X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোটের আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য প্রযুক্তি ইভিএম

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৪৯আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৩৫

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা সংক্ষেপে ইভিএম। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর মাধ্যমে আজকাল নির্বাচন পরিচালিত হয়। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় বলে এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত। পদ্ধতিটির অন্য নাম ‘ই-ভোটিং’। দেশজুড়ে আলোচিত একটি নির্বাচনি অনুষঙ্গ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের সর্বত্র তথ্য-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার ছাড়া কোনও ক্ষেত্রেই এখন আর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনে ব্যবহৃত প্রচলিত পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। ব্যালট পেপার পদ্ধতিতে ভোটদান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করতে অর্ধেক আসন তথা দেড়শ’ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ মানে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশের গতিকে ত্বরান্বিত করা।

ইভিএম পদ্ধতিতে একজনের ভোট অন্যজন কর্তৃক প্রয়োগ, জালভোট এবং একাধিক ভোটদানের সুযোগ নেই। ভোটের জন্য নির্ধারিত সময় ব্যতীত অন্য কোনও সময়ে এই মাধ্যমে ভোট দেওয়ারও সুযোগ নেই। ভোটারের আঙুলের ছাপের পরেই কেবল ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়। এখানে কারচুপির সুযোগ নেই। দেশে পুরাতন পদ্ধতির পরিবর্তে ইভিএমে ভোটদানই অধিক উপযুক্ত। বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারকে নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হলো ইভিএম। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে এই মেশিনে কেউ একটি ভোটও প্রয়োগ করতে পারবে না। এগুলো ভোটে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রধানতম দিক। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ও কমে আসবে।

তবে সাম্প্রতিককালে ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন অনুষঙ্গকে গ্রহণ করতে দ্বিধায় ভুগছে দলগুলো। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের মতো সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও আমরা গুজবের ছড়াছড়ি দেখেছি। সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশের সংযুক্তি নিয়ে উদাসীনতা সমগ্র জাতি লক্ষ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশে প্রযুক্তিগত উন্নতি মানুষের জীবনমানকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শহর থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও উপকৃত হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন কাজ সহজ থেকে সহজতর করেছে এসব প্রযুক্তিগত উপাদান। অনেকের ভয় ও উষ্মার অন্যতম কারণ হলো তাদের প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া প্রশংসনীয় ও গর্বের বিষয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে এই মেশিনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পদ্ধতিটি জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইভিএম যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। পদ্ধতিটি দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে উজ্জ্বলতর করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

ইভিএম পদ্ধতিতে প্রথম ভোটগ্রহণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেটি ১৯৬০ সালের ঘটনা। পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ক্রমেই ইভিএম মেশিনের সক্ষমতা বেড়েছে। এখন প্রযুক্তির এই বিপ্লবের যুগে ইভিএম যেকোনও পর্যায়ে ভোটগ্রহণের জন্য আস্থার মাধ্যম হিসেবে পরিচিত হয়েছে। যার ফলে পৃথিবীর উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি চালু রয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স ও জাপানের মতো অনেক দেশে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হয় এমন দেশের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশও প্রযুক্তিগত দিক থেকে সেই সক্ষমতার পরিচয় দেবে। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক চর্চার পথ আরও মসৃণ হবে। ইভিএমের মাধ্যমে শুধু যে ভোটগ্রহণই সুষ্ঠু হবে তা নয়, আমাদের দেশে ভোটের সময় ব্যালট পেপারের জন্য ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ কাগজও অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সেই বিবেচনায় ইভিএম পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধবও বটে। এছাড়াও হানাহানি, মারামারি, সন্ত্রাস, খুন, ভোট ডাকাতি ইত্যাদি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে।

এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ইসিআই প্রথম ১৯৮২ সালে কেরলের উত্তর পারাভুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কিছু ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করেছিল। পরে দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের নির্বাচনি এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করা হয়। সফল হওয়ায় ১৯৯৯ সালে গোয়া বিধানসভা সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৩ সালে সব উপনির্বাচন এবং রাজ্য নির্বাচন ইভিএম ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর, ইসিআই ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের জন্য শুধু ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কাগজের ব্যালটগুলো বাতিল করে দেয়।

আমরাও ধাপে ধাপে ইভিএম ব্যবহার করছি। এখন যারা ইভিএমের বিপক্ষে কথা বলছেন তারা কিন্তু এর চেয়ে উন্নত কোনও পদ্ধতির সন্ধান দিতে পারেননি। আমাদের দেশের একটি উদাহরণ দিলে দুটি পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার চিত্র বোঝা যাবে। ব্যালটের নির্বাচনে যেখানে তিন থেকে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত ভোট গুনতে সময় লাগে, সেখানে ইভিএমে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রে মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই ফল ঘোষণা করা সম্ভব। ২০১০ সালের জুনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। সেবার মোট ২৫ হাজার ২৩৮ জন ভোটার ইভিএমে ভোট প্রদান করেন। তখন দ্রুত ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণায় ইভিএম পদ্ধতির সফল কার্যকারিতার প্রমাণ মেলে। তবে কিছু ত্রুটির কারণে নির্বাচন কমিশন ২০১৫ সালে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। ২০১৬ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেশিনগুলো পুনরায় চালু করা হয়। যথারীতি সেবার ইভিএম পদ্ধতি সফলতার মুখ দেখে। এরপরে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত ছয়টি আসনে মেশিন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। পদ্ধতিটির বিপক্ষে যারা বলছেন তারা প্রকৃতপক্ষে বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক, ভিত্তিহীন ও খোঁড়া যুক্তি প্রচার করছেন। কাগুজে পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর্বগুলো আমাদের জানা। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ভোটগ্রহণকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ রাখতে ইভিএম পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা আরও বাড়বে। এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো গেলে দেশের সব রাজনৈতিক দলসহ মানুষ উপকৃত হবে।

ইভিএম পদ্ধতিতে একটি মেশিনের মাধ্যমে প্রায় চার হাজার ভোট দেওয়া যায়। সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা থাকে মেশিনটিতে। বাটন চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারেন। একটি ভোট দিতে আনুমানিক ১৪ সেকেন্ডের মতো সময় ব্যয় হয়। ভোটের তথ্য মেশিনে প্রায় ১০ বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। ইভিএম একটি ঝামেলাবিহীন এবং স্মার্ট প্রক্রিয়া। ভোটার ও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে ইভিএম। ইভিএম পদ্ধতিতে একজন ভোটার একবারই ভোট দিতে পারবেন। সাধারণ ব্যালট ভোটের মতো কেন্দ্রেও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকরা থাকবেন। পুরাতন পদ্ধতির সঙ্গে ইভিএম-এর পার্থক্য হলো– কাগজের ব্যালটে সিল দেওয়ার পরিবর্তে ভোটার পছন্দের প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট প্রয়োগ করবেন। ফলশ্রুতিতে ভোগান্তি কমবে সবার। পাশাপাশি কমবে আর্থিক অপচয়, সুরক্ষিত হবে পরিবেশ।

ইভিএম ব্যবহারের ফলে কোটি কোটি সংখ্যক ব্যালট ছাপানোর খরচ সাশ্রয় সম্ভব হবে। এ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ কাগজের খরচ, এসবের পরিবহনের ব্যয়, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ এমন অনেক ব্যয় সাশ্রয় হবে। ব্রাজিলে ইভিএমের কারণে নির্বাচনি ব্যয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে সঞ্চিত অর্থ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করার অনুমতি দেওয়া হয়, যা শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নানামুখী সুবিধার কথা চিন্তা করেই তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্ধেক আসনে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি জাতীয় নির্বাচনে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকার মতো বিরাট আর্থিক খরচ রয়েছে। অন্যদিকে ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা গেলে সেখানে প্রায় নয়শ’ কোটি টাকায় খরচ মেটানো সম্ভব। এটি একটি নির্বাচন আয়োজনের হিসাব। পুরাতন পদ্ধতির প্রতিটি নির্বাচনেই নতুন ব্যালট পেপার ও কাগজ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু একটি ইভিএম মেশিন বারবার নির্বাচনে ব্যবহার করা যায়। একই মেশিন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন বা উপনির্বাচনেও ব্যবহার করা যায়। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।

ইভিএমের নানা সুবিধার দিক বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে এই মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এই মেশিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা দ্রুত ভোট গণনা ও স্বচ্ছভাবে ভোট গ্রহণ। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করার পরিস্থিতি ইভিএম-এর ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের পাশাপাশি দ্রুত ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা সম্ভব একমাত্র ইভিএম-এ। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে কারচুপি বা জালিয়াতির সুযোগ নেই বলেও নির্বাচন কমিশন থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে। ফলে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’–এই স্লোগানের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ইভিএম-এর বিকল্প নেই।

এই মেশিনের ত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আহ্বানও জানানো হয়েছে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ব্যবহার করা হবে সবচেয়ে আধুনিক ইভিএম। যার ফলে এই মেশিনের কোনোরকম ত্রুটি ধরারও সুযোগ নেই।

এখন, গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনটি ভালো তা দেখতে ইভিএম এবং ব্যালট পেপারের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

 ১। ব্যালট বাক্সের তুলনায় ইভিএমগুলো পরিবহন করা সহজ। কারণ, এগুলো হালকা, বহনযোগ্য এবং পলিপ্রোপিলিন বহনযোগ্য কেসগুলোর সাথে আসে। যেখানে নিরক্ষরতা বেশি সেখানেও ভোটদান দ্রুততর হয়, লোকেরা ব্যালট পেপার সিস্টেমের চেয়ে ইভিএমকে সহজ বলে মনে করে।

২। ইভিএম দ্রুত ফলাফল ঘোষণা, ভোটের ভুল গণনা দূরীকরণ বা ভোট দেওয়ার পদ্ধতি সহজ ও স্বচ্ছ করে। অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন, ব্যালট পেপারে কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব। অথচ ইভিএমের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব নয় এবং এর নিরাপত্তা ব্যালটের চেয়ে অনেক বেশি। ইভিএম টেম্পারিং করার কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এখন পর্যন্ত এটি সম্ভব হওয়ার কোনও প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়।

৩। ভোটদানের পেপার ব্যালট পদ্ধতিতে যদি স্ট্যাম্পটি সঠিকভাবে স্থাপন করা না হয় তবে এটি একটি অবৈধ ভোট হিসাবে গণনা করা হবে। ইভিএমের মাধ্যমে এই সমস্যা দূর হবে।

৪। ব্যালট পেপার কাগজের অপচয় এবং একটি বিজ্ঞানবিমুখ পদক্ষেপের দিকে পরিচালিত করে। এমনকি সবচেয়ে দূষণকারী শিল্পগুলোও যখন সবুজ হয়ে উঠতে এবং তাদের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার চেষ্টা করছে, তখন পরিবেশবান্ধব বিকল্প থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে এত বড় আকারে কাগজ ব্যবহার করা পরিবেশের প্রতি সরাসরি অবহেলা।

৫। ম্যানুয়াল ব্যালট গণনা সময়সাপেক্ষ। এটি একটি ক্লান্তিকর এবং ত্রুটিপ্রবণ কাজ। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে আনুমানিক ১০.৪২ কোটি নিবন্ধিত ভোটার ছিল এবং আগামী নির্বাচনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ম্যানুয়ালি ১২ কোটি ভোট গণনা করা বেশ কঠিন এবং ফলাফল গণনা করতে এবং আসতে অনেক দিন সময় লাগে।

তবে, ইভিএমের বিপক্ষে যারা মত দিচ্ছেন, তারা এ মেশিনের সুবিধা-অসুবিধা পূর্ণাঙ্গ যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাজনৈতিক স্বার্থে এর বিপক্ষে এজেন্ডা বাস্তবায়ক হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি কথিত এক প্রযুক্তিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ একটি জাতীয় দৈনিকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কয়েকটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করেছেন। চ্যালেঞ্জগুলো হলো, নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যশালা এখনও তৈরি হয়নি, যন্ত্রটি বায়োমেট্রিক সঠিকভাবে নেয় না, একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডাটাবেজ নেই, কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা, ইন্টারনেট সংযুক্ত না থাকলে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, ইভিএম হ্যাং করাসহ আরও কয়েকটি।

প্রথম চ্যালেঞ্জের উত্তর হলো, দেশে অধিকাংশ নাগরিকের এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যশালা তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে। কিছু সমস্যা আছে, এর সমাধানের পথ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেড়শ’ আসনে ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করা হবে, যা সম্পূর্ণভাবে সম্পাদনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তাই সমস্যা হবার কোনও কারণ নেই।

দুই, যন্ত্রটি বায়োমেট্রিক সঠিকভাবে নেয় না, এটা রাজনৈতিক বিরোধিতার এর নিছক বচন। গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এমন সমস্যা হয়নি বললেই চলে। এমন সমস্যা যদিও হয় নির্বাচন পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর সমাধান দিতে পারেন খুব সহজেই।

তিন, কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা, এটা তাদের সঠিক জানার ঘাটতি বলবো। কারণ, নির্বাচন পরিচালনা করতে কর্মকর্তা লাগবেই। তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক বুথে প্রতিটি প্রার্থীর নিজস্ব এজেন্ট থাকবে। এজেন্টের সামনে নির্বাচনি কর্মকর্তারা কীভাবে নির্বাচন ওভাররাইড করবে?

চার, ইন্টারনেট সংযুক্ত না থাকলে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, প্রতিটি মেশিনে নিজস্ব সক্ষমতার আলোকে তথ্য সংরক্ষণ করবে। এ জন্য দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের কোনও প্রয়োজন নেই।

পাঁচ, ইভিএম হ্যাং হলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ দ্রুত এর সমাধান দিতে পারবে। আবার কেউ কেউ পেপার ট্রেইলের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে বলবো, একজন ভোটারের ব্যালট অন্যদের থেকে গোপন রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি ইভিএমে ভোট দেন এবং সেটি আপনার ভোট প্রিন্ট করে, তাহলে আর গোপনীয়তা বজায় থাকে না। ইভিএম ব্যাটারিতে চলে এবং মুদ্রণ চার্জের সচল থাকার স্থায়িত্ব হ্রাস করবে। তাছাড়া পেপার ট্রেইল পরিবেশবান্ধবও নয়। এই কারণে, পেপার ট্রেইল সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা অপ্রয়োজনীয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ইভিএম নিয়ে আনীত প্রতিটি চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এগুলো গঠনমূলক নয়, বরং বিগত দিনের মতো বর্তমান সরকারের যেকোনও ভালো পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র মাত্র। যদি কোনও সমস্যা ইভিএম-এ থাকে, তাহলে সমাধানের পথ না দেখিয়ে, বন্ধ করা কোনও সমাধান নয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে সমালোচনাকারীরা একসময় এভাবেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের মাধ্যমে ও নিরলস পরিশ্রম করে দেশকে যখন অদম্য গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক এমন মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আবার ষড়যন্ত্র করছে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে আরও সচেতন থাকতে হবে। একজন প্রযুক্তির ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, আগামীতে সারা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনসহ সব ভোট ইভিএমে অনুষ্ঠিত হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ইভিএমই হোক আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার প্রকৃত মাধ্যম। আমার বিশ্বাস, অতীতের মতো এবারও ইভিএম ও নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে।

লেখক: অধ্যাপক, বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ