X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

চুপ করো, শব্দহীন হও

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৪৯আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:০০

কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’-এর প্রথম দুই চরণ, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও’, এমন কর্তৃত্ববাদী আচরণে একসময় গোটা বিশ্ব শাসন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখন সেই ভয়ের মৌসুম শেষের পথে। ভয়ের ফোয়ারায় সাহসের ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বন্ধুত্বের বাহনে নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সেই সাহস জুগিয়েছে। যদিও সেখানেও বাণিজ্য-স্বার্থ আছে। তবে এর মাঝেও কিছু পাওয়ার রয়েছে, তা হলো এখন অন্তত দরকষাকষির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিকল্প কিছু ক্ষেত্র রচিত হয়েছে।

বিশ বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তির ইশারায় গোটা বিশ্ব চলতে বাধ্য হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পরিমাণ সোনা মজুত করে এবং এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের জন্ম দেয়। নিজেদের খবরদারির ব্ল্যাংক চেক নিতে মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। এদের মাধ্যমে যেখানেই নিজেদের বাণিজ্য স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে সেখানেই রাষ্ট্রক্ষমতাকে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য করে সেই সরকারকে ‘ফেলে’ দেওয়া হয়েছে এবং নিজেদের স্বার্থকে পুনঃপ্রবাহিত করেছে। পরিকল্পিতভাবে সেটাকে বৈশ্বিক ফোরাম জাতিসংঘকে দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

পক্ষপাতমূলক সেই রেফারিংয়ের কারণে জাতিসংঘ আজ মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স এখন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন। সংখ্যার বিচারে হিসাবটা তিন-দুই হলেও চীন, রাশিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সক্ষমতা বাকি তিনের চেয়েও ফুলেফেঁপে উঠছে। এছাড়া বিগত দশ বছরে এরা জাতিসংঘকে এড়িয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলাদা বাণিজ্যিক, সামরিক জোট গঠন করতেই বেশি ঝুঁকেছে। যা ভবিষ্যৎকে জাতিসংঘবিহীন পৃথিবীর ইঙ্গিত দেয়।

ভারত, রাশিয়া, চীন উত্থিত শক্তি হিসেবে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামরিক ও জনশক্তি দিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বকে নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। অনধিকার চর্চার একঘেয়েমিপনা কিংবা খামখেয়ালি আচরণ থেকে ব্যবসায়ী বন্ধু হিসেবে বিশ্বে দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। যা অংশীদারিত্বের রাজনীতি ও স্থিতিশীলতাকে এগিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া এদের আঞ্চলিক বাজার তৈরির যে প্রতিযোগিতা সেটাও বিশ্ব উপভোগ করছে। এদের স্বল্প মূল্যের শ্রমিক, কাঁচামাল ও পণ্যের মূল্যের সঙ্গে না পেরে আমেরিকাসহ পশ্চিমারা এখন নিষেধাজ্ঞার মতো পুরনো খেলা নিয়ে হাজির হয়েছে। লক্ষ্য এদের সাপ্লাই চেইন ভাঙা। পাশাপাশি চেষ্টা করছে, এই তিন শক্তিকে নিজেদের বিরোধপূর্ণ সীমানা নিয়ে যুদ্ধের ফ্রন্ট খোলাতে। যাতে এদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যুদ্ধে অপচয় হয়।

পাশ্চাত্য মেদহীন যুক্তিতে চললেও প্রাচ্য বিশ্বাসের ওপর ভর চলে। এখানে ধর্মীয় অনুভূতি, রীতি-রেওয়াজ, বর্ণভেদসহ নানা সামাজিক অনুভূতি আছে। বলা যায়, এই অনুভূতিগুলোই আগামীর টার্গেট হবে। কারণ, এই অঞ্চল সম্পর্কে তাদের নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক গবেষণা আছে। তারা জানে, এখানে অনুভূতিতে আঘাত করতে পারলেই পারস্পরিক সম্পদ ও শক্তির অপচয় ঘটানো সম্ভব।

সেই সূত্র ধরে এশিয়ার দুই শক্তি ভারত ও চীনকে সংঘর্ষে জড়ানোর জন্য বারবার মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। নিজেদের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সামনে এনে বিবাদের চেষ্টা চলছে। যদিও আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে এই দুই প্রতিবেশী বেশ ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে এগোচ্ছে। এ জন্য এখন আর বাইরে থেকে নয়, বরং ভেতর থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধের নামে ভারত থেকে খালিস্তান নামে পাঞ্জাবকে বিচ্ছিন্ন করা ও চীনের তিব্বত, উইঘর, তাইওয়ানসহ অন্যান্য বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে। চীন ও ভারতকে রুখতে দু’দেশে দুটি যুদ্ধের ফ্রন্ট খোলাটাই এখন মূল লক্ষ্য। কারণ এটা করা গেলে দুই দেশই তাদের বাণিজ্যিক, সামাজিক, সামরিক বিনিয়োগ ও অগ্রগতি থেকে থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। তাছাড়া এটা করা গেলে রাশিয়াও তার জ্বালানি রফতানির দুই দেশ চীন-ভারতকে হারাবে। অর্থাৎ বৈশ্বিকভাবে বহু মেরুকরণের ক্ষেত্র পুরোপুরি ধসে পড়বে।

পশ্চিমা শক্তিগুলো বুঝতে পেরেছে ভারত, চীন ও রাশিয়ার যে অর্থনৈতিক প্রবাহ তা ক্রমেই রাজনৈতিক প্রবাহে পরিণত হচ্ছে। কারণ, এরা বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব চালানো দেশগুলোতে সংস্কৃতিগত প্রবাহও শুরু করেছে। যেমন, পাকিস্তানে চীনা ভাষায় ‘হুয়াসাং’ নামে পুরোদস্তুর একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের হচ্ছে। চীনা ভাষায় যার অর্থ ‘ফুলের ব্যবসা’। উদ্যোক্তাদের ধারণা, পাঁচ হাজার কপি দিয়ে শুরু হয় ‘হুয়াসাং’-এর সংখ্যা ১০ গুণ বাড়বে। অন্যদিকে ভারত তার সিনেমা ও সংগীত শিল্প দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ বিশ্বে এক অদৃশ্য আবহ তৈরি করে ফেলেছে। যা বাণিজ্যিক প্রবাহকে আরও সুসংহত করছে।

এশিয়ার এই দুই শক্তির এভাবে এগিয়ে যাওয়া স্বভাবতই পশ্চিমা ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের জন্য আতঙ্কের। এ কারণে এরা পূর্বের রীতি অনুসারে সরাসরি ব্যর্থ হয়ে এদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে টার্গেট করে এগোচ্ছে। এশিয়ায় এবারে তাদের টার্গেট বাংলাদেশ। কারণ, এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান চীন, ভারতকে কাবু করতে উৎকৃষ্ট। বাংলাদেশ ভারতের তিনদিক বেষ্টিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের জলসীমার যেদিকটায় মিয়ানমারের সীমানা, তার খুব কাছেই মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সীমান্ত। অর্থাৎ উভয়কেই বাগে আনা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা ও তালেবানি ধারণার উগ্র অংশকে পশ্চিমারা ব্যবহার করতে চাইতে পারে। সেখানকার জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ নিজেও এটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এগোচ্ছে। কাজেই দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনেরও দায়িত্ব আছে যেন কেউ সেই দেশের অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা নষ্ট করতে না পারে সেদিকে সহযোগিতার। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা ভাঙার মূল উদ্দেশ্যই হবে ভারত, চীনকে নজরদারি করা।

চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনামের সীমান্ত রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশের সীমান্ত। কাজেই চিরচেনা সীমান্তের বাইরে অন্যদের মদতে বাংলাদেশের মতো সহযোগিতাসম্পন্ন দেশেও যদি নতুন একটা সীমানা সংকট খোলা যায়, তাহলে তা গোটা এশিয়ার জন্য সমস্যাই হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। সেই হিসাবে এশিয়ার নতুন উত্থিত শক্তি হিসেবে বাংলাদেশও সবার সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে এগোতে চায়। প্রতিবেশী, দূরদেশী সকলকে সেই পররাষ্ট্রনীতিকে সম্মান করে এগোতে হবে। কাউকে নজরদারি করতে প্রক্সি এরিয়া হিসেবে বিবেচনা বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশীসহ গোটা এশিয়াকেও এটা মাথায় রাখতে হবে। কোন কারণে এ দেশ পিছলে গেলে অন্যদের পিঠেও সেই বোঝার চাপ উঠবে।

পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্যের মিত্রদের যার যার মুদ্রাকে সর্বজনীন করার যে প্রতিযোগিতা সেখান থেকে সরে এসে এশিয়ার মতো বৃহৎ অঞ্চলের জন্য একটা আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। যেন কারও ওপর চাপ না পড়ে। কারণ, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একই সঙ্গে নিজেদের মুদ্রা, ডলার, ইউয়ান, রুপি, রুবলকে ভারসাম্যে রাখতে হয়। বিষয়গুলো উত্থিত শক্তিগুলোর নজরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সহনশীল অবস্থান তৈরি করতে না পারলে ভারসাম্যসম্পন্ন পৃথিবীর স্বপ্ন ছেড়ে আবারও চুপ কর, শব্দহীন হও প্রথায় ফিরে যেতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ