X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাহলে কি বিজয় দিবসে উড়বে পাকিস্তানি পতাকা?

রেজানুর রহমান
২১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৩৪আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৩৪

রেজানুর রহমান কেউ কেউ এমন কথাও বলেন– মেঘে মেঘে অনেক বেলায় তো হলো। বছরের হিসাবেও অনেক বছর। কাজেই সবকিছুই ভুলে যাওয়া উচিত। মহান ৭১ সাল সম্পর্কে যখন কেউ এ ধরনের আপসকামী কথা বলেন, আমি তার বা তাদের সঙ্গে কখনোই একমত হতে পারি না। আবার এটাও ঠিক, হিংসা, বিদ্বেষ নিয়ে সত্যিকারভাবে সামনে এগোনো যায় না। কাজেই বৈরী নয়, বন্ধুত্বই হোক সম্পর্কের বন্ধন। কিন্তু শত্রুকে কী সহজে ভুলে যাওয়া যায়? সত্যিকার বন্ধুত্ব কী হয় শত্রুর সঙ্গে? তাও যদি হতো শত্রু ক্ষমা চেয়েছে, বলেছে আমি ভুল করেছিলাম। ক্ষমা চাই। তাহলেও না হয় একটা সম্পর্ক দাঁড় করানো যেত।

কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটীয় কিছু ঘটনা বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একে তো টি২০ বিশ্বকাপে অব্যাহত গতিতে বাংলাদেশের হারের দৃষ্টান্ত আছে। তার ওপর ঘরের মাঠে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের কাছে নাস্তানাবুদ পরিস্থিতি এতটাই বিব্রতকর যে আসন্ন বিজয়ের মাসে এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া সত্যিকার অর্থে কষ্টকর। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন ক্রিকেট তো শুধু একটি খেলা মাত্র। এখানে রাজনীতি টেনে আনার কোনও মানে হয় না। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম সে কথা। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশের ক্রিকেট মাঠে অনুশীলন করার সময় যখন তাদের জাতীয় পতাকা ওড়ায় তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? এটা কি এক ধরনের রাজনীতি নয়?

কে না জানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কতটা নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল। সেই পাকিস্তান বাংলাদেশে খেলতে এসে যখন নিয়মবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশে নিজেদের পতাকা ওড়ায় তখন একটি ভিন্ন বার্তা প্রকাশ পায়। এই বার্তাকে আর যাই হোক বন্ধুত্বের আহ্বান বলা যায় না।

একটা ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। মহান ’৭১ সালে পাকিস্তান যে আমাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, নারীকে ধর্ষণ করেছিল, ঘরবাড়ি, গ্রামের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিল, এজন্য একবারও ক্ষমা চায়নি। ঠিক আছে, ক্ষমা না চাক তারা কি নিজেদের মধ্যে অনুতপ্ত আচরণ করে?

ছেলেমেয়েদের অর্থাৎ তাদের বর্তমান প্রজন্মকে কি ’৭১ সালের সত্যি ঘটনাটা বলে? পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম কি আদৌ জানে তাদের পূর্ব পুরুষেরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যাতে স্বাধীন না হয় তার জন্য কতটা নির্দয়, নিষ্ঠুর, অমানবিক হয়ে উঠেছিল। তাদের পূর্ব পুরুষ যে ধর্ষক এটা কি তারা জানে? সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ধারণাটা দেওয়া হয় পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে? সত্যটা কি তুলে ধরা হয় তাদের কাছে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস সত্যটা মোটেও তুলে ধরা হয় না। তারই জ্বলন্ত প্রমাণ ঢাকার মাঠে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা গেড়ে ক্রিকেট অনুশীলনের ধৃষ্টতা। পাকিস্তান যদি তার তরুণ প্রজন্মের কাছে ’৭১-এর সত্যি গল্পটা বলতো তাহলে পাকিস্তানের তরুণ ক্রিকেটাররা ঢাকায় খেলতে এসে মাঠে এভাবে নিজেদের জাতীয় পতাকা গাড়তো না। বরং পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জাতীয় পতাকা গাড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে তাদের পূর্ব পুরুষেরা ’৭১ সালের সত্যি গল্পটা তাদের কাছে লুকিয়েছে। হয়তো ’৭১-এর গল্পটা এমনভাবে বলেছে এবং বলেই যাচ্ছে যে ৭১-এ বাংলাদেশই অন্যায় করেছিল। বাবা-মায়ের আচার-আচরণই কিন্তু ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। পাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে সেটা কিন্তু বাবা-মায়ের কাছেই শেখে ছেলেমেয়েরা। ধরা যাক, পাশের বাড়ির সঙ্গে খুবই অন্যায় আচরণ করেছিল একটি পরিবার। এখন তারা ওই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চায়। তাহলে তো উদ্যোগটা আসতে হবে একদা অন্যায় আচরণ করা ওই পরিবার থেকেই। পরিবারটির উচিত নিজেদের সদস্যদের কাছে সত্যি গল্পটা বলা, যাতে উভয় পরিবারের তরুণ সদস্যরাও বিরোধটা মিটিয়ে ফেলতে পারে। এরকম কোনও উদ্যোগ কি পাকিস্তান কখনও নিয়েছে? নেয়নি। বরং ঢাকায় খেলতে এসে পাকিস্তান ক্রিকেট দল কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে।

আবারও বলি, যার যার দেশের পতাকা তার তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে নিয়মবহির্ভূতভাবে পতাকা ওড়ানোর পক্ষে কোনও যুক্তি দেখি না। যদিও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের পতাকা ওড়ানোর উদ্যোগ দেখে সহজেই ধরে নেওয়া যায় ’৭১-এর ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনও অনুশোচনা নেই। বরং আছে অবজ্ঞা ও ধৃষ্টতা প্রদর্শনের মনোভাব। মানছি খেলার মধ্যে রাজনীতি টেনে আনা ঠিক নয়। কিন্তু রাজনীতি তো শুরু হয়ে গেলো। নাকি? অবজ্ঞার রাজনীতি...।

যদিও বিষয়টিকে আরেকটি পক্ষ মোটেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন। কারণ, হিসেবে সদ্য সমাপ্ত টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদাহরণ তুলে ধরছেন তারা। দুবাই, শারজায় টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অনুশীলন চলাকালেও নাকি পাকিস্তান ক্রিকেট দল তাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অনুশীলন করেছে তারা।

যদি সেটাই হয়ে থাকে তাহলে তারও একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ব্যাখ্যাটা দিতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। জাতীয় পতাকা আমাদেরও আছে। পতাকার সম্মান রক্ষা করা  আমাদেরই দায়িত্ব। ক্রিকেটে পতাকার রাজনীতি যেন গুরুত্ব না পায় এটাই সময়ে দাবি।

ঢাকায় পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিতীয় টি-২০ প্রতিযোগিতার দিন পাকিস্তানের একজন ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উইকেটকিপার কাম ব্যাটসম্যান নূরুল হাসান সোহানকে আউট করার পর উড়ন্ত ভঙ্গিতে যেভাবে সোহানকে মাঠ ছেড়ে চলে যাবার ভঙ্গি দেখালেন, ওই ভঙ্গিও ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির অংশ নয়। ভারত বা অন্য কোনও দেশের ক্রিকেট দলের কোনও খেলোয়াড়কে আউট করার পর পাকিস্তানের কোনও খেলোয়াড় নিশ্চয়ই এ ধরনের আপত্তিকর ভঙ্গি করবেন না। বাংলাদেশ বলেই কি এই ভঙ্গি করার সাহস হয়েছে? যদিও ওই খেলোয়াড়কে শাস্তির আওতায় এনেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা আইসিসি। তবু বিতর্ক তো থেকেই যায়।

তবে এর দায় বোধকরি আমাদেরই। ক্রিকেট সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আবেগের বিষয়। ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। কাজেই ক্রিকেটের যথার্থ পরিচর্যায় আমরা কি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছি? মাশরাফি নেই। সাকিব, তামিম, মুশফিক খেলছেন না। তার মানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দারুণ একটা সংকটকাল চলছে। এটা যে হবে আমাদের ক্রিকেট বোর্ড কি একবারও আঁচ করতে পারেনি। নভেম্বরে পাকিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশে খেলতে আসবে। নভেম্বরের পরই ডিসেম্বর। বাঙালির বিজয়ের মাস। উপরন্তু মহান বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি। এই সময়ে পাকিস্তান দলের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের শোচনীয় হারকে আমরা কি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেবো?

এদিকে খবর বেরিয়েছে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির দিনে ঢাকায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে হকি ফাইনাল ম্যাচের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। এ কারণে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে মিরপুরের অ্যাকাডেমি মাঠে সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়বে। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তারা ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ