X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারীদের সক্ষমতা তৈরির বাজেট হোক

মানতাশা আহমেদ
০৯ জুন ২০২৩, ০০:৫৪আপডেট : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:৫৪

বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নারী। কাজেই জাতীয় বাজেটে নারীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিমাণ বরাদ্দ থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। সেদিক থেকে গত বছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেন্ডার খাতে আরও অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ব্যাপার।

তবে এর সার্থকতা অনেকটা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বরাদ্দকৃত অর্থ অতি দ্রুত পৌঁছানো এবং এর সঠিক ব্যবহার। তাছাড়া গত বছরের জেন্ডার খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের অগ্রগতির একটি রিপোর্ট থাকা অত্যন্ত জরুরি। ২০২০-২১ সাল থেকে এই রিপোর্টটি আর প্রকাশিত হয়নি। গত বছর জেন্ডার খাতে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার একশত তিন কোটি টাকা। এই অর্থ কোন কোন কর্মসূচিতে কীভাবে খরচ হয়েছে (বা আদৌ খরচ হয়েছে কিনা), এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং এর মাধ্যমে কতজন নারী উপকৃত হয়েছেন, তা জানতে পারলে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দের ব্যবহার আরও ভালোভাবে করা সম্ভব। একই সঙ্গে, নারীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার ও ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট স্টাডি হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেক্ষেত্রে মনিটরিং ও ইভ্যালিউশনের জন্য একটি বাজেট রাখা দরকার।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে নারীদের ক্ষমতায়ন ও কর্মদক্ষতা উন্নয়নের দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। স্মার্ট উদ্যোক্তা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে যেন উন্নত প্রযুক্তি ও মানসম্পন্ন এবং ‘নিড বেইজড’ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নারীদের টেকনিক্যাল এডুকেশনে আগ্রহী করার লক্ষ্যে নারী ভর্তির কোটা ১০ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত হলে এর মাধ্যমে অনেক নারী উপকৃত হবেন। অপর দিকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক পাঠালে তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে সার্ভিস সেক্টর, যেমন– নার্সিং, কেয়ার গিভার, গৃহপরিচারিকা, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবস্থাপনা, টেইলারিং, কৃষি ও অন্যান্য সেক্টরে প্রচুর জনবল প্রয়োজন। যেখানে আমাদের দেশের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। কাজেই নারীদের প্রশিক্ষণ খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেখান থেকে উপযুক্ত পরিমাণ যেন নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের কর্মোপযোগী জনসংখ্যার শতকরা আশিভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে জড়িত। এই খাতে প্রচুর নারীও কর্মরত আছেন। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের সুফল ভোগ করতে হলে এই খাতের উদ্যোক্তাদের নিবন্ধন করা অত্যন্ত জরুরি। ব্যবসা নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ নারীকেই যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা হলো ট্রেড লাইসেন্স। এটি বের করা এবং পরবর্তীতে প্রতি বছর নবায়ন করা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নারীদের ট্রেড লাইসেন্স সহজলভ্য করা এবং তা ১০ বছরের জন্য ইস্যু করলে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং কর প্রদানের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ দেশব্যাপী নেওয়া প্রয়োজন। এতে একদিক থেকে এসব উদ্যোক্তা ও কর্মজীবী নারী যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন, তেমনি একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী জাতীয় করের আওতায় আসবেন। তবে এই খাতের উন্নয়ন বা নিবন্ধনের ব্যাপারে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এ খাতের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার, অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার ও অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে এসব বাণিজ্য সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি ভালো বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামীণ পর্যায়ে বেশিরভাগ নারী ক্ষেতখামার, বাড়ির আশপাশে সবজি ও ফল গাছ লাগানো, মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালন ও অন্যান্য কৃষিকাজ নিয়মিত করেন। তবে অধিকাংশ নারীই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব নারীর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, উন্নত মানের বীজ, হাঁস-মুরগি ও পশুর খাবার, ওষুধ ইত্যাদি সরবরাহের মাধ্যমে উন্নত ফলন নিশ্চিত করতে পারবেন। এতে কৃষি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে এবং গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধ।

এজন্য কৃষি, পোলট্রি ও লাইভস্টক খাতে প্রশিক্ষণের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেখানে নারীদের জন্য বিশেষ কোটা রাখার প্রস্তাব করছি।

কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে স্মার্ট ফোন ও মোবাইল ডাটা সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে হবে। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোন তৈরির ওপরে বাড়তি ভ্যাট একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ অন্যতম ভূমিকা পালন করে। বিডা আয়োজিত ইনভেস্টমেন্ট সামিট ও ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল আয়োজিত দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা সম্মেলনের মতো আয়োজন এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কাজেই এ ধরনের সামিট আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট  মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকা দরকার। নারী দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘হি ফর শি’ কনসেপ্টে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে কোটা সিস্টেমে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে নারী উদ্যোক্তা ও কারুশিল্পীদের তৈরি মানসম্মত পণ্য রফতানি করার জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নত প্রশিক্ষণ লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবান্ধব পণ্য প্রস্তুত ও রফতানি করা যেতে পারে। এ ধরনের পণ্যের এখন অনেক চাহিদা। বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড এখন এ ধরনের পণ্য ক্রয় করতে বিশেষ আগ্রহী। একই সঙ্গে, এখানে ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন হস্তশিল্পের উৎপাদন ও রফতানি সম্ভব।  

সর্বোপরি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো প্রস্তাব করছি, যার অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন ২০২২-এ উঠে এসেছে–

১. বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে করের আওতায় আনতে কর দেওয়া ও ব্যবসা নিবন্ধনের কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে সে ব্যাপারে সতর্কতামূলক প্রচার, প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা।  

২. এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতকৃত পণ্যের মান  উন্নয়ন ও সরকারি ক্রয়ে নারী ভেন্ডরদের কোটা রাখা।

৩. নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সহজলভ্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রাপ্তি ও সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা।

৪. প্রতিটি বিভাগে ১ হাজার জন করে, ৮ বিভাগে মোট ৮ হাজার জন নতুন নারী উদ্যোক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা সহজ লভ্য ঋণ প্রদান।

৫. পুঁজি বাজারে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।

৬. সার্ভিস সেক্টরে নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ ও নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি করা– টুরিজম, আউটসোর্সিং, কেয়ার গিভার, মিড ওয়াইফ, নার্সিং, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি।

৭. বিভিন্ন বড় শিল্পের সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রিতে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও সংযুক্তিকরণ ও বেপজায় জমি বরাদ্দের বাপারে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তার সঠিক ও সময়মতো বাস্তবায়ন।

৮. মেগা প্রজেক্টে নারী শ্রমিক ও টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের অংশগ্রহণ।

৯. প্রযুক্তি ও ভারী শিল্প খাতে নারীদের উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা।

১০. নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সিসিটিভি ইন্সটলেশন ও মনিটরিংয়ের জন্য উপযুক্ত বরাদ্দ থাকলে নারীরা বাইরে কাজ করতে আরও নিরাপদ বোধ করবেন এবং বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে।

১১. ফ্যাশন সেক্টরে ইনোভেশন ও প্রশিক্ষণ– রিসাইক্লিং, লেদার ইত্যাদি। এছাড়া ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠী নারীদের প্রশিক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী তাঁত ও হস্তশিল্পের সংরক্ষণ ও বিভিন্ন পাহাড়ি খাবার প্রসেসিং।

১২. নারী উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স ১০ বছরের জন্য প্রদান করা।

১৩. মেডিক্যাল খাতে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট প্রশিক্ষণের জন্য যে বাজেট রাখা হয়েছে, তাতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা।

১৪. এগ্রো ও ফুড প্রসেসিং খাতে রফতানি বাড়ানোর জন্য নারীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ।


লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্যাশন ডিজাইনারস অব বাংলাদেশ (এএফডিবি); সভাপতি, বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল অব উইমেন’স ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (উইকি); পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ