X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সীতাকুণ্ডের আগুনে জ্বলছে সংবেদনশীল মানুষের বিবেক!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
০৬ জুন ২০২২, ১৬:২৯আপডেট : ০৬ জুন ২০২২, ১৭:১৯

যখন সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে লিখতে বসেছি তখন সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করলাম। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ৩০ ঘণ্টা পার হলেও  সীতাকুণ্ডের বেসরকারি বিএম কন্টেইনারের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। কিন্তু জানা যায় মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পঞ্চাশে! আজ দুপুরে জানা গেলো মৃতের সংখ্যাটি হবে ৪১। যদিও এ সংখ্যা আরও বাড়বে- এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ ৪১ জনের মধ্যে ১২ জন আছেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মী, যারা অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। শতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুকে পরাজিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু ও পরিবার-পরিজনদের আহাজারি আর অনিশ্চয়তার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পার্ক ভিউসহ বিভিন্ন হাসপাতালগুলোর ব্যস্ত করিডোর। মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আহতদের পরিবারকেও নানা কিস্তির সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ৭টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এসব তদন্ত কমিটির করার সময় ‘দ্রুততম সময়ে তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদানের জন্য’ বলা হয়েছে। আমরা জানি এই রিপোর্ট কখনোই প্রকাশিত হয় না কিংবা জনসমক্ষে আসে না। বিভিন্ন ‘তদন্ত কমিটি’ কেন্দ্রিক অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের তা-ই ভাবতে বাধ্য করে। এদিকে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সীতাকুণ্ডকে ‘ব্রেকিং’ আইটেম করে প্রচার করছে। পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে সেটা প্রশংসার যোগ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সংবেদনশীল মানুষের হা-হুতাশ চলছে পুরোদমে। যখনই বড় ধরনের কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে আমরা মোটামুটি এই একই অনুশীলন ও চেহারা দেখতে পাই। যেন একটা রুটিন কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উত্তর-অগ্নিকাণ্ড ব্যবস্থাপনার রিচুয়াল্স’। ‘ব্রেকিং নিউজের’ আল্টিমেট ‘ভোক্তা’ হিসাবে কিছুদিন আমরা গরম গরম এসব খবর ‘ভোগ’ করবো, কিছুদিন পর নতুন কোনও ‘ব্রেকিং নিউজ’ নিয়ে মেতে উঠবো। পোড়া লাশের গন্ধ আর আমাদের নাকে লাগবে না। শরমহীনভাবে নতুন কোনও গরম খবর নিয়ে উত্তেজনায় মেতে উঠবো। এভাবেই চলছে, এভাবেই চলবে। তাজরিন ফ্যাশনের শ্রমিকের পোড়া গন্ধ এখন আমাদের নাকে লাগে না। ঢাকার নিমতলীর ১২৪ জন শ্রমিকের পোড়া গন্ধ আমরা এখন আর পাই না। রানা প্লাজার ধ্বংসের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তচিৎকার আমাদের কানে এসে এখন আর পৌঁছায় না। স্মার্ট গার্মেন্টের পোড়া লাশ আমাদের স্মৃতিতে বিস্মৃতির বালুকাবেলায় বিলীন প্রায়। এমনকি গত জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস এবং বেভারেজের কারখানার অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গলে যাওয়া ৫২ জন শ্রমিকের চেহারা আমাদের চোখে আর ভাসে না। সীতাকুণ্ডে পুড়ে যাওয়া মানুষের কয়লাও আমাদের কাছে অতীত হয়ে যাবে নিকট ভবিষ্যতে। এভাবেই চলছে এবং যেন এভাবেই চলবে। কিন্তু এভাবে আর কত? আর কত মানুষের শরীর পুড়ে কয়লা হলে, শ্রমিকের লাশ পোড়ার এ সিরিয়াল বন্ধ হবে?

কন্টেইনার ডিপোতে কেন আগুন লাগলো এসব নিয়ে এখন নানা আলোচনা হবে। আগুন লাগার পেছনে কোন কোন দাহ্য পদার্থ ছিল কিংবা এসব দাহ্য পদার্থ সেখানে রাখার উচিত হয়েছে কিনা কিংবা সেখানে দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমিত আছে কিনা এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে। প্রায় সময় দেখা যায়, দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমোদন থাকে না। কিন্তু সেটা কখনোই আগুন লাগার ঘটনার আগে উন্মোচিত হয় না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, মানুষের শরীর পুড়ে কয়লা হওয়ার পর আমরা আবিষ্কার করি যে এখানে দাহ্য পদার্থ রাখারই কোনও অনুমোদন ছিল না। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ঘটনায় দেখা যায়, পুরো বিল্ডিংটাই ছিল অননুমোদিত। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পেছনের কারণ  হচ্ছে সেখানে রাসায়নিক পদার্থ মজুত ছিল। কিন্তু ডিপোতে আদৌ রাসায়নিক পদার্থ মজুত করার অনুমতি ছিল কিনা সেটার খোঁজ-খবর চলছে। ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কথা তাদের জানানো হয়নি।’ তাছাড়া এখনও কোনও রাসায়নিক পদার্থ আছে কিনা এবং কোথায় কোথায় আছে, এটাও তারা জানেন না। ডিপোতে যে রাসায়নিক পদার্থ আছে, এর তথ্য ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীদের কাছে থাকলে, হয়তো যে ১২ জন অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজেরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, তাদের সংখ্যাও কম হতে পারতো। তাহলে এর দায়-দায়িত্ব কার? ইতোমধ্যে বিস্ফোরক অধিদফতরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, “বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনও অনুমতি নেই”। কিন্তু অনুমোদনের বা অনুমোদনহীনের এ তেলেসমাতি আমরা কেন ঘটনা ঘটার আগে জানি না বা জানাতে পারি না।

তাহলে, ৪১ জন মানুষের এ নির্মম মৃত্যুর দায় কার? শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই মানুষের এ অপূরণীয় ক্ষতির পূরণ হয়ে যায়? ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে একটা জীবনের বিনিময় হয়? টাকাওয়ালারা টাকা দিয়ে মানুষ কিনবে, মানুষের জীবন কিনবে, এটা ‘দাসযুগের ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি’ হিসাবে জারি ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও এই ‘দাসযুগের’ ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি বলবৎ থাকবে? এর চেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর কী হতে পারে!

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে আমরা বুঝে কিংবা না-বুঝে ভুল করে বা সচেতনভাবে এগুলো ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে চালিয়ে দিই। কিন্তু ‘দুর্ঘটনা’ হচ্ছে দায় এড়ানোর একটা কৌশল। কেননা, ‘দুর্ঘটনা’ বলে এরকম একটি ভয়াবহ ঘটনার তীব্রতাকে আমরা হালকা করে দিই। এবং নিয়তির দোহাই দিয়ে, ‘দুর্ঘটনা তো হতেই পারে’ কিংবা ‘দুর্ঘটনা তো আর বলে-কয়ে আসে না’ প্রভৃতি বলে দায়ীদের অপরাধ পাতলা করার চেষ্টা করি।

ফলে, দায়ীরা পার পেয়ে যায়। কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে মহামানব সেজে সমাজে বহাল তবিয়তে দিন কাটায়। নতুন করে ব্যবসা শুরু করে নতুন করে বিত্তবৈভবের মালিক হয়। নতুন করে নতুন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার নতুন আয়োজন করে! কেননা, এসব ঘটনার কোনও সুষ্ঠু বিচার হয় না। ১৯৯০ সালে সারাকা পোশাক কারখানায় আগুন লেগে আগুনে দগ্ধ হয়ে পোড়ে কয়লা হয়েছিল ৩২টি তাজা প্রাণ। আজকে ২২ বছরেও তার কোনও বিচার হয়নি। দোষীদের কোনও ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে, তারা সমাজে বহাল তবিয়তে আছে। একইভাবে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনারে পুড়ে যাওয়া লাশগুলোর হাহাকারও কোনও ন্যায়বিচারের আলো দেখবে কিনা সে সন্দেহ অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে জন্ম দেয়। বিচারহীনতার এ ‘সন্দেহ’ এবং ‘সংশয়’ কোনোটাই মানুষ, মানবতা এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে সুখকর নয়। তাই এর পরিবর্তন জরুরি। কেননা, এ পরিবর্তনই পোড়া মানুষের অভিশাপ থেকে এ সমাজকে মুক্তি দেবে। আমরা এখনও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয় বলেই, সীতাকুণ্ডের আগুনে জ্বলছে এ দেশের সংবেদনশীল মানুষের বিবেক।  

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

             

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ