X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

খুনিদের দায়মুক্তিদানের ‘নায়কে’রাও কি দায়মুক্ত?

মোস্তফা হোসেইন
১২ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৫২আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৪০

মানুষ খুন করা অপরাধ। খুনি খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হয়। কিন্তু এই খুনকে বৈধতাদানের জন্য আইন করা, বিচার বন্ধ করার চেষ্টা করা সম্পূর্ণ মানবতা ও সভ্যতাকে হত্যা করার শামিল। দুটো কাজই হয়েছে এই বাংলাদেশে। একটি দেশের স্রষ্টাকে সপরিবারে হত্যা, নিরপরাধ শিশু ও নারীকে হত্যার পর খুনিদের রক্ষায় খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমান যে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার দায় থেকে তারা মুক্ত হতে পারেন না। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা হিসেবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং তার পরের হত্যাকাণ্ডগুলো চিহ্নিত হয় অতি সহজে।

প্রশ্ন হচ্ছে, স্বীকৃত গণহত্যাকারীর রাজনৈতিক অধিকার থাকে কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যাকারীদের এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের যেভাবে আইনানুগভাবে রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, তেমনই সামরিক শাসনের ছায়ায় যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তারাও বহাল তবিয়তে আছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হলেও মানবতাবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দলটি এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। যেমন আসেনি বঙ্গবন্ধু ও স্বজনদের হত্যাকারী গোষ্ঠী ও দলগুলোও।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী দলের শাস্তি প্রদানের দাবি উঠলেও ১৯৭৫ থেকে যেসব দল মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচারের কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার স্বজনদের হত্যাকারীদের অনেকেই মারা গেছেন। সেই সুবাদে তাদের বিরুদ্ধে বিচার সম্ভব নয়, এমনটাই প্রচলিত আইন বলে। কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনে তদন্ত কমিশন গঠন করে শাস্তিযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা কি আইনে বাধা আছে? তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি এটাই বাস্তবতা।

যে কারণে আমাদের আজও বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করতে হয় ১৯৭৫-১৯৮১ সালের গণহত্যাগুলোর। খন্দকার মোশতাক আহমদ রাবার স্ট্যাম্প রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে বসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের রক্ষা কিংবা তাদের হাত থেকে নিজে রক্ষা পেয়েছেন। তখনও সেনানিবাস থেকেই রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালিত হতো। তারা যা বলতো মোশতাক তাতেই স্বাক্ষর করতেন। সুতরাং আজকে যারা মোশতাক আহমদকে এককভাবে দোষ দিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করেন, তাদের যুক্তি টিকতে পারে না। তারপরও মোশতাকের অধ্যাদেশ যদি পার্লামেন্টে বাতিল করা হতো তাহলে হয়তো এর দায় বিএনপি এবং তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ওপর বর্তানোর সুযোগ থাকতো না। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে জিয়াউর রহমান শুধু ১৯৭৫ সালের গণহত্যাকারীদেরই রেহাই দেননি। তিনি ১৯৭১ সালের গণহত্যাকারীদেরও আইনিভাবে রক্ষা করেছেন। যথাক্রমে দালাল আইন বাতিল ও ইনডেমনিটি আইন পাস করার মধ্য দিয়ে।

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দাবি ছিল ৩০ লাখ শহীদের নিকটজনদের তথা গোটা দেশবাসীর। একইভাবে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে দোষীদের বিচার করার দাবিও ছিল জনগণের।

মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের দুই দশককালেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল উত্থাপন করেন এবং তা উপস্থিত সদস্যদের ভোটে জাতীয় সংসদে পাস হয়। বড় নিষ্ঠুর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় তৎকালীন বিএনপিকে।

১৯৯৬ সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ার পর ২০০১-এ ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এর আগে আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট গণহত্যার বিচার শুরু করে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই বিচারকে স্থবির করে রাখে। তাদের ক্ষমতাকালে তৎকালীন বিরোধীদল ও জনগণের দাবিকেও তারা উপেক্ষা করে। যে কারণে জিয়াউর রহমান যেভাবে অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার মাধ্যমে ইতিহাসের বিচারে দোষী হয়েছেন, একইভাবে খালেদা জিয়াও একই দোষে দোষী হিসেবে গণ্য হতে পারেন। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া যেভাবে খুনিদের শাস্তি মওকুফ করে তাদের পদোন্নতি দিয়ে সুরক্ষা দিয়েছেন সেই বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।

জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৫ম সংশোধনী পাস করে খুনিদের রক্ষাসহ সামরিক শাসনকে বৈধতা প্রদান করে এবং ৭৫ পরবর্তী সব হত্যাকাণ্ডকেও বৈধতা প্রদান করেন। একইভাবে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ৭ম সংশোধনী মাধ্যমে তার ক্ষমতা দখলকে বৈধতা প্রদান করে। দুটো সংশোধনীই উচ্চ আদালতে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ায় কলঙ্কমুক্তির পথ প্রশস্ত হয়।

যদিও আদালতের রায়ে সব ধরনের ক্যু, সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে খুনের দায়মুক্তিও বাতিল হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে এমন অপরাধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে ‍যাচ্ছে। কিন্তু সংগঠনগুলোর বৈধতা থেকে যাচ্ছে। দলগতভাবে তাদের অপরাধ আইনি আলোচনায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদদের ইনডেমনিটি আইনের প্রণেতা দলগুলোর বিষয়েও তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। ইতিহাসের প্রয়োজনে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী আইন প্রণেতাদের অন্তত চিহ্নিত করা সম্ভব হবে এর মাধ্যমে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
দুই মাস পর ইলিশ ধরা শুরু
দুই মাস পর ইলিশ ধরা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ