন্ত্রী জনমানুষের কথা না বললেও, জনমানুষের অবস্থান যে রামপালের বিপক্ষে তা প্রমাণ হয়েছে। তাহলে কি বলা যায় যে, জাতীয় কমিটি ‘কিছুই করতে পারল না’?
জাতীয় কমিটি জনমানুষের সামনে ভয়ংকর ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরতে চেয়েছে এবং পেরেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাসী বাঙালিরাও বিষয়টি উপলব্ধি করে প্রতীকী প্রতিবাদ করছেন। এই অর্জন কি ‘কিছু করা নয়’?

সরকারের দেওয়া প্রতিটি তথ্য, তথ্য দিয়ে অসত্য প্রমাণ করেছেন জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ। এটা কি ‘কিছু করা নয়’?

৩. ‘কিছু করা’ বলতে যদি বোঝানো হয়ে থাকে যে জাতীয় কমিটি আন্দোলনের নামে সরকারি সম্পদ ধ্বংস করেনি, গাড়ি পোড়ায়নি, ভাঙচুর করেনি, স্কুল-কলেজে ধর্মঘট ডাকেনি...। তাহলে মানতেই হবে যে, ‘কিছু করেনি’ বা ‘কিছুই করতে পারল না’!

বাংলাদেশে সাধারণত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির আন্দোলন হয় ধ্বংসাত্মক, জ্বালাও পোড়াও পদ্ধতিতে। জাতীয় কমিটি তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল নয়। যদিও জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ সবাই কোনও না কোনওভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাম ধারার রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের আন্দোলনের শক্তি। জাতীয় কমিটি তো জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের নীতিতে বিশ্বাস করে না। তারা যুক্তি-তর্ক-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করেন। সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে অসত্যের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের হাতিয়ার তথ্য-প্রমাণ, লাঠি-পেট্রোল বোমা নয়।

৪. বলা হবে, এশিয়া এনার্জি বিরোধী ফুলবাড়ী আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলন একটা পর্যায়ে গিয়ে সহিংস হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, সহিংস হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার গুলি করে মানুষ হত্যার পর।  ফুলবাড়ী আন্দোলনের এলাকাভিত্তিক শক্তি প্রবল ছিল। এলাকার মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সরকারি জুলুমের বিরুদ্ধে। একইভাবে রাজশাহীর কানসাট আন্দোলন, আড়িয়াল বিলের বিমানবন্দর বিরোধী আন্দোলন করেছিল মূলত এলাকার জনমানুষ। সে কারণে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধটা দৃশ্যমান হয়েছিল। কারণ ফুলবাড়ী, কানসাট, আড়িয়াল বিল এলাকায় মানুষ বসবাস করেন। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল মানুষ।

রামপালে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দবন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য স্থল-জলজপ্রাণী। এর প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষ।
সুন্দরবনের গাছ-বাঘ-হরিণ-কুমির-ভোদর-মাছ-কাঁকড়া-সাপ তো মানুষের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না। তাদের পক্ষ হয়ে জাতীয় কমিটি প্রতিবাদ করছে। জাতীয় কমিটির আন্দোলন বিষয়ে এক সাংবাদিক বড় ভাই লিখেছেন, হিংস্র বাঘ, বিষাক্ত সাপের... পক্ষে আন্দোলন, মানুষের পক্ষে নয়। বড় ভাই বিনয়ের সঙ্গে বলি, বাঘ-সাপ হিংস্র নয়। তারা মানুষের সম্পদ ধ্বংস করে না। হিংস্র বিষাক্ত হচ্ছে মানুষ। তারা বাঘ-সাপের জীবন ধ্বংস করে। বাঘ-সাপকে দেখে মানুষ যতটা ভয় পায়, মানুষ দেখে বাঘ-সাপ তার চেয়ে বহু গুণ বেশি ভয় পায়। তাহলে হিংস্র কে?

বাঘ-সাপ বাঁচিয়ে রাখলেই মানুষ উপকৃত হয়, তাদের ধ্বংস করলে ক্ষতি মানুষেরই হয়।

মানুষ যাতে বৃহত্তর ক্ষতির মুখে না পড়ে, সে কারণেই জাতীয় কমিটির প্রতিবাদকে দেশের মানুষ সমর্থন করছেন। সরকার ক্ষমতার দাপটে সেই প্রতিবাদ গ্রাহ্য করতে চাইছেন না। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের চরিত্রহননের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে এনে সুবিধা করতে পারেননি। জনগণের অর্থে জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে অসত্য তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন। তাতেও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। ‘বিশ্বাস’ এবং ‘আস্থা’ রাখতে বলছেন- কোনও যুক্তি দিতে না পেরে। আস্থা তো দূরের কথা, জনগণ তাদের কোনও কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না। ক্ষমতার জোরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে ফেলতে চাইছে সরকার।

৫. দেশের মানুষ- প্রবাসীদের ছাড়িয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোও সুনির্দিষ্ট করে বলছে, রামপালের কারণে ক্ষতি হবে সুন্দরবনের। ইউনেস্কো বলেছে সরকার যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়, সত্য নয়। এতদিন ধরে দেশের মানুষ এবং সরকারের উদ্দেশ্যে জাতীয় কমিটি যা বলেছে, ইউনেস্কোও তাই বলছে। সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা খেপেছেন ইউনেস্কোর প্রতি। তাদের কথায় মনে হচ্ছে, ইউনেস্কো সম্ভবত জাতীয় কমিটির অঙ্গ সংগঠন! এখন ইউনেস্কো খুব খারাপ সংগঠন!! কেন তারা আমাদের সুন্দরবন নিয়ে কথা বলবে, তারা কথা বলার কে? ইত্যাদি প্রশ্ন তুলছেন। এই বাংলাদেশে জাতিসংঘ বা ইউনেস্কোর গুণগান কারা করেছেন, কারা করেন? ইউনেস্কো যখন শান্তি পুরস্কার দেয়, তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। জাতিসংঘের দেওয়া পুরস্কারও আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরস্কার দেওয়া অনুষ্ঠানে ‘জাতিসংঘের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন’ তাও আমরা গর্বের সঙ্গে বলি, প্রচার করি।

হঠাৎ করে জাতিসংঘ, ইউনেস্কো এতটা খারাপ হয়ে গেল কেন? কারণ তারা সত্য বলছে। যা সরকারের পক্ষে যাচ্ছে না। সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শুধু খারাপ বলার মধ্যেই সীমিত থাকছে না! ইউনেস্কোর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের তুলনাও করা হচ্ছে!!

৬. আইয়ুব খানের ‘গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন’র ভূত বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপেছে। আইয়ুব খানদের বিরুদ্ধে বাঙালি সশস্ত্র আন্দোলন করে স্বাধীন হয়েছে। এখন দেশ পরিচালনা করেন বাঙালিরা। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বা ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করা উচিত নয়। জাতীয় কমিটি তা বিশ্বাস করে, নেতৃবৃন্দ হৃদয়ে তা ধারণ করেন। সেই বিশ্বাসের থেকেই নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি অনন্য নজীর তৈরি করেছেন জাতীয় কমিটি। দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন। সরকার জেগে ওঠা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে রামপাল থেকে ফিরে আসবে, না ক্ষমতার দাম্ভিকতায় দেশ ও সুন্দরবন ধ্বংসের উদ্যোগের দিকে এগিয়ে যাবে? আগুন না জ্বালালে, সম্পদ ধ্বংস করে বাধ্য না করলে, সরকার জনগণের নায্য দাবির প্রতি কর্ণপাত করবে না- এই কী সরকারের নীতি? সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে। ইতিহাস সেভাবেই মূল্যায়ন করবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এ বছর পুলিৎজার পেলো ৩ সংবাদমাধ্যম
এ বছর পুলিৎজার পেলো ৩ সংবাদমাধ্যম
মনজিল হত্যা: সৎমা-ভাইসহ ৬ জনের যুক্তিতর্ক অব্যাহত
মনজিল হত্যা: সৎমা-ভাইসহ ৬ জনের যুক্তিতর্ক অব্যাহত
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
লিটনের পর দ্রুত ফিরলেন শান্ত
লিটনের পর দ্রুত ফিরলেন শান্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ