X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিচার চাই’

রুমীন ফারহানা
২৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৩আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৭

রুমীন ফারহানা গত ২১ নভেম্বর থেকে দু'তিন দিনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে ছিল নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনারা'র ব্যাগ চুরির খবর। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে যান লিওনি কুলেনারা। এক পেশাদার চোর চুপটি করে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রদূতের আসনের ঠিক পেছনে। রাষ্ট্রদূত অনুষ্ঠান উদ্বোধনের জন্য চেয়ার থেকে ওঠার সময় যখন ব্যাগটি সেখানে রেখে যান এবং অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ‘এলেমদার চোর’ তখন কৌশলে ব্যাগটি নিয়ে সোজা চলে যায় বসুন্ধরা সিটিতে। তারপর সেই হাতব্যাগে থাকা দুটি মোবাইল ফোন, একটি আই প্যাড, তিনটি পাসপোর্ট এবং কিছু বিদেশি মুদ্রা বিক্রি করে দেয় নগদ দশ হাজার টাকায়। চোর তারপর খালি ব্যাগটি মার্কেটের নিচে ফেলে দেয় যার সূত্র ধরে ধরাও পড়ে সে এবং তার সহযোগী।
এক্ষেত্রে বলা যায় যে ঘটনা ঘটার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে অপরাধীরা। পুলিশবাহিনী এক্ষেত্রে বাহবা পেতেই পারে তাদের দ্রুত এবং সফল অভিযানের জন্য। এই ছোট্ট ঘটনাটিতে একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট যে আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সত্যিকার ভাবে চাইলে দ্রুতই অপরাধী সনাক্ত করতে এবং ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে তাদের সেই আন্তরিকতা, সদিচ্ছা আর চেষ্টা থাকতে হবে। একই ধরনের সফল তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করেছি রাজন, রাকিব সহ বেশ কয়েকটি শিশু নির্যাতনের ঘটনাতেও। তবে তার অর্থ এই নয় যে সকল ঘটনাতেই শতভাগ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। সেটা কেউ আশাও করে না। পৃথিবীর কোনও দেশে কোনও কালেই তা হয়নি। কিছু ঘটনা চিরকালই ক্লুলেস থেকে গেছে যার রহস্য উদ্ঘাটন কোনোকালেই সম্ভব হয়নি। তবে উন্নত সভ্য রাষ্ট্রে এই কাজে নিয়োজিত বাহিনী অন্তত তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনবার। আর সেটাই তাদের কাজ। তাই সেসব দেশে ‘বিচার চাই’ কথাটিও খুব একটা শোনা যায়না যেমনটি কিনা হরহামেশাই শোনা যায় আমাদের দেশে।
আইন অঙ্গনে কাজ করবার সুবাদে ‘বিচার চাওয়া’ বিষয়টি সবসময়ই আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। বিচার চাইতে হবে কেন? বিশেষ করে ফৌজদারি অপরাধ বা criminal offence হলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এ কারণেই ফৌজদারি অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে মামলা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম অমুক’। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে অপরাধ তার ব্যবস্থা তো রাষ্ট্রের স্বপ্রণোদিত হয়েই নেওয়ার কথা। তারপরও বিচার চাইবার প্রয়োজন হয় কেন? প্রয়োজন হয় কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল, ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক সময়ই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না। এক ধরনের জবাবদিহিতার সঙ্কটও কাজ করে। একটি সুস্থ রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নিয়ম হলো কোন অপরাধ সংঘটনের সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তদন্ত করবে, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনবে, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় বিচার হওয়ার পর তার সাজা হবে। এখানে বিচার চাইবার কোনও সুযোগ নেই। সুস্থ সবল রাষ্ট্রকাঠামোতে এটি আপনা থেকেই হওয়ার কথা এবং হয়ও। কিন্তু যে দেশে সামান্য একটি জিডি করতে বা মামলা দায়ের করতে সাধারণ মানুষকে নানান সম্ভব/ অসম্ভব ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেখানে বিচার পাওয়া তো একটা বিশাল ব্যাপার বটেই।

আজকাল কোনও ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চায়। বিষয়টি একদিকে যেমন হৃদয়বিদারক অন্যদিকে তেমনি পরিবারটির অসহায়ত্ব, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রতি তীব্র অনাস্থা এবং সর্বোপরি প্রশাসন ও বিচারবিভাগের অকার্যকর অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান, সরকার পরিচালনা তার কাজ। তার কাজতো ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা নয়। আইন, আদালত, পুলিশ তাহলে আছে কেন? তদন্ত করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার করবে আদালত। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আসলেন কোথা থেকে? তাহলে কি বিষয়টি এমন যে সরকারের সব্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না আশ্বস্ত করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর অন্যায়ের কোনও বিচার হবে এই ভরসা বা বিশ্বাস পায় না? তবে অতীতে বহুক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সেই আশ্বস্ততা মিললেও বিচারের দেখা মেলেনি, যা দুঃখজনকই শুধু নয় জাতির জন্য শংকাজনকও বটে।

আজকের এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি, একদিনে এ থেকে উত্তোরনও সম্ভব নয়। আইন, বিচার ও প্রশাসনকে রাজনীতিকরণের যে দীর্ঘ সংস্কৃতির ধারা চলে আসছে এবং বিগত কয়েক বছরে তেলে জলে আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তার একটি বড় ভূমিকা আছে এধরনের বিচারহীনতার পেছনে। প্রশাসনিক নিয়োগে দলীয় প্রাধান্য, পদন্নোতিতে দলীয় বিবেচনা, সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, যোগ্যতার ওপর দলীয় পরিচয় বড় হয়ে ওঠা, নিয়োগে ঘুষ, পদন্নোতিতে ঘুষফান্ড, সর্বত্র দলীয় লেজুড়বৃত্তি এসবই আজকের এই ‘বিচার চাই’ সংস্কৃতির জন্য দায়ী। এতকিছুর পরও যদি প্রশাসন কিছুটা অন্তত রাজনৈতিক চাপ মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত তাহলে হয়তো ‘বিচার চাই’ ধ্বনি কিছুটা হলেও ক্ষীণ হত। স্বাধীনতার এত বছর পরে মাননীয় প্রধান বিচারপতির হতাশা মাখা কণ্ঠ যখন নির্বাহী বিভাগের বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্বের চেষ্টাকে স্পষ্ট করে তোলে তখন ‘বিচার চাই’ বলা ছাড়া আর উপায়টাই বা কি থাকে।
আমরা সবাই সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা সর্বদাই বলে থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই বিষয়গুলো সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক আমরা? ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। বিচারবিভাগ সহ সাংবিধানিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাতে কারা নিয়োগ পাবেন, কী হবে তাদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতা, তাদের যোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠিই বা কী হবে এ বিষয়ে আজ অবধি কোনও আইন বা নীতিমালা আমরা প্রণয়ন করতে পারিনি। সাংবিধানিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত রাখার মানসিকতা থেকে আজ অবধি এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে আগ্রহী হয়নি কেউ। যে কারণে কথায় কথায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিতর্কিত হয় কিন্তু একটি বার আমরা চিন্তা করিনা বিতর্কিত এই সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কখনোই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সুশাসন বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা আজও শুরুই করতে পারিনি আমরা। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করে আর যাই হোক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর এককেন্দ্রীক শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে যতদিন পর্যন্ত না সুশাসন কায়েম করতে সমর্থ হবো ততদিন পর্যন্ত অসহায়ের এই ‘বিচার চাই’ সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে ভবন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সিলেটে ভবন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ