X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে মৃত্যু আমাদের কাঁপায়, কাঁদায়

জোবাইদা নাসরীন
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:৪৪আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:৪৪

জোবাইদা নাসরীন ছেলেটি আমাদেরই শিক্ষার্থী, আমাদেরই সন্তান। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনও শিক্ষার্থীর মৃত্যু ভীষণভাবে আমাদের কাঁপায়, কাঁদায়, আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে। এর মানে এই নয় যে অন্যকোনও মৃত্যুকে আমরা সহজেই মেনে নেই।

আসলে এই শিক্ষার্থীদের অনেকের সঙ্গেই আমরা দীর্ঘ সময় কাটাই। তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অনেক সংগ্রাম এবং জীবনযুদ্ধের কথা জানা হয়। সেই সাথে আমাদের শোনায় তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের তাগাদা, তাদের পরিবারের একটি মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের স্বপ্নের কথা। তাই হিমেলের মৃত্যুর খবর দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু বকরের কথা।

ছাত্রলীগের দুটো গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে মারা গিয়েছিল আবু বকর। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকেই এসেছিল আবু বকর। তার বাবা ছিলেন দিন মজুর। আমাদের বিভাগের এক শিক্ষার্থী যখন গত বছর করোনায় মারা গেলো, তখন তার মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম, সেই ছেলে মাকে বলেছিল, ‘আর তো মাত্র দু’ বছর মা, একটু কষ্ট শুধু, তারপর আমি চাকরি পেলে ঘর করে দেব।’

কেন এই মৃত্যুগুলো আমাদের বেশি ভাবায়, কারণ শুধু আবু বকরই নয়, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই আসে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে। এটাই হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। শুধুমাত্র পড়াশোনার খরচই নয়, পুরো পরিবারকে চালানোর এক বড় দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আসে। আর স্বপ্ন বোনে একটু স্বচ্ছলতার। আকাঙ্ক্ষা থাকে অভাবের চাপে অল্প বয়সেই শীর্ণ হয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের চিকিৎসার টাকা আর ভাই বোনদের পড়াশোনা চালানো। শিক্ষার্থীদের কাউকে কাউকে দেখেছি চাকরি পেয়েই ছুটে এসেছে আর আর চোখ ছলছল করে বলেছে, ‘ম্যাডাম, এবার বাবা-মাকে একটা ঘর তুলে দিতে পারবো’। ওরা শুধু কাঁদে না, কাঁদায় আমাদেরকেও। তাই হিমেলদের মৃত্যুতে চোখ হয়তো বেশি জ্বালাপোড়া করে।

মাহবুব হিমেলের মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তাই্ ছেলেকে নিয়ে কী কী স্বপ্ন বুনেছিলেন সেটি জানা হয়নি। মাহবুব হিমেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক্স ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি যে, বাবা হারানো হিমেল ছোটবেলা থেকেই বুঝে গিয়েছিল তার দায়িত্ব। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এক অর্থে পরিবারের হাল ধরেছিল। কখনও ছবি এঁকে, কাঠ দিয়ে নানা শিল্পকর্ম করে সেগুলো বিক্রি করে নিজের জীবনের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি মায়ের খরচ মেটাতো। মৃত্যুর আগেও মাকে পাঠিয়েছিল টাকা।

আমরা জেনে গেছি সেই হিমেল আর নেই। তার দেহ জর্জরিত হয়ে গেছে ক্যাম্পাসেরই নির্মাণাধীন একটি একাডেমিক ভবনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকের চাপায় পড়ে। এই সত্য মেনে নেওয়া আরও কঠিন যে সেই ট্রাক বিচ্ছিন্ন করেছে তার দেহ এবং মাথাকে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠির মৃত্যুর ঘটনা শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করে এবং ছয়টি ট্রাকে আগুন দেন। তারা নির্মাণাধীন সেই স্থাপনা ভাংচুরও করে এবং পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে। এবং উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছিল। সেই ট্রাক গত রাতে সেই ড্রাইভারকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ভারী যান না চালোনার জন্য নিয়ম করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছিল। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দিয়ে চলাচল করা ট্রাকের ড্রাইভারের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের দু’শিক্ষার্থী। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু সময়ের জন্য রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। জানা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন রাস্তায় একশো সেকেন্ডে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টি মালবাহী ভারী ট্রাক অতিক্রম করতে দেখা যায়।

আমরা সবাই জানি যে, ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের টিএসসি গেট, মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, ভিসি চত্বর, দোয়েল চত্বর, কার্জন হল, রোকেয়া হল ও গ্রন্থাগার গেটের সামনের এলাকা, রাজু ভাস্কর্য ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ্ববর্তী এলাকাসহ কার্জন হল পর্যন্ত রাস্তাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর সাথে বর্তমানে যোগ হয়েছে মেট্রোরেলের কাজ।  সতর্ক না থাকলেই  শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হবে ভয়াবহ দুর্ঘটনার। এর বাইরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নির্মাণাধীন ভবনের নির্মাণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারদের কাজ দিয়েই শুধুমাত্র কতটুকু কাজ হয়েছে সেটিই দেখাশোনা করে। কিন্তু এই কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ও দেখা হয় না। এর আগে জগন্নাথ হলের একটি ভবন মেরামতের সময় শ্রমিকের সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা না থাকায় উঁচু ভবন থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন শ্রমিক। ঠিক একই ভাবে এই নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত সকল কিছু তদারকিসহ কী কী দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তার আগে থেকেই মাথায় রেখে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি বাদে ভারি যান চলাচল পৃথিবীর সব জায়গায় নিষেধ এবং নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত সকলকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশেই একমাত্র ঠিকাদারদের হাতে নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েই আমরা নিজেদের দায়িত্ব শেষ করি। আর তালা গুণে দালানটির কাজ শেষ হয়েছে কিনা সেটিই যাচাই করি। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে আমরা আর কিছুই দেখতে পাই না, চাই না। যখন হিমেলদের লাশ আমাদের চোখের সামনে আসে তখনই আমরা আহাজারী আর বিলাপ করি। এর বাইরে আমাদের নড়াচড়া খুবই সীমিত, খুবই রাজনীতি কেন্দ্রিক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা একটি ক্যাম্পসের সবচেয়ে বড় গুরুত্বের জায়গা হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ