X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়ে বলে কি খেলাধুলায়ও বাধা?

মোস্তফা হোসেইন
১১ আগস্ট ২০২৩, ১৮:০৫আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৩, ১৮:০৫

অবিসংবাদিত কোনও নেতা নন, বিশ্ববিজয়ী কোনও বীর নন, বাংলার মেয়েরা নামবে বিমান থেকে- শহরে ঢুকবে বিমানবন্দর সড়ক ধরে। রাস্তার দুই ধারে সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে, তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। তার আগে সড়ক পরিবহন সংস্থা একটি দোতলা বাসের ছাদ খুলে উন্মুক্ত করে দেয় সেই বীর নারীদের বিমানবন্দর থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশকালে ব্যবহারের জন্য।

সে কী উল্লাস! মাত্র এক বছর আগের কথা। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। আমাদের মেয়েরা সাফ ফুটবল খেলায় চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে ফিরছিল কাঠমান্ডু থেকে। আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে আমাদের মেয়েদের এমন বিরল সাফল্য সব শ্রেণি পেশার মানুষকে উল্লসিত করেছিল। সবাই বাহবা দিয়েছিল আমাদের মেয়েদের। প্রকাশ্যেই বলেছিল, কোটি কোটি টাকা খরচের পরও আমাদের ছেলেরা যে সাফল্য আনতে পারেনি; বঞ্চিত-অবহেলিত নারীরা সেই সাফল্য এনে দিয়েছে। প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিল বীর নারীদের।

ফুটবল ও ক্রিকেটেও আমাদের মেয়েরা একইভাবে সাফল্য উপহার দিয়েছে দেশকে। যদিও ক্রিকেটে আমাদের ছেলেরাও বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছে। এবং তারা নিজেরাও সম্মান পাচ্ছেন। কিন্তু মেয়েরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা সুযোগ পেলে তাদের মাতৃভূমিকে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করছে। কিন্তু বিনিময়টা করুণ। তাদের কপালে লাঞ্ছনাই জুটছে।
 
বিরাট সাফল্য আনা নারী ফুটবলারদের পরিণতিটা সুখকর হয় না এই দেশে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ কেউ তাদের প্রতিভাকে মূল্যায়ন করে না। অকালে ঝরে পড়ে ফুটবল মাঠ থেকে। যেকোনও খেলায় স্বাভাবিক অবসরগ্রহণ থাকে। কিন্তু মেয়েদের ক্রীড়ায় কোনও স্বাভাবিক অবসরগ্রহণ নেই। তাদের সামর্থ্য থাকাকালেই ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিদায় নিতে হয়।  

আসলে আমাদের মেয়েরা এগিয়ে যাক, সবাই চায় না। যারা চায় না তারা আমাদেরই চেনাজানা, এমনকি আত্মীয়-স্বজনও। তারা তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আইনকেও নিজের হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করে না। নারীর এগিয়ে যাওয়া হয়তো কারও কাছে খারাপ লাগতে পারে, তাই বলে মেয়ে হওয়ার কারণে তার কাজে বাধা দেওয়া, তাকে নিগৃহীত করার অধিকার কি কারও আছে? আমাদের দেশের সংবিধান ও আইন বলে- নারী কিংবা পুরুষ ভেদে কারও কাজে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আইন-সংবিধান নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের কাছে হার মানে। মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এসব মানুষ। সাম্প্রতিক একটি প্রসঙ্গ তারই প্রমাণ বহন করে।

খুলনার বাটিয়াঘাটা এলাকায় কিশোরী ফুটবলারদের অ্যাসিড ছুড়ে মারার হুমকি দিয়েছে এলাকার চিহ্নিত কিছু তরুণ। কিশোরীরা ফুটবলপ্রিয়, স্থানীয় অ্যাকাডেমি ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। যে প্রতিষ্ঠানটিকে আবার বাটিয়াঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান নিজে পৃষ্ঠপোষকতাও করে থাকেন।

অনূর্ধ্ব-১৭ নারী ফুটবলে খুলনার তেঁতুলতলা স্কুলের শিক্ষার্থী কিশোরীরা ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয়, ওই স্কুলের কিশোরী ফুটবলাররা বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে সুনাম অর্জন করতে পেরেছে ভালো খেলার সুবাদে। একাধিকবার জেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে তাদের মধ্যে খেলার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। একইসঙ্গে উদ্যোক্তারাও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন। খেলোয়াড় এবং উদ্যোক্তাদের সামনে বিশাল স্বপ্ন- তারা জাতীয় পর্যায়ে খেলে শিরোপা জিতে নেবে। কিশোরীদের ঠিকানা সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমির নিজস্ব মাঠ নেই। তারা তেঁতুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠকে কিশোরীদের অনুশীলনের জন্য বেছে নেয়।

কিন্তু স্থানীয় কিছু ব্যক্তির চোখে বিষয়টি আপত্তিজনক মনে হয়। তারা মেয়েদের ফুটবল খেলাকে ভালো চোখে দেখছিল না। কিশোরীরা কেন হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে এটা তাদের কাছে গর্হিত বলে মনে হয়। কিশোরীদের কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। যদি খেলা বন্ধ না করে তাহলে ওদের অ্যাসিড মারা হবে বলেও হুমকি দেয়। এতেও ওদের ক্ষোভ মিটেনি। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলী বাগচী ও সাদিয়াসহ কয়েক কিশোরীকে হাত-পা বেঁধে মারধরও করেছে। যে কারণে কিশোরীদের হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও এমন সংবাদ আমাদের পড়তে হয়েছে পত্রিকায়।

তাদের শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার আগেও তারা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। খেলার কারণে তাদের প্রায়ই ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হবে।

আশার কথা, সাদিয়া নাসরিন ও মঙ্গলী বাগচি তারপরও বলেছেন, যত বাধাই আসুক না কেন তারা ফুটবল ছাড়বেন না। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে। হয়তো দুদিন পর হলেও বিচারও হবে। কিন্তু আমাদের মেয়েদের চলাফেরা খেলাধুলায় যে প্রতিবন্ধকতা, তা কি দূর হবে?

এমন অমানবিক ঘটনা বাটিয়াঘাটাতেই প্রথম ঘটেনি। আমাদের মনে থাকার কথা কলসিন্দুরের সেই অদম্য মেয়েদের কথা। কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেই সময়।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে থেকে কিশোরীরা জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলে আমাদের আশান্বিত করছে। ওই সময় আমাদের কিশোরীরা যে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আজকেও সেই একই প্রতিবন্ধকতা থাকবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায়। ওই সময় সম্ভবত ২০১১ কিংবা ২০১২ সালে রংপুরের পালিচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিশোরীদেরও বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে ফুটবল খেলতে গিয়ে।

অপ্রত্যাশিত এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে শুধু মামলা দিয়ে হবে না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে না পারলে আমাদের মেয়েদের পিছিয়ে পড়তে হবে অগ্রসর বাংলাদেশের অভিযাত্রায়। তাদের পথ প্রশস্ত করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। একইসঙ্গে রাষ্ট্রকেও ভূমিকা রাখতে হবে। মেয়ে বলে কি তাদের ক্রীড়া-বিনোদনের সুযোগ থাকবে না? এই দেশের ৮ কোটি নারীকে পেছনে ফেলে দেশ কি প্রকৃত উন্নয়ন করতে পারবে? কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করতে হবে। তাদের প্রেরণা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
হলদিয়া রাবার বাগানবেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ