X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানসিক স্বাস্থ্যকে আর অবহেলা নয়

লীনা পারভীন
০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৪৮আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৪৯

লীনা পারভীন কেমন আছি আমরা সবাই? এক কথায় উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় কয়জন আছি। ২০২০ সাল চলে গেলো, অথচ বছর শুরুতে আমরা জীবনকে যেমনটা দেখতে চেয়েছিলাম, যা পরিকল্পনা করেছিলাম, তার সবকিছুই পাল্টে দিলো একটি অদৃশ্য ভাইরাস। এই করোনা কেবল আমাদের পরিকল্পনায় আঘাত হেনেছে তা নয়, ওলটপালট করে দিয়েছে আমাদের মনোজগৎকেও। ‘ভাল্লাগেনা’ রোগ আমাদের জন্মগত কিন্তু এই ভালো না লাগাকে মোকাবিলায় আমাদের হাতে ছিল নানাবিধ অস্ত্র। অথচ আজ? আমাদের চারপাশে তাকালেই এর উত্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্তত দুটি প্রজন্ম আজ হুমকির সম্মুখীন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা নিজেরাই কি ভালো আছি? আমার এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘পোস্ট কোভিড মোকাবিলায় দেশে পাগলা গারদের ক্যাপাসিটি বাড়ানো উচিত। আমার এবং আমার মতো অনেকের সপরিবারে ভর্তি হতে হবে।’

আমরা অনেকেই সেই স্ট্যাটাসে অট্ট হাসি সহ নানারকম ইমো’র মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। বিষয়টা আসলেই ভেবে দেখার মতো পর্যায়ে চলে গেছে।

এমনিতেই আমরা আমাদের শরীর নিয়ে যতটা সচেতন, মনের খবর একদমই তার উল্টো। আমরা ধরেই নেই, মনকে এত পাত্তা দেওয়ার কী আছে? খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুরছি, ফিরছি, আড্ডা মারছি আর আয়-রোজগার করে দিব‌্যি খেয়ে পরে বেঁচে আছি। এইতো বেশ আছি। এখানে আবার মনের সমস্যা কোথায়?

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ইদানীং সামান্য আলোচনা হলেও আক্রান্তের তুলনায় এর প্রস্তুতি একদম নেই। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি কোনও অসুখ নয়। মানসিক স্বাস্থ্য একজন মানুষকে তার নিজের ও চারপাশে থাকা অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হতে বা একাত্ম হতে সাহায্য করে বা ক্ষমতা জোগায়। এই ক্ষমতার জোরে মানুষ তার জীবনের নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এই ক্ষমতা যত সবল হবে মানুষ তত সতেজ বা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষার ফলাফল একটা সময় গিয়ে শারীরিক অসুস্থতায় ঠেকে। মন এবং শরীর একে অপরের সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্কে সম্পর্কিত।

নেটফ্লিক্সে প্রিন্সেস ডায়ানার জীবনীর ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারিটি দেখছিলাম। খুঁজে পেলাম, তিনি মানসিকভাবে অসম্ভব একজন অসুখী মানুষ ছিলেন। অথচ কী ছিল না তার? দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশের রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ডায়ানার, কিন্তু তিনি মনের দিক দিয়ে শান্তিতে ছিলেন না। জীবনে তার সব ছিল, কিন্তু ছিল না কেবল ভালোবাসা। ছোটবেলায় পিতা-মাতার সম্পর্ক তাকে ট্রমাটাইজড করেছিল। মায়ের অভাব তিনি অনুভব করতেন সবসময়। জানা যায় তার সেই ট্রমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কেবল ভালোবাসার লোভে তিনি নিজেকে রাজকীয় নিয়ম-নীতির বাইরে নিতে চেয়েছিলেন। ডায়ানার সম্পর্কে বলতে গিয়ে একজন বলেছিলেন ‘ট্রমা ইন্টেলিজেন্স’ বিষয়ে। টার্মটি আমার মতো অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও এর আকৃতি বা প্রকৃতি নতুন নয়। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে ছোটবেলা থেকেই একধরনের ট্রমা নিয়ে বেড়ে উঠেছি এবং দিনে দিনে সেই ঘটনাই আমাকে কাবু করে ফেলছে অথচ আমি টেরই পাইনি কেন এমন হচ্ছে। মিলিয়ে দেখলাম, আসলেই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। ছোট কোনও ঘটনাকে অবহেলা করতে করতেই একটা সময়ে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি বা অসুস্থতার দিকে চলে যাই। হারিয়ে যায় জীবনের প্রতি সকল মায়া বা আকর্ষণ।

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, এই করোনাকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। এখানে কেবল বয়স্করাই নয়, অনীহা তৈরি হচ্ছে শিশুদের মাঝেও। আমরা এখন আর কোনও কিছুতেই উৎসাহ পাই না। উচ্ছ্বসিত হই না। বন্ধুত্বের হাতছানি যেন আর তেমন করে টানে না কাউকে। এই পরিস্থিতিতে আমরা ভাবছি হয়তো একা থাকাই উত্তম বা সমাধানের একমাত্র রাস্তা। ভুল। এই সময়টাতেই বরং আরও বেশি করে আমাদেরকে কানেক্টেড থাকতে হয়। ভালোলাগার কাজগুলোকে বেশি করে যত্ন নিয়ে করতে হয়। আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগটি বাড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু পারছি কি আমরা? একই ছাদের নিচে থেকেও যেন আমরা আলাদা সকলে। একেকজনের মাঝে একেকটি দুনিয়া গড়ে তুলছি। বিচ্ছিন্নতার দেয়াল আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আমরা সবসময়ই ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’ বা আবেগকে কতটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করা যায় সেই বিষয়ে কথা বলি, প্রশিক্ষণ দেই কিন্তু কখনও কি ভেবেছি যে ট্রমাকেও পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার দরকার আছে? বিষয়টি নতুন নয় মোটেও, কিন্তু কখনও এটা পেশাদারি চেহারায় আমাদের সামনে আসেনি। সাধারণত যেসব বাচ্চা ছোটবেলায় কোনও না কোনোভাবে ট্রমাটিক কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তারা সেই অবস্থা থেকে আর কখনও বের হতে পারে না। যত বড় হয় এটি তাদের মধ্যে আরও পাকাপোক্ত হতেই থাকে। এই ইস্যুটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করি না আমরা। ধরেই নেই, এগুলো তো জীবনেরই অংশ। এসব নিয়ে আবার আলোচনার কী আছে? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো চলে যায়। বাস্তবে ট্রমার কোনও নির্দিষ্ট ডেফিনিশন বা আকৃতি নেই। এটা ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত। কার কাছে কোনটা বেদনাদায়ক স্মৃতি সেটা বাইরের কেউ নির্ধারণ করতে পারে না। ট্রমা কখনও হারিয়ে যায় না, হয়তো বয়স এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর রূপ পরিবর্তন হতে পারে। এ ধরনের মানুষগুলোর দরকার হয় একটু ভালোবাসা ও ভালো সঙ্গ। কোনও ধরনের ধন দৌলতের বিনিময়ে আপনি তার এই মনোজগতের বিষয়টিকে বিবেচনা করতে পারবেন না। অথচ আমরা সবাই এদেরকে এড়িয়ে চলতে চাই। মনে করি এরা বিরক্তিকর।

কোভিড আমাদের আবারও শিখিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের মনোজগতের দিকে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার। আজকের যে শিশুরা ট্রমার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছে তাদের ভবিষ্যতে কেমন হবে ভেবেছি কি আমরা? মেন্টাল ট্রমাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত না। আমরা শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখাই, ওষুধ খাই, কিন্তু মনের অসুখের কথা কেউ ভাবি না। কেউ পাত্তাই দেই না। কেবল যে এই অবস্থায় আসে সেই বুঝতে পারে এর যন্ত্রণা কতটা। এর থেকে উত্তরণের রাস্তায় কেউ সঙ্গী হয় না। একাই লড়ে যেতে হয় আক্রান্তকে। এই লড়াইয়ে তাই কেউ টিকে, কেউ টিকে না। কিন্তু কোভিডের থেকে শিক্ষা নিয়ে সময় এসেছে আমাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার। বেঁচে থাকাটাই হয়তো এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু সেই বেঁচে থাকাটাই যেন হয় একটি সুস্থ জীবনের সন্ধান।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ