X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমির হামজাই ‘যোগ্যতম’ ব্যক্তি স্বাধীনতা পুরস্কারের

রুমিন ফারহানা
২০ মার্চ ২০২২, ২১:০৫আপডেট : ২০ মার্চ ২০২২, ২১:০৫

রুমিন ফারহানা ‘বাঘের থাবা’ কিংবা ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ নামের কবিতা এবং পালাগানের সংকলনের নাম আপনি শুনেছেন কি? পড়া হয়েছে বই দুটি? সত্য স্বীকারে বাধা নেই। এই বই দু’টি পড়া দূরেই থাকুক, নামও শুনিনি আমি। এই না জানা জনিত অজ্ঞতার দায় মাথায় নিয়ে বলি, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অতি মনোযোগী ‘সর্বভুক’ পাঠকও বইগুলোর নাম শুনেছেন বলে মনে হয় না। ঠিক যেমনটি শোনা হয়নি বই দুটির লেখক আমির হামজার নাম। যতদূর জানা যায়, কোনও জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কখনও তার কোনও লেখা ছাপা হয়নি। অবশ্য জাতীয় পত্রিকায় লেখা ছাপা না হলেই যে তিনি লেখক নন, তেমনটি বলা যায় না। কিন্তু গোল বাধলো যখন সাহিত্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পেলেন তিনি। যদিও সে পুরস্কার পরে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।    

মজাটা হলো, গোল বাধালেন তারাই যাদের বেশিরভাগই সরকারের সব সিদ্ধান্তেই মোটামুটি সহমত পোষণ করেন। সরকারের কোনও অনিয়ম, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে তাদের আওয়াজ শোনা যায় না তেমন একটা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো মূলধারার গণমাধ্যমেও। প্রথম আলো রিপোর্ট করলো ‘সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া কে এই আমির হামজা?’ শিরোনামে। সেখানে স্বাধীনতা পদকের মতো সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা আমির হামজার মতো একজন অচেনা সাহিত্যিক পাওয়ায় ক্ষুব্ধতা ব্যক্ত করে সাহিত্যিক মহল। সেলিনা হোসেনের কাছে আমির হামজা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ছুড়ে দেন উল্টো প্রশ্ন, ‘উনি কে? আমি তো তাঁকে চিনি না।’ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘একজন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়। যাঁরা তাঁকে পুরস্কার দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ভালোবেসেই দিয়েছেন। তবে আমি তাঁর কোনও বই পড়িনি বা নামও শুনিনি। এ আমার অপূর্ণতা। আমি চেষ্টা করবো, তাঁর বই সংগ্রহ করার।’

আমির হামজা সম্পর্কে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদার কাছে জানতে চাইলে তিনি এই নামে কোনও সাহিত্যিকের নাম শোনেননি বলে জানান। এই নামের ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জানানো হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সাহিত্যে আমির হামজা সম্মাননা পেয়েছেন শুনে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, সপ্তদশ শতকের কবি আমির হামজাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সম্মাননাটি পেয়েছেন একজন মরণোত্তর ব্যক্তি। পরে দেখলাম, এ অন্য এক আমির হামজা, যিনি সাহিত্যিক মহলে পরিচিত নন এবং তাঁর কাজ সম্পর্কেও কেউ কিছু জানেন না।’

আমির হামজার এই পদক প্রাপ্তি তাদের সত্যিই কতটা অবাক করেছে জানি না, কিন্তু তাদের অভিব্যক্তি আর বক্তব্য ভীষণভাবে অবাক করেছে আমাকে। আমি বিস্মিত হয়েছি তাদের বিস্ময় দেখে। তাদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, দেশের সবকিছু সঠিক পথে সঠিকভাবে অসাধারণ রূপে চলতে চলতে হঠাৎ এই ছন্দপতন। যেন সব ক্ষেত্রে যোগ্য লোক যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে তার প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছেন কিংবা রাজনৈতিক বা অন্য কোনও বিবেচনায় কাউকে তার প্রাপ্যের বাইরে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।

পুরস্কার বা সম্মান সরিয়েই রাখি। এ দেশে কোন বিষয়টা নিয়ম মাফিক হয়? পাঁচ বছর পর পর মাত্র একদিনের রাজা হওয়ার যে সুযোগটা দেশের নাগরিকদের পাওয়ার কথা ছিল, সেটাও কি ঠিকমতো পায় তারা? পারে নিজের ইচ্ছামত পছন্দমাফিক নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে? জাতীয় নির্বাচন অনেক বড় বিষয়। এমনকি মানুষ ইউনিয়ন পর্যায়েও নিজের পছন্দ মাফিক প্রার্থী নির্বাচিত করতে কি পারে? এই বিষয়ে তো কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখি না, দেখি না বিস্ময় প্রকাশ করতে। অনেকে বলবেন এটা কেবল রাজনীতিবিদদের বিষয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু রাজনীতির বাইরে যে কিছুই নয়, রাজনীতি পচলে পচে সবকিছু, এটা যতদিন না বুঝবো ততদিন আমাদের মুক্তি নেই।

ভোটের কথা যদি সরিয়েও রাখি, এ দেশে খুব প্রচলিত একটা গল্প হলো আসামি নিয়ে অন্য অপরাধীদের ধরতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে অপরাধীরা গুলি চালালে পুলিশও গুলি করতে বাধ্য হয়, আর তাতেই প্রাণ হারান আসামি। এই গল্পের নাম কখনও ‘ক্রসফায়ার’, কখনও ‘বন্দুকযুদ্ধ’, কখনও বা ‘এনকাউন্টার’। বছরের পর বছর এই গল্প একই থাকে, পাল্টায় শুধু মানুষ। এই গল্প তো আমাদের অবাক করে না। এই গল্প নিয়ে মানুষ কি প্রশ্ন তোলে? অদ্ভুত, অসম্ভব এই গল্প মেনে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারলেই বাঁচে সবাই।

জোর করে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা মানুষদের স্বজনেরা প্রতি বছর মিলিত হয় ‘মায়ের ডাক’ নামক সংগঠনের ব্যানারে। আকুতি জানায় তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে। তাদের দাবি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী জোর করে তুলে নিয়ে গেছে তাদের স্বজনদের। তাদের সেই আকুতি কি সামান্য হলেও বিচলিত করে আমাদের? আমরা কি প্রশ্ন করি? ব্যক্তির অপরাধ এক জিনিস আর রাষ্ট্রের অপরাধ ভিন্ন জিনিস। রাষ্ট্রের এসব দেখে কি নাড়া দেয় আমাদের বিবেক? নাকি নিজে নিরাপদ আছি ভেবে স্বস্তিবোধ করি?

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমতে কমতে এখন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের  অবস্থান উগান্ডা, পাকিস্তান এমনকি মিয়ানমারের মতো দেশেরও পেছনে। অবশ্য এসব সূচকের প্রয়োজনও বা কী? চোখ-কান খোলা রাখা মানুষ মাত্রই জানেন, সরকারের মনঃপূত হবে না এমন মত প্রকাশ করা এই দেশে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো এক ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে সরকার কাবু করছে যাকে ইচ্ছে তাকে। অনেক সাংবাদিককে বিনা বিচারে জেল খাটানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, এমনকি সাংবাদিক কাজলের মতো অনেককে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল তাদের মত প্রকাশের জন্য। আর কার্টুন এঁকে কিশোর এবং সেই কার্টুনের ক্যাপশনে ছড়া লেখার অপরাধে মুশতাককে ধরে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন আর কারারুদ্ধ করে রাখা এবং শেষে কারান্তরীণ অবস্থায় মুশতাকের মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেছে কিছু দিন আগেই। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ করা দূরেই থাকুক, ন্যূনতম প্রশ্নও এদের কাউকে তুলতে দেখিনি।      

শুধু কি মত প্রকাশ? শক্তিমান কারও সঙ্গে সমস্যা হলে দুর্বলের ওপর প্রশাসন লেলিয়ে দিয়ে তাদের পুলিশি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন করা হয়, হয়রানিমূলক মামলায় ফাঁসানো হয়। বিএনপি’র অনেক কর্মীর জীবনকে মামলা দিয়ে দুর্বিষহ করে ফেলা হয়েছে শুধু তারা সরকারের প্রধান বিরোধী দল করে বলে। এটা যে শুধু রাজনৈতিক কর্মীর ক্ষেত্রেই ঘটে, সেটা নয়, শক্তিমানদের নিপীড়নের শিকার হন একেবারে নির্দলীয় মানুষও। আমার আইন পেশার সূত্রেই আমি জানি, আদালতপাড়া এমন সব নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ।

মাত্রই করোনার ভয়াবহ সময় পার করলাম আমরা। সেই দুঃস্বপ্ন পুরোপুরি কাটেনি এখনও। করোনা মানুষের জীবনকে যতটা না হুমকির মুখে ফেলেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের জীবিকা। কাজ হারিয়েছে বহু মানুষ, বেতন কমেছে অনেকের, স্থায়ীভাবে শহর ছেড়েছে বহু মানুষ। ব্র্যাক পিপিআরসি বলছে, নতুন করে ৩ কোটি ৪২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। আর সানেম বলছে, করোনার পর দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে ৪২ শতাংশ মানুষ। সরকার যদিও এই হিসাব মানতে নারাজ কিন্তু টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সারি বলে দেয় একদম ভালো নেই মানুষ। মানুষের এই ভালো না থাকা নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখি না সরকারের। তাদের কেউ ব্যস্ত জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ের হিসাব নিয়ে। আবার কেউ বা ব্যস্ত উড়াল সেতু, মেট্রোরেল কিংবা পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পের হিসাব নিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের সর্বনিম্ন বরাদ্দই বলে দেয় কতটা উদাসীন আমরা।  

আমির হামজা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা পাওয়ায় এতটুকু বিস্মিত হইনি আমি। বিস্মিত না হওয়ার কারণও খুব পরিষ্কার। জনাব হামজার ছেলে সরকারের একজন উপ-সচিব। বাবার মনোনয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা পদকের জন্য তো একটা নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করা লাগে। আমরা সেটা করেছিলাম। এরপর যেকোনও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা সরকারের যেকোনও সচিবের সেই আবেদনের পক্ষে সুপারিশ লাগে। আমার বাবা আমির হামজার জন্য সুপারিশ করেছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ স্যার’। এই দেশে একজন মধ্যম পর্যায়ের আমলা যখন চাইবেন তার বাবা স্বাধীনতা পদক পান এবং সেটাকে সমর্থন করবেন একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন আমলা, তখন সেই পদক তার না পাওয়ার কারণ তো নেই।  এটাই এখন বাংলাদেশ। খুব সচেতন মানুষ হওয়ার দরকার নেই, এ দেশে একটু চোখ-কান খোলা রাখা মানুষ মাত্রই জানেন কতটা দাপটে চলেন আমলারা।      

একটি পুরস্কার সঠিক মানুষকে দেওয়া হয়েছে নাকি হয়নি এই প্রশ্নে যাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, তাদের অনেকেই কী অসাধারণভাবে নির্বিকার থাকেন দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অসংখ্য অন্যায় আর অনিয়মে। রাষ্ট্রের কাঠামো একেবারে চুরমার করে ফেলা এসব অনিয়মের তুলনায় একজন অযোগ্য মানুষকে একটা পুরস্কার দেওয়া ঘটনা হিসেবে অতি তুচ্ছ।

আমাদের অনেকের মতেই হয়তো আমির হামজার সাহিত্যে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক পাবার যোগ্যতা নেই, অনেকেই ভাবছেন সাহিত্যে তার অবদান কী? আমি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করি, এই দেশে এখন যোগ্যতার যে যে মাপকাঠি আছে তার সব গুলোতেই কি তিনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ নন? তার নাম প্রস্তাব আর সমর্থনকারীর পরিচয়ই বলে দেয় সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আমির হামজা। যারা তার পুরস্কার প্রাপ্তিতে চোখ কপালে তুলেছেন তারা বোধকরি এ দেশে বাস করেন না।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ