X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসনে পদোন্নতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:১৭আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:২১

একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ছ’মাসের ব্যবধানে ৫৩৬ জনকে অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপ-সচিব করা হয়েছে। আমাদের জনপ্রশাসনের ওপরের দিকটা আরেক দফা ভারী করা হলো। এর আগে মে মাসে ২১৭ জনকে এবং গত বছর ৮৩৭ জনকে একইভাবে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। সর্বশেষ এই পদোন্নতির ফলে এখন অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা এখন ৫৫০ জন, যদিও অনুমোদিত পদ মাত্র ১২০টি। ৩৫০ অনুমোদিত পদের বিপরীতে এখন যুগ্ম-সচিবের সংখ্যা ৬১৩ এবং ৮৩০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে উপ-সচিব এখন প্রায় দেড় হাজার। বলা হচ্ছে আরও পদোন্নতি অপেক্ষা করছে।
সচিবালয়ের বারান্দায় বারান্দায় যখন উচ্ছ্বাস, তখন আবার বিপরীত কথাও শোনা গেলো। জনপ্রশাসনের তিন স্তরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার পরও একটা চাপা ক্ষোভ মৃদুস্বরে উচ্চারিত। গণহারে পদোন্নতি দেওয়ার পর কেউ কেউ তৃতীয় বা চতুর্থ দফায়ও পদোন্নতিবঞ্চিত থেকে গেছেন বলে অভিযোগ আছে।
দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু এ ধরনের পদোন্নতি ঢালাওভাবে দেওয়া। এতে অনেক সময়ই মেধা আর যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা হয় না। তার অর্থ এই নয় যে, এই বিরাট সংখ্যক কর্মকর্তাদের সবাই অযোগ্য। কিন্তু নির্ধারিত পদের বিপরীতে যদি বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা পদ নিয়ে বসে থাকেন, তা কেবল সরকারি অর্থের অপচয় নয়, পদ প্রাপ্তদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
আত্মীয়করণ, দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে জনপ্রশাসনে নানামুখী সংকট সৃষ্টি হয়। হচ্ছেও তাই। এর ফলে জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। সুদক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করে না। আধুনিক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র প্রশিক্ষিত প্রশাসক এবং কর্মীদের একটি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। যার মাধ্যমে যুক্তিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


যেকোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেশি হলে সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মাথাভারী কথাটা সে কারণেই বলা হয়। কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে, কতটা সুস্থভাবে কর্মী পরিচালনা করা যাবে, সেটিই হবে এক বড় কাজ এখন সরকারের। অনুমোদিত আকারের চেয়ে বড় প্রশাসন মানেই সিদ্ধান্ত প্রণয়নে বিলম্ব, অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়া, যা প্রবৃদ্ধির প্রকৃত অন্তরায়।
গণহারে পদোন্নতি হচ্ছে অনেক বছর ধরেই। ফলে দেখা যায় পদোন্নতি দেওয়ার পরও অনেককে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আগের পদে বহাল রাখা হয়েছে। সেভাবেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতি কতটা মর্যাদার একজন কর্মকর্তার জন্য? নাকি এসব কর্মকর্তা আসলে পদোন্নতিই চান, মর্যাদা নয়?
দেশে একটি জনমুখী, গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের বিকল্প নেই। আমরা দেখছি শাসক বদলায়, শাসক দলের কাঠামো এবং আচরণ-পদ্ধতিও অনেক সময় বদলায়। কিন্তু প্রশাসনের ওপর দলীয় প্রভুত্বের সংস্কৃতি বদলায় না। যখন যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, তারা নিজেদের পছন্দের লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসীন করে। তা করতে গিয়ে প্রায়ই জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা, এমনকি সততার প্রতি অবমূল্যায়ন করা হয়। তবে যে অভিযোগটি ভয়ঙ্কর, সেটি হলো এত আনুগত্য বাছাইয়ের পরও অনেকেই অভিযোগ করছেন, বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীত আদর্শের কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পান লবিং আর সখ্যের জোরে।
বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় ওএসডি হিসেবে থাকেন, যাদের কোনও কাজকর্ম থাকে না অথচ বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হয়। আর আছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতি। এ সবই নির্দেশ করে, জনপ্রশাসন কতটা জড় হয়ে আছে।
প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনের কর্মকাণ্ডই সরকার তথা দেশকে সচল রাখে। সেই প্রশাসনই যদি এমন একটা কাঠামোর মধ্যে পড়ে যে বড় সংখ্যক অফিসারের কাজ থাকে না, যেখানে যাকে প্রয়োজন, সেখানে তাকে দেওয়া যায় না, তাহলে দেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
দেশ শাসনে এখনও আমরা ঔপনিবেশিক কাঠামো অনুসরণ করছি। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকারি প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের চেয়ে আমলারাই সব সময় মুখ্য ভূমিকায় থাকেন। দীর্ঘ মেধাচর্চা, কঠোর শ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তববাদী প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ গঠন ও সংস্কারে তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস, এসব গুণাবলিই নাকি থাকতে হয় সরকারি কর্তাদের। আর এজন্যই তাদের বলা হয় আমলা।
কিন্তু আজকাল কি খুঁজে পাওয়া যায় এমন আমলা? আমলাতন্ত্র এখন সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বের পূজারী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এই আমলাতন্ত্র। ফলে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির সাধারণ অভিযোগ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লেগেই আছে। দেশের সেবা করার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোতেই নজর বেশি একটি বড় অংশের। দুর্বল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা এমনটি করে। প্রশাসনের গতিশীলতার পরিবর্তে দেখা যায় আমলান্ত্রিক জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। অন্য দিকে নিয়োগ পদোন্নতি নিয়ে দলাদলি গ্রুপিং লবিং।
প্রশাসন নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচিত বিষয় হচ্ছে পদোন্নতি ও পদবঞ্চনা। সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন রয়েছে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রধান করায় সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। একেকটি পদোন্নতির ঘটনা তাই প্রশাসনের গতি আনার পরিবর্তে সৃষ্টি করছে জটিলতা। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যায়ন পেয়ে অনেকে হাওয়ায় ভাসেন। অনেক সময় তারা পদের প্রতি সুবিচার করতে পারেন না। অর্থাৎ নিজের প্রতি অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারেন না। অন্য দিকে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিটি সঠিক সময় মূল্যায়ন না পেয়ে কাজের প্রতি উৎসাহ হারান। ফলে প্রশাসনে সৃষ্টি হচ্ছে স্থবিরতা।
বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে বলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে জোর প্রচারণা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথমে মধ্যম আয়ের দেশ, এরপর উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য একটি সময়কে সামনে রাখা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে উন্নয়নের রাস্তায় এখনও আমরা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। আগে সরকারি প্রশাসনের কাজে গতি আনতে হবে। সে জন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। এখানে পদোন্নতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কর্মকর্তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করবে এটা এখন আর প্রত্যাশিত নয়। আর তা নয় বলেই রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঘুণগ্রস্ত প্রশাসনিক কাঠামোটি তাদের জন্য এমনটাও ভাবেনা দেশবাসী। সিস্টেমের দুর্বলতার কারণেই সেবক পায় না, শুধু প্রশাসক পায়।

 

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
সাত দিনে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদফতর
সাত দিনে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদফতর
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ