X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিক্ষকদের প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

শ্যামল আতিক
১৭ জুলাই ২০২৩, ১৫:৩৫আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৩, ১৫:৩৫

একজন শিক্ষক যত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আলোকিত করার সুযোগ পান, একজন অভিভাবকের পক্ষে এই সুযোগ অনেক সীমিত। বিষয়টি একদিকে যেমন সম্ভাবনার, একই সঙ্গে শঙ্কারও বটে। কারণ, অভিভাবক ভুল করলে তা শুধু নিজের শিশুর ক্ষতি সাধন করেন, কিন্তু শিক্ষক ভুল করলে তা অসংখ্য শিক্ষার্থীর বিপর্যয়ের কারণ হয়।

প্রশ্ন হলো, যাদের কাঁধে আলোকিত করার এই গুরু দায়িত্ব, তাদের শিশু মনস্তত্ত্ব ও প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা? এক কথায় বললে– অবশ্যই আছে। কারণ, পাঠদানের ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় থাকে, যা একজন শিক্ষককে মাথায় রাখতে হয়।

একজন ভালো শিক্ষক কখনও এক শিক্ষার্থীকে অন্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে তুলনা করবেন না। কারণ, প্রতিটি শিশুই অনন্য, এখানে কারও সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তুলনা করলে শিশুমনে হীনম্মন্যতা ও সূক্ষ্ম ঈর্ষাবোধ জেগে উঠতে পারে। শুধু তুলনা কেন, কাউকে দৃশ্যমানভাবে স্নেহ করার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হয়। তা না হলে অন্য শিক্ষার্থীরা নিজেকে বঞ্চিত মনে করতে পারে অথবা শিক্ষকের আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট মনে করতে পারে। এছাড়াও জনসম্মুখে কোনও শিক্ষার্থীকে অপমান করা যায় না, এতে শিশু বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে।

পাঠদানকালে একজন শিক্ষককে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হয়। কেউ পড়াশোনায় ভালো করলে, মেধাবী বুদ্ধিমান ইত্যাদি বলে প্রশংসা করতে নেই। প্রশংসা করতে হবে সুনির্দিষ্ট গুণের কথা উল্লেখ করে, জোর দিতে হবে শিশুর প্রয়াসের ওপরে, ফলাফলের ওপরে নয়। গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেলে তাকে বলতে হবে– তুমি চেষ্টা করেছো বলে ভালো নম্বর পেয়েছো। “তুমি গণিতে ভালো”– এ ধরনের প্রশংসা করা যাবে না।

শুধু পরীক্ষায় ভালো করলেই শিশু মেধাবী, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। কেউ পড়াশোনায় ভালো, কেউ খেলাধুলায়, কেউ ছবি আঁকায়, কেউ ভালো লিখতে পারে আবার কেউ কেউ ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ।

শিক্ষকের প্রধান কাজ- কীসে শিশুর মেধা আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করা, সে অনুযায়ী তাকে পরিচালিত করা।

তাই শিশুর মেধা যাই হোক, কখনও ‘গর্দভ-বোকা-অলস-খারাপ’ ইত্যাদি নেতিবাচক কথা বলা যায় না। শিক্ষকের বক্তব্য শিশুর কোমল মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। শিশু যদি একবার মনে করে সে ‘বোকা/ গর্দভ/ কম মেধাবী’, পরবর্তীতে তাকে এই বিশ্বাস থেকে বের করে আনা খুব কঠিন।

শিশুদের ব্যাপারে কোনও কিছুই চূড়ান্ত নয়। কারণ, বিকাশের পর্যায়টি এখনও সম্পন্ন হয়নি। একটি শিশু কখন জ্বলে উঠবে- তা আমরা বলতে পারি না।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইন, এডিসনসহ আরও বহু প্রতিভাধর ব্যক্তির উদাহরণ দেওয়া যাবে, যারা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো করেননি, কিন্তু পরবর্তীতে তারা স্মরণীয় হয়েছেন।

ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের দুষ্টামি, চঞ্চলতা- এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। যদিও অনেক শিক্ষক প্রত্যাশা করেন যে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ভদ্র থাকবে, মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনবে। বাস্তবে ক্লাসে এ ধরনের পরিবেশ পাওয়া যায় না। কম বয়সী শিশুরা এমনিতেই কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির হয়, দুষ্টামি এদের স্বভাবগত। মাঝে মধ্যে সমস্যাপূর্ণ আচরণও করতে পারে। যেহেতু প্রতিটি শিক্ষার্থী ভিন্ন ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশ থেকে এখানে এসেছে, তাই এদের সবার কাছ থেকে একই রকম আচরণ প্রত্যাশা করা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। তবে সমস্যাপূর্ণ আচরণকে শিক্ষকরা কীভাবে সামাল দেবে– এটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

স্কুলে শিশুরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। যেমন, কম মেধাবী শিশু সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনায় তাল মেলাতে পারে না, অতি মেধাবী শিশুরা ক্লাসের পড়াকে সহজ মনে করে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, বুলিংয়ের শিকার হলে শিশু স্কুলে যেতে চায় না, শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী হলে শিশু অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না, ক্ষুধা/ পুষ্টিহীনতা থাকলে ক্লাসে মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়, পরিবারে সমস্যা থাকলে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না ইত্যাদি।

কেন একটি শিশু পরীক্ষায় ফেল করে? কেন সে দুষ্টুমি করে? কেন সে মনে রাখতে পারছে না? কেন সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না– এসবের নেপথ্যে কিছু কারণ থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কারণগুলো পরিবারে নিহিত থাকে। একজন শিক্ষকের কাজ এই বিষয়গুলো খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। কোন পরিস্থিতিতে কী ব্যবস্থা নেবেন– এটা শিক্ষককে জানতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রশিক্ষণ থাকলে, তিনি ছোটখাটো মানসিক সমস্যাকে বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।  

শিশু যদি স্কুলে যাওয়ার সময় আস্তে ধীরে যায়, ক্লাসের পাঠদানের সময় আগ্রহ ও উদ্দীপনার অভাব দেখা দেয়– তাহলে বুঝতে হবে স্কুলের পড়াশোনা শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে অথবা স্কুলের পরিবেশ শিশুর জন্য আনন্দদায়ক নয়। এক্ষেত্রে স্কুলের পরিবেশ ও পাঠদান পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা যেতে পারে। কেউ আমাকে পছন্দ করে না, খেলাধুলায় নিতে চায় না- এ ধরনের কথা শিশুরা বলতে পারে। মাঝে মধ্যে এটা হতেই পারে। কিন্তু যদি প্রায়শ এসব কথা বলে বুঝতে হবে শিশু অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারছে না অথবা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে অথবা শিশুর মধ্যে এমন কিছু আচরণগত ত্রুটি রয়েছে, যার ফলে অন্য শিশুরা তাকে এড়িয়ে চলছে।

যদি বুঝতে পারেন শিশু বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, তাহলে ভিকটিম ও দায়ী দুজনকেই কাউন্সেলিং করতে হবে। প্রয়োজনে পুরো ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে হবে। ক্লাসের পাঠদানকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন শিশুদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং মানবিকতা জাগ্রত হয়। কিন্তু সমস্যার কারণ যদি ত্রুটিপূর্ণ লালন পদ্ধতি হয়, এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সঙ্গে সরাসরি বসে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। মানসিক সমস্যার মাত্রা বেশি হলে, অতিদ্রুত একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে হবে।

এ ধরনের আরও অসংখ্য বিষয় আছে যা প্যারেন্টিং এবং শিশু মনস্তত্ত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব বিষয়কে সুন্দরভাবে সামাল দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। প্রশিক্ষণ থাকলে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জগুলো খুব সহজে ধরতে পারেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে, শিক্ষার্থীরা নিঃসংকোচে তাদের অনেক সমস্যা শিক্ষকদের কাছে বলতে পারে। তখন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে, সে অনুযায়ী পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়।

উন্নত বিশ্বের প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকদের এসব বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের আগে উক্ত শিক্ষকের আচরণ ও মানসিক অবস্থা ভারসাম্যপূর্ণ কিনা- তাও যাচাই বাছাই করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই- শিক্ষকের ভুলে যেন শিক্ষার্থীদের ক্ষতি না হয়।

আমাদের দেশে এখন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। আমরা খুশি যে– নতুন শিক্ষাক্রমে ছাত্রছাত্রীদের সফট স্কিল অর্থাৎ সহমর্মিতা, সহযোগিতা,  সৃজনশীলতা, সূক্ষ্মচিন্তন ক্ষমতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে, শিক্ষকদের প্যারেন্টিং এবং শিশু মনস্তত্ত্বের ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যতীত এসব লক্ষ্য অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আশা করছি নীতিনির্ধারকগণ এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

লেখক: প্যারেন্টিং গবেষক

ইমেইল- [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অভিযোগের জবাব ও স্টার সিনেপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ ভাবনা
অভিযোগের জবাব ও স্টার সিনেপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ ভাবনা
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতার ২৭
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতার ২৭
সড়কে প্রাণ গেলো আম ব্যবসায়ীর
সড়কে প্রাণ গেলো আম ব্যবসায়ীর
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
সর্বশেষসর্বাধিক