পশ্চিমবঙ্গের কন্যাশ্রী প্রকল্প রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরস্কার পেয়েছে। বড় আনন্দের খবর। অনেকে হয়তো জানেন না কন্যাশ্রী প্রকল্পটা কী। কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকে দুটি ধাপে টাকা দেওয়া হয় রাজ্যের মেয়ে পড়ুয়াদের। প্রথম ধাপে বছরে ৭৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেই ছাত্রীদের এই টাকা প্রাপ্য। দ্বিতীয় ধাপে এককালীন দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ছাত্রীর বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর। কন্যাশ্রী প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের টাকা খরচের পদ্ধতি নিয়ে কোনও শর্ত চাপায়নি সরকার। এই সুযোগে প্রকল্পের এককালীন ২৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে মেয়ের বিয়ে দিতে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকায় মেয়ের বিয়ে দেওয়াকেও ভোটের ময়দানে হাতিয়া করেছে তৃণমূলের কর্মীরা। নির্বাচনি প্রচারণায় দেখাচ্ছে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বলছেন—‘কন্যাশ্রীর পঁচিশ হাজার টাকা না পেলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম না’। সরকারি দলের কর্মীরা এইটুকু জানে না যে বিয়ের পণ দেওয়ার জন্য কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা নয়! কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা মেয়েদের পড়াশোনার জন্য, স্বনির্ভরতার জন্য। কিন্তু এই টাকা যাচ্ছে অসৎ এবং লোভী পুরুষের হাতে বরপণ হিসেবে। পণ দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই আইনত অপরাধ। মেয়েদের জন্য ভালো কাজের বদলে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে মন্দ যে কাজ, পণ দেওয়া, মূলত সেটিই করা হচ্ছে প্রকল্পের টাকা দিয়ে। ভুলে গেলে চলবে কী করে, মেয়েদের স্বনির্ভরতার চেয়ে মেয়েদের পরনির্ভরতার গুরুত্বই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেশি। কোথায় মেয়েরা পড়াশোনা করে স্বনির্ভর হবে, তা না, টাকার বিনিময়ে পরনির্ভরতা আর দাসিবাঁদির জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
২৫ হাজার টাকা হাতে পেলে মেয়েটির পরিবার সেই অর্থ দিয়ে কী করবে— তা সরকারি নির্দেশিকায় স্পষ্ট করে লেখা নেই। কন্যাশ্রীর অনুদান পেতে গেলে শুধু ১৮ বছর বয়স হলেই চলবে না, তাকে কোনও স্কুল বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হতে হবে। এদিকে আবার ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে বিয়েও আইনসিদ্ধ। সে কারণে পড়াশোনা বন্ধ করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চলই এখন জনপ্রিয়। ভালো একটি প্রকল্প তৈরি করে নানা জায়গা থেকে পুরস্কার পাওয়া হচ্ছে, কিন্তু কেউ নেই প্রকল্পের টাকা সঠিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা দেখার।
সত্যি বলতে কী, কন্যাশ্রী প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের নয়, পুরুষের কাজে লাগছে। যে পুরুষদের অশিক্ষিত দাসি বাঁদি বিয়ে করতে হতো, পণের টাকার ঠিক ছিল না; এখন তারা কিছুটা শিক্ষিত দাসি বাঁদি পাচ্ছে, পণের টাকাও চমৎকার হাতে আসছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের কল্যাণে তাদের এই সুবিধেটা হচ্ছে।
মেয়েদের জন্য এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভালো কিছু করতে দেবে না। স্বনির্ভর মেয়েদেরও এই সমাজ পরনির্ভর বানায়। স্বনির্ভর মেয়েরাও স্বামীর দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। স্বনির্ভর মেয়েরও একা চলার, একা থাকার, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত একা নেওয়ার অধিকার নেই। একা এত সব করতে গেলে তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে নারী বিদ্বেষী সমাজ।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরস্কার হাতে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী এত বিশাল বিশাল কথা বলেছেন, মনে হচ্ছিল যেন মেয়েদের এতকালের দুর্বিষহ জীবন তিনি এক তুড়িতে পালটে দিয়েছেন, সমাজের নারীবিদ্বেষী লোকগুলোকে এক ফুঁয়ে হাওয়া করে দিয়েছেন। ফেসবুকে তাই সবাইকে সেদিন আহবান করেছি, ‘কন্যাদের শ্রী দেখতে চাইলে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বেশ্যালয় সোনাগাছি ঘুরে আসুন, ঘুরে আসুন কালীঘাট, বউবাজার, খিদিরপুর, লেবুতলার বেশ্যালয়, কন্যারা কী করে পূতিগন্ধময় নিকৃষ্ট পরিবেশে যৌনদাসীর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে দেখে আসুন। কী করে কন্যাশিশু পাচার হচ্ছে, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পতিতালয়গুলোতে প্রতিদিন, দেখে আসুন। কন্যারা শুধু ধর্ষণের নয়, গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। রাস্তা ঘাটে অলিতে গলিতে কন্যাদের যৌন হেনস্থা দিন দিন বাড়ছে। ঘরের ভেতর শত শত কন্যা প্রতিদিন স্বামী-শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সইছে দেখে আসুন। লেখাপড়া জানা কন্যারাও নির্যাতন অসহ্য হয়ে উঠলে আত্মহত্যা করছে, চলুন দেখে আসি কত শত কন্যাকে পণপ্রথার শিকার হতে হচ্ছে, বধুহত্যার হারই বা কেমন বাড়ছে দেখে আসি। বাল্য বিবাহের শিকার কত লক্ষ কন্যা, দেখে আসি চলুন। কী বলছি কী! আমি কী করে দেখবো, আমার তো পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ নিষেধ! কারণ আমি যে মস্ত বড় এক অপরাধ করেছি! কন্যাদের সমানাধিকার চেয়ে দু'ডজন বই লিখেছি!!’
আমার ওটুকু মন্তব্য নিয়ে শুরু হয়ে গেলো তুলকালাম কাণ্ড। তৃণমূলীরা, চাটুকারেরা, মেরুদণ্ডহীনেরা অকথ্য ভাষায় আমাকে গালাগালি তো করলোই, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে চরিত্রহননও করলো। নারীবিদ্বেষী সমাজে নারীরা সমানাধিকারের জন্য মুখ একবার খুলেছে তো মরেছে। আমাকে শত শত বার মেরেছে ওরা। অনেকে বলেছে, প্রকল্পটি ভালো উদ্যোগ। সে আমিও স্বীকার করি, কন্যাশ্রী নিশ্চয়ই ভালো উদ্যোগ, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোটা অক্ষত রেখে এইসব ভালো উদ্যোগ শেষ অবধি কতটা ভালো মেয়েদের করে, তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কন্যাশ্রী যে ভালো, এ কথা সবাই বলবে, বিশেষ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরস্কার পাওয়ার পর তো বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে। আমি না হয় একটু অন্য দিকের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম, যে দিকটা দেখতে দেখতে সবার চোখ সওয়া হয়ে গেছে, যে দিকটাকে অধিকাংশ মানুষ ভাবে, আবহমানকাল ধরে ছিল, আছে, থাকবে।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের মতো প্রচুর প্রকল্পের প্রয়োজন, যেসব প্রকল্প যৌন পাচার বন্ধ করবে, নারী নির্যাতন বন্ধ করবে, মেয়েদের পরনির্ভর হতে দেবে না, পতিতা হতে দেবে না, দাসিবাঁদি হতে দেবে না। যেসব প্রকল্পের কারণে নারীবিদ্বেষীদের জায়গা হবে না কোথাও; যৌন হেনস্থাকারীরা, নারী নির্যাতনকারীরা, ধর্ষকরা রেহাই পাবে না। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের জন্য শুধু নারী নয়, পুরুষও আন্দোলন করবে। ভেতরে অসুখ রেখে বাইরেটা ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে রাখলে দূরদৃষ্টিহীনদের বাহবা পাওয়া যায় বটে ক’দিন, কিন্তু অচিরেই ধসে পড়ে সব। এ যাবত তো মেয়েদের স্বনির্ভর বানানোর জন্য প্রকল্প কম হলো না, মেয়েরা তবে কেন এখনও অধিকাংশই পুরুষের অধীন?
লেখক: কলামিস্ট
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।