X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা!

প্রভাষ আমিন
২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৬:২৬আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৬:২৬
প্রভাষ আমিন আমার গ্রামের ছেলেবেলার এক বন্ধু। গ্রামেই ছোটখাটো ব্যবসা করে মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করেন। তার মায়ের অনেক বয়স। সেই বয়সজনিত কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নানাবিধ রোগ তাকে কাবু করে ফেলেছে। সেই বন্ধু মাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। কিন্তু তার মায়ের যে সমন্বিত চিকিৎসা দরকার, সরকারি হাসপাতালে সেটা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, এটা বলা ঠিক নয়। হয়তো সম্ভব। কিন্তু তার মতো গ্রাম থেকে আসা একজন মানুষের পক্ষে সেটা ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব। বাধ্য হয়ে মাকে তিনি একটি মধ্যম মানের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলেন।

পরিচিত এক ডাক্তার থাকায় সেখানে যখন যে ডাক্তার দরকার, সে ডাক্তার এনে সমন্বিত চিকিৎসা চলছে। কিন্তু মায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপই হচ্ছে শুধু। এখন আর মুখে খেতে পারেন না। সব কাজ বিছানায়ই সারতে হয়। এমন একজন বয়স্ক রোগীর যে উন্নত চিকিৎসা ও সেবা দরকার, তার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আসলে তার নেই। কাল খুব অসহায় কণ্ঠে বলছিলেন, আর বোধহয় পারবো না। মাকে এখন বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তার মানে বাড়ি নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার মোটামুটি সামর্থ্য ছিল বলে, মাকে ঢাকা পর্যন্ত এনে চিকিৎসা করাতে পেরেছেন। কিন্তু গ্রামের এমন অনেক মানুষকে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। হাসপাতালের বারান্দা পর্যন্ত আসার সৌভাগ্যও তাদের হয় না।

আমার বড় কোনও অসুখ-বিসুখ নেই। কিন্তু এক ব্যাকপেইন গত ১৭ বছরে আমার শরীরের কোমর এবং পকেটের কোমরেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। নানান চিকিৎসায় এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও দেশের হাসপাতালে কোমরের দুটি অপারেশন আর বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে থাকা এবং ফিজিওথেরাপি আমার চাকরির আয়ের মধ্যবিত্ত সংসারে টানাটানি লাগিয়ে দিয়েছে। তারকা বানানোর কারিগর তারকা আলোকচিত্রী চঞ্চল মাহমুদ এবং তার স্ত্রী রায়না মাহমুদ গত কয়েক বছরে একাধিকবার নানা অসুখে আক্রান্ত হয়ে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রবল আত্মমর্যাদার কারণে অনেকে হাত পাততে পারেন না। আবার অর্থ ছাড়া জীবন বাঁচানোও দায় হয়ে যায়।

এমন অসংখ্য করুণ গল্প আমাদের চারপাশে। প্রতিটি পরিবারকেই এমন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অসুখ-বিসুখ যেকোনও বয়সেই হতে পারে। তবে বয়সের কাছে হার মানতে হয় সবাইকেই। জীবনভর প্রবল দাপুটে মানুষটিও অসুখের কাছে কাবু হয়ে যান। আর একটা বড় ধরনের অসুখ বা বয়সজনিত অসুস্থতা অসুস্থ মানুষটিকে তো বটেই, পুরো পরিবারকেই বিপাকে ফেলে দেয়। অসুস্থ অবস্থায় মানুষ আসলে অসহায় হয়ে যায়। একদম সিনেমার মতো ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে, ডাক্তার সাহেব ওপরে আল্লাহ নিচে আপনি, যত টাকা লাগে আমার বাবাকে বাঁচান। মুখে বলেন বটে, কিন্তু যত টাকা দরকার, তত টাকা তার কাছে থাকে না। প্রথমে সঞ্চয় ভাঙেন, জমিজমা বিক্রি করেন, হাত পাতেন। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হলেও পরিবারটি মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত হয়ে যান। আর যদি বেঁচে ফিরতে না পারেন, মেরে যান পুরো পরিবারকেও। তারকা খেলোয়াড়, জনপ্রিয় অভিনেতা, দাপুটে সাংবাদিকও একসময় ‘দুস্থ’ বনে যান। চেয়েচিন্তে চিকিৎসা করাতে হয়।
সমস্যার মূলে অবশ্যই জনসংখ্যার আধিক্য।

জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। এত চাপের মধ্যেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল যে মানের চিকিৎসা দেয়; তাতে প্রতিবছরই তাদের পুরস্কার দেওয়া উচিত। সবসময়ই সরকারি হাসপাতালে আসন সংখ্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকে। সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে মাছ বাজারের পার্থক্য করা মুশকিল। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গেলে প্রথমে রোগীকে ফ্লোরেই থাকতে হয়। ডাক্তাররা রোগী দেখতে যান, আরেক রোগীর গায়ের ওপর দিয়ে। তারপরও আমি জরুরি কিছু হলে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেই যেতে বলি। ফ্লোরে থাকলেও জীবন বাঁচানোর প্রাথমিক চিকিৎসাটা তিনি পান। হাসপাতালের ফ্লোরে, বারান্দায়, বাথরুমের সামনে অমানবিক পরিবেশে রোগীর থাকা নিয়ে কয়েক বছর আগে কথা হচ্ছিল হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের তখনকার পরিচালকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, আমরা যদি আসনের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি না করি, তাহলে আমাদের হাসপাতালও ঝকঝকে তকতকে থাকবে। কিন্তু তখন প্রতিদিন আমাদের হাসপাতালের সামনে রোগীর মৃত্যু ঘটবে। আমরা কোনও রোগীকেই ফিরিয়ে দেই না। বাথরুমের সামনে রেখে হলেও তার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। এত যে উপচেপড়া ভিড়, তারপরও সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান মাত্র ১৪ ভাগ মানুষ। আর এই হিসাব এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই গবেষণায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজন থাকলেও তিন কোটির বেশি মানুষ প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসা সেবা নেন না বা নিতে পারেন না। আর চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ ভাগ যায় রোগীর পকেট থেকে।

সরকারি হাসপাতালে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ‘টাকা চাই টাকা চাই’ চিৎকার। এই চক্করে অসহায় মানুষ আরও অসহায় হয়ে পড়ে। শুরুতে যে বন্ধুটির কথা বলছিলাম, তার মতো অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত স্বজনের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন না। দেশে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল আছে, ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। ঝকঝকে, তকতকে; ঢুকলেই রোগীর মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু বেরোনোর সময় পকেটের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল আছে, রীতিমতো ফাঁদ পেতে বসে থাকে। মোটামুটি রোগী গেলেও তাকে সিসিইউ বা আইসিইউর চক্করে ফেলে দেয়। আর একবার সিসিইউ বা আইসিইউতে ঢুকলে সেখান থেকে বের হতে হতে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। আর একবার লাইফ সাপোর্টে চলে গেলে জীবন-মরণ টানাটানি। অপ্রয়োজনে দিনের পর দিন আইসিইউতে রাখা এমনকি মারা যাওয়ার পরও লাইফ সাপোর্টে রাখার মতো অমানবিক উদাহরণও বিরল নয়। এমনকি মারা যাওয়ার পর লাশ আটকে রেখে টাকা আদায়ের ঘটনাও অহরহ। করোনার সময় আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা সামনে আসে বারবার। অসহায় মানুষের হাহাকারে ভারী ছিল হাসপাতালগুলোর বাতাস। করোনার বিশেষ কোনও ওষুধ ছিল না। তারপরও সরকারি আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ে ছিল আকাশ-পাতাল ফারাক।

অসুস্থ মানুষ আরেকটা বড় ধাক্কা খায় টেস্ট করতে গিয়ে। ডাক্তারের কাছে গেলে প্রথমেই গাদা গাদা টেস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। অসহায় মানুষ পাগলের মতো ছুটে যায় টেস্ট করাতে। রোগ নির্ণয়ে টেস্ট করতেই হয়। কিন্তু সব টেস্ট কি দরকারি? আমার এক ডাক্তার বন্ধু বলছিলেন, যদি নির্দিষ্ট মাত্রার টেস্ট না দেন, তাহলে তার এই সুন্দর চেম্বারটি বেশি দিন থাকবে না। আর ডাক্তারের রোগী দেখা দিয়ে তো হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা হবে না। আসল ব্যবসা তো ভর্তি আর টেস্টে। আর টেস্টের ৪০ ভাগ চলে যায় কমিশনে। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে টাকা দিয়েও সেবা মেলে না। বিলিং বিভাগের লোকজন তো টিনের চশমা পরে থাকেন। বিলের ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তাদের নেই। তারা ব্যস্ত টাকা গুনতে।

বাংলাদেশে অনেক বিশ্বমানের ডাক্তার আছেন। কিন্তু সেই বিশ্বমানের চিকিৎসাটা তারা বাংলাদেশের রোগীদের দিতে পারেন না। দিতে যে পারেন না, সেটা তার দায় যতটা, তারচেয়ে বেশি দায় আমাদের। কোনও কোনও ডাক্তার দিনে শতাধিক রোগী দেখেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তাকে চেম্বারে থাকতে হয়। চেম্বারের ভেতরে-বাইরে উপচে পড়া ভিড়। এক মিনিটের বেশি দেওয়ার মতো সময় তার হাতে নেই। নইলে রাতভর রোগী দেখতে হবে। একজন ব্যস্ত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চেম্বারে বসেন ৬/৭ জন সহকারী নিয়ে। সহকারী ডাক্তাররাই রোগী দেখেন। তিনি শুধু প্রেসক্রিপশনে একটা সই দেন। বাজারের মতো অবস্থায়ই রোগীকে তার গোপন সমস্যার কথা বলতে হয়। প্রাইভেসির কোনও ধারণাই নেই যেন। অথচ কয়েকদিন আগে দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। চেম্বারে ডাক্তার আর রোগী ছাড়া আর কেউ নেই। ডাক্তারের কোনও তাড়াও নেই। তিনি মনোযোগ দিয়ে রোগীর কথা শুনছেন। অতীতের সকল রিপোর্ট দেখছেন। বাংলাদেশে এমন অভিজ্ঞতা বিরলই বলতে হবে।

শুধু যে বাংলাদেশের মানুষের অসুখ হয়, তা নয়। উন্নত বিশ্বের মানুষেরও রোগ হয়, তারাও চিকিৎসা নেন। কিন্তু একবার অসুস্থ হলেই তারা ফতুর হয়ে যান না। কারণ, তাদের স্বাস্থ্যবিমা করা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিমার ধারণাটা এখনও জনপ্রিয় নয়। কবে অসুখ হবে, তার জন্য ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে মাসে মাসে টাকা দিতে রাজি থাকেন না বেশিরভাগ মানুষ। অনেকের অবশ্য ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম দেওয়ার সামর্থ্যও থাকে না। তবে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিমার কোনও বিকল্প নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনও একটা পরিকল্পনা করে, জনসংখ্যার বড় একটা অংশকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনতে হবে।

সমস্যার যে ভয়াবহতা, রাতারাতি তার কোনও সমাধান বের করা কোনও ম্যাজিশিয়ানের পক্ষেই সম্ভব নয়। সরকারি চিকিৎসার আওতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। আর অবশ্যই বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ এবং কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। আপাতত এটুকু প্রত্যাশা ছাড়া কিছু করার নেই। শুরুতে যার কথা বলছিলাম, সেই বন্ধুর মতো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।
 
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে হত্যা, ভাতিজার যাবজ্জীবন
মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে হত্যা, ভাতিজার যাবজ্জীবন
ডিএনসিসি ও চীনের আনহুই প্রদেশের সহযোগিতামূলক চুক্তি সই
ডিএনসিসি ও চীনের আনহুই প্রদেশের সহযোগিতামূলক চুক্তি সই
চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক গ্রেফতার
চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক গ্রেফতার
টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে ফের পাকিস্তানের এক নম্বর বোলার শাহীন
টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে ফের পাকিস্তানের এক নম্বর বোলার শাহীন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ