X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিটি উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হোক ‘মাটির আলো’

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
৩১ আগস্ট ২০২২, ২১:১৫আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২২, ২১:১৫

বাংলাদেশে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে এখন পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে– বাংলাদেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে এই মুহূর্তে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের মতো। এরমধ্যে ৬০ ভাগ মামলা জমিজমার বিরোধ সংক্রান্ত। প্রধানত ৬টি কারণে ভূমি সংক্রান্ত মামলা হয়– ১) পারিবারিক বিরোধ, ২) জমির স্বল্পতা ও চাহিদা বৃদ্ধি, ৩) সীমানা নির্ধারণ, ৪) জমি দখল, ৫) সচেতনতার অভাব এবং ৬) ভূমি জরিপ বা রেকর্ডে তথ্য বিভ্রাট।

উপর্যুক্ত সব কয়টি সমস্যার সমাধানই স্থানীয় ভূমি অফিস বা এসিল্যান্ড অফিস থেকে করা সম্ভব। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধগুলোয় সাধারণ ইন্ধন দেয় প্রধানত স্থানীয় রাজনীতিবিদরা। তারা ওই বিরোধগুলো জিইয়ে রাখার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। কেউ কেউ উপরি ইনকামও করে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ডের সুসম্পর্ক থাকে, তাই উপর্যুক্ত ভূমি সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধগুলো তারা খুব সহজে রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে স্থানীয় সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারেন। সীমানা নির্ধারণ ও জমি দখল সংক্রান্ত বিরোধগুলোও তারা চাইলে মিটাতে পারেন। কারণ, সাধারণ জনগণ ইউএনও ও এসিল্যান্ডকে খুবই সমীহ করেন। তারা যদি ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেন এবং ছোটখাটো বিরোধগুলো অঙ্কুরেই মীমাংসা করার উদ্যোগ নেন, তাহলে ওই বিরোধগুলো বড় সংঘাতের দিকে যাবে না। মামলা মোকদ্দমায় গড়াবে না।

ভূমি জরিপ ও রেকর্ড তথ্য বিভ্রাটের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় ভূমি রেকর্ড করার সময় নাম, পিতার নাম ভুল লেখা হয়েছে অথবা একজনের জমি অন্যজন তার নামে রেকর্ড করেছে। দলিল দস্তাবেজ দেখে স্থানীয় ভূমি অফিসে রেকর্ড সংশোধনের সুযোগ থাকলে এই ছোটখাটো কাজের জন্য দেওয়ানি আদালতের দ্বারে দ্বারে মানুষকে ঘুরতে হতো না। স্থানীয় ভূমি প্রশাসক হিসেবে এসিল্যান্ড চাইলে এই বিরোধ মেটাতে পারেন। ভূমি সংক্রান্ত আইন খুব পরিষ্কার, তাই একজনের জমি অন্যজনের নামে বৈধভাবে রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আইন না জানার কারণে আইন ভঙ্গ করে, বিরোধে জড়ায়, মামলায় যায়। প্রকৃত তথ্য ও আইন জানলে তারা জমি সংক্রান্ত মামলার মতো দীর্ঘ মামলায় জড়াতো বলে মনে হয় না। তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন করা দরকার সবার আগে।

প্রশাসনের কর্মকর্তারাও যে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার বিষয়টি বুঝতে পারছেন তা মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার নানা উদ্যোগ থেকে স্পষ্ট হয়। এমনই একটি উদ্যোগ নিয়েছেন বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার এসিল্যান্ড সাবরিনা শারমিন। তিনি তার অফিসকে শুধু দালালমুক্ত করেছেন তা নয়; বরং ভূমি সেবাকে সহজ করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ওই কর্মকর্তা ভূমি সেবাকে সহজ করতে প্রধানত পাঁচটি কাজ করেছেন:  ১) মাদকের আখড়া বলে খ্যাত গোসাই মহারাজের পরিত্যক্ত গোসাই কাচারি দখলমুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাটির আলো নামের পাঠাগার; ২) ওই পাঠাগারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বই ছাড়াও ভূমি আইন সংক্রান্ত নানা বই, দৈনিক পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন রাখার ব্যবস্থা করেছেন; ৩) জমিজমা সংক্রান্ত তথ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছেন। লাইব্রেরিতে তথ্য ফরম রাখা আছে, উক্ত ফরম পূরণ করে যে কেউ ভূমি সংক্রান্ত তথ্য পেতে পারে সহজে। ৪) ভূমি অফিসে রক্ষিত ভূমি সংক্রান্ত সব তথ্য স্তর মতো সাজিয়েছেন।

ফলে যে কেউ ভূমি সংক্রান্ত তথ্য বা ডকুমেন্টস চাইলে অফিসের কর্মকর্তারা স্বল্প সময়ে ও সহজে তা সরবরাহ করতে পারেন, ৫) ভূমি অফিস সংলগ্ন পরিত্যক্ত জমিতে ফুলের বাগান করেছেন, যা দেখে সাধারণ মানুষ তার বাড়ির আশপাশে ফেলে রাখা পরিত্যক্ত জমি আবাদে উৎসাহিত হয়।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ফলে সাধারণ মানুষ যে খুব সহজে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে তা বলা যায়। পাশাপাশি তারা ভূমি সংক্রান্ত যেকোনও বিষয় পাঠাগারের বই থেকে জানতে পারবে। ঠিক তথ্য তাদের কাছে থাকলে, আইন জানলে তারা ভূমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিরোধে জড়াবেন না। পাশাপাশি জমির বা কোর্টের দালালদের নিকট থেকে ভুল তথ্য বা আইনগত ব্যাখ্যা জেনে প্রায়শই সাধারণ মানুষ যে মামলায় জড়ায় তা বন্ধ হবে। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে নিযুক্ত কতিপয় কর্মকর্তা প্রায়শই সাংবাদিক পিটিয়ে, দুর্নীতিতে জড়িয়ে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, সেখানে বগুড়ার শেরপুরের এসিল্যান্ডের এমন উদ্যোগ নিশ্চয় প্রশংসনীয় ও স্বীকৃতির দাবি রাখে।

উক্ত কর্মকর্তার মতো বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা নানাভাবে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। কিন্তু সবাই যদি বগুড়ার শেরপুরে প্রতিষ্ঠিত মাটির আলোর উদাহরণ সামনে রেখে উপজেলায় একটি ভূমি সংক্রান্ত লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, ভূমি সংক্রান্ত তথ্য বিনামূল্যে ও ভূমি সংক্রান্ত ডকুমেন্টস সহজে ও স্বল্প সময়ে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন তাহলে প্রতিটি উপজেলায় ভূমিসেবার আমূল পরিবর্তন হবে।

সাধারণ মানুষ সহজে ভূমিসেবা পাওয়ায় ভূমি সংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে মামলা মোকদ্দমা করা থেকে বিরত থাকবেন। অবশ্যই এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয় ও সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তারা বগুড়ার শেরপুর উপজেলার উদাহরণ অনুসরণ করে সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ভূমি সংক্রান্ত লাইব্রেরি “মাটির আলো” প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষকে স্বল্প সময়ে ও সহজে ভূমি সংক্রান্ত সেবা প্রদানের উদ্যোগ নিতে পারে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সারা দেশে ভূমি লাইব্রেরি মাটির আলো প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার তথা ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে জোর দাবি জানাই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ