X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরি পাওয়ার অধিকার কি তবে শ্রেণিগত?

জোবাইদা নাসরীন
১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:২১আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:২১

জোবাইদা নাসরীন বছর দুয়েক আগে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম। গল্পটির নাম ছিল ‘নদীর ডাকঘর’। সেটি একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্পটি ছিল একটি লাশের পরিচয় নিয়ে, যিনি কিনা একজন নারী। লাশটির নাম পরিচয় এবং ঠিকানা কেউ জানে না। মেয়েটিকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়। লাশের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে মেয়েটির পরিচয় জানা যায়। মেয়েটি বেদে সম্প্রদায়ের এবং তার কোনও স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। তাই মেয়েটির পরিচয় জানা যাচ্ছিল না। গল্পটি শেষ হয়েছিল এইভাবে যে মানুষের স্থায়ী ঠিকানার যে মূল ধারণা জমি এবং আবাসন সেটি সবার নাও থাকতে পারে। জমি কেন্দ্রিক ঠিকানার ধারণা খুবই সাম্প্রতিক।

গল্পটির মতোই শুধু স্থায়ী ঠিকানা সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেওয়ায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেতে সমস্যা তৈরি হয়েছিল বরিশালের হিজলা উপজেলার আসপিয়া ইসলামের। পরে অবশ্য গণমাধ্যমে এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে।  মেধা ও শারীরিক যোগ্যতার সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন আসপিয়া।  শুধু নিয়োগের অপেক্ষায় ছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে আসে বিপত্তি। বলা হয় যে আসপিয়া ও তার পরিবারের কেউ ভূমির মালিক নয় এবং এই জন্যই ‘পুলিশে তার চাকরি হবে না’ বলে জানানো হয়।

পরে আপসিয়ায় চাকরি হয়। তবে সেটি যে প্রচলিত নিয়ম পরিবর্তন করে তা কিন্তু নয়। এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধান না করেই আসপিয়াকে ভূমির মালিক বানিয়ে চাকরিটি পেতে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সেক্ষেত্রে  কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ভূমির মালিক না হলে কি তবে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না? কিংবা স্থায়ী ঠিকানা যাদের নেই তারা কোনও ধরনের সরকারি চাকরি পাবেন না? তাই যেহেতু নিয়মটি পরিবর্তন না করেই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে, সেক্ষেত্র হয়তো আপসিয়ার সমস্যার সমাধানই হলো কিন্তু অন্যরা যখন একই সমস্যায় পড়বে তখন সবারটা এভাবে গণমাধ্যমে নাও প্রকাশিত হতে পারে, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?

আপসিয়ার ঘটনার রেশ না কাটতেই আমরা মীমের কথাও জানতে পারি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ আনুযায়ী বাগেরহাট ৩২ বছর আগে থেকে খুলনায় আসেন মীমের বাবা রবিউল ইসলাম। এরপর পরিবার নিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন সোনাডাঙ্গা এলাকায়। তাদের মেয়ে সম্প্রতি পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে নিয়োগ পরীক্ষার সব ধাপ উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু ১১ ডিসেম্বর মীম জানতে পারেন, স্থায়ী ঠিকানা ও জমি না থাকায় তার চাকরিটা হচ্ছে না।

এখন ধীরে ধীরে হয়তো এই একটি কারণেই  আরও চাকরিবঞ্চিত প্রার্থীদের কেসগুলো আমরা জানতে পারবো। তবে এর আগেও এই ধরনের বিষয়ে যে সমস্যা হয়নি তা নয়। কারোরটা বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় সমাধান হয়েছে কারোরটা হয়নি। অনেকেই গণমাধ্যম কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারেননি। ২০১৬-তে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলার দুই চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান কলিন্স রোজারিও ও রাজু প্রসাদ কৈরীর পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি হয়েছিল। তাদের ক্ষেত্রেও আটকে দেওয়া হয়েছিল তাদের নিয়োগ। কারণ তারাও ভূমির মালিক ছিলেন না। সেটির ক্ষেত্রেও কিন্তু নিয়ম পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিক তৎপরতায় সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল।

যদি আসলে নিয়মই পরিবর্তন করা না হয় তাহলে কী ঘটবে? ভবিষ্যতে আরও আপসিয়া, মীমদের আর্জিই পত্রিকায় প্রকাশ হবে। বিষয়টা আরও খোলাসা করে বলি, তা হলো এ দেশে গৃহহীন এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশনের পরিসংখ্যান ও তথ্য বিভাগের কৃষি শুমারি ২০১৯- প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়,  দেশে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা হলো ৪০ লাখ ২৪ হাজার ১৮৯। তার মানেই ধরেই যদি আমরা নিচ্ছি বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী এই পরিবারগুলোর কেউই চাকরি বাজারে উপযুক্ত নয়। কারণ, তাদের কোনও জমি নেই।

বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল আছে যেখানে প্রতি বছরই নদী ভাঙনের মুখে পড়ে অনেক পরিবারই অন্যত্র চলে যায। আবার কোনও কোনও জায়গায় স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কোন্দলেও মানুষ সেই এলাকায় টিকে থাকতে পারে না। এর বাইরেও অনেকেই আছেন যারা একই জায়গায় থাকেন না। যেমন বেদে জনগোষ্ঠী। এসব কারণে যারা এক এলাকা ছেড়ে  অন্য এলাকায় আশ্রয় নেন, যাদের স্থায়ী ঠিকানা বলে কিছুই নেই, তারা কী কখনও সরকারি চাকরি পাবে না? বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার  গ্রামের পর গ্রাম প্রায়ই  নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তাহলে সেসব অঞ্চলের মানুষদের কী হবে? এছাড়াও দরিদ্র বাঙালি, দলিত, আদিবাসীদের অনেকেই খাস জমিতে বসবাস করেন, তাদের কোনও ধরনের জমি নেই। তাহলে তারাও কি বাদ যাবেন চাকরির অধিকার থেকে? চাকরির অধিকার কি তাহলে একেবারেই শ্রেণিগত?

এখন যদি আমরা বিশ্লষণ করি কেন এই স্থায়ী ঠিকানার বিধান তাহলে কী দেখতে পাই, বাংলাদেশের সংবিধানের ২১, ২৯, ১৩৩ ও ১৩৬ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রে নিয়োগের নিয়মাবলি আছে।

এ বিষয়ে আইনের ৭ নম্বর ধারায় সরকারের বিভিন্ন কর্মবিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিধানের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে,  ‘বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এমন কোনও ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। কবে সেখানে স্থায়ী নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে তার জমি থাকা এমন কোনও কথা লেখা নেই। তাহলে নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে ভূমির মালিকানা কবে থেকে কীভাবে চাকরির শর্তে যোগ হলো?

যদি ভূমির মালিকানা না থাকলেও কেউ ভোটার হতে পারেন, তিনি ভোট দিতে পারেন, তার জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে পারে তবে তিনি সরকারি চাকরিতে কেন তার স্থায়ী ঠিকানা লাগবে?

তাই রাজু, কলিন্স, আপসিয়া কিংবা মীমের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকামিত হলেই সেই সমস্যার সমাধান দিয়ে বাহবা পাওয়ার চেয়ে আরও বেশি কার্যকর হবে যদি এই বিষয়ে বিদ্যমান নিয়মটি স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করা যায়। অর্থাৎ স্থায়ী ঠিকানা কোনোভাবেই ভূমি কেন্ত্রিক না হওয়া এবং ব্যক্তি স্থায়ী নাগরিক কিনা সেটি খতিয়ে দেখার ভিন্ন পদ্ধিত অবলম্বন করা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ