X
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

মুশতাক-তিশার অপরাধটা কী?

মোস্তফা হোসেইন
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৪৩আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৬:০৬

খন্দকার মুশতাক আহমেদ বই মেলায় প্রকাশিত দু’টি বইয়ের লেখক। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মুশতাক আহমদ নন। লেখক হিসেবেই সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন বই মেলায়। নিগৃহীত হয়ে তাকে মেলা ত্যাগ করতে হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে এবার মূলধারার পত্রপত্রিকায়ও স্থান পেলেন মুশতাক-তিশা দম্পতি।

নবদম্পতি মেলায় তাদের প্রকাশনার প্যাভিলিয়নে উপস্থিত হতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেলায় আগত দর্শককূল। ভুয়া ভুয়া, ধুর ধুর জাতীয় শব্দ প্রয়োগে তাদের নাজেহাল করে দেয় মেলায় আগতরা।

খন্দকার মুশতাক তার মেয়ের বয়সের এবং কলেজ পড়ুয়া তিশাকে প্রেম করে বিয়ে করেছেন, এটিইতো কারণ? অসম বয়সের বিয়ের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ অতি দ্রুত তিশার অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যায়। তাও আবার কট্টরবাদী অভিভাবক। তিরস্কার সমালোচনার বন্যা বয়ে যেতে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিটি পোস্ট-এ চোখ গেলে মনে হতে পারে, মন্তব্যকারীদের নিজ সন্তান যেন কোনও অপকর্ম করে তাদের মুখে চুনকালি লেপ্টে দিয়েছে। অবশ্য দু’চারজন মোশতাক-তিশার পক্ষেও বলেছে। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়।

খন্দকার মুশতাক আহমেদ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল -এর অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে ইতিপূর্বে সমাজে ক্ষুদ্র একটি অংশের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই বিয়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হন। যা হয়তো তিনি নিজেও চেয়েছিলেন। যে কারণে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় একটি মেয়েকে বিয়ে করার বিষয়টি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। প্রচারের বিষয়টিও মুশতাক তিশা উভয়ের সম্মতিতেই হয়েছে এটা বলা যায়।

শুধু তাই নয়, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের এই ঘটনাকে আরও আলোচনায় আনার জন্য বই লিখে ফেললেন গ্রন্থমেলা উপলক্ষ্যে। সস্ত্রীক মেলায় উপস্থিতির পেছনেও প্রচার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে সেটাও অনুমান করা যায়। এক্ষেত্রেও তিনি সফল। গণমাধ্যম তার নাজেহাল হওয়ার বিষয়টিকে সংবাদমূল্য আছে ভেবে ব্যাপক প্রচারও করে।

বই মেলায় ছোটবড় এমন ঘটনা ঘটে প্রায় প্রতিবছরই। পুলিশের সহযোগিতায় মেলা ত্যাগের ঘটনাও নতুন নয়। আবার বই মেলায় বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। প্রতিটি ঘটনার পেছনের কারণগুলো সব এক নয়।

কয়েক বছর ধরে বাজারে কাটতি আছে এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের লেখক হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যাদের অধিকাংশই শিল্পী ইমেজকে কাজে লাগাতে বই লিখেন। (ভালো মানের লেখকও আছেন)। প্রকাশকও সেই সুযোগ গ্রহণ করেন। এই অভিনেতা-লেখকদেরও মেলায় আসতে দেখা যায়। প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে যায় মেলার দর্শকরা। ভক্তকূল তাদের ঘিরে ধরে মেলার ভিতর। এমন একটি ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছিলো আমারও। শব্দশিল্প প্রকাশন নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা অভিনেতা অনন্ত জলিলের বই প্রকাশ করেছিলো বছর কয়েক আগে। শব্দশিল্প প্রকাশনার কাছাকাছিই অবস্থান করছিলাম আমি। হুমড়ি খেয়ে পড়া দর্শক দেখে বুঝতে পারছিলাম আশেপাশের স্টলগুলোর মালিকেরা সহজভাবে নিতে পারেনি বিষয়টি। একসময় দর্শক এর ভিড় সামাল দিতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। একসময় তিনি পুলিশি প্রহরায়ই মেলা ত্যাগ করেন।

এটা পজেটিভ দিক। কোনও অভিনেতার উপস্থিতিতে বইয়ের ক্রেতারা চলচ্চিত্রের দর্শক হয়ে পড়েন। প্রিয় অভিনেতার কাছাকাছি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেই পারেন। সেই অবস্থায় পুলিশি হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক বিষয়।

কিন্তু মুশতাক-তিশার মেলাত্যাগের সঙ্গে অনন্ত জলিল, বিদ্যা সিনহা মিম কিংবা এমন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর পুলিশী প্রহরায় মেলা ত্যাগের ঘটনাকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। মুশতাক-তিশার মেলা ত্যাগের সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। তাদের প্রতি মানুষের আচরণও স্বাভাবিক ছিল না।

কিন্তু এই ক্ষোভ কিংবা ভুয়া ভুয়া বলে তাদের নাজেহাল করার যৌক্তিকতা কী? অসম বয়সের বিয়ে আমার দৃষ্টিতে খারাপ হতে পারে। আমার মতো অনেকেরই এই মানসিকতা থাকতে পারে। কিন্তু মুশতাক-তিশার দৃষ্টিতে এটা স্বাভাবিক। দেশের আইনও এর বিপক্ষে নয়। আবার আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টান্ত দিতে গেলে লম্বা ফিরিস্তি হয়ে যাবে। বিষয়টি একান্তই যার যার ব্যক্তিগত। কারও ব্যক্তিগত বিষয় আমার অপছন্দ হলে কি আমি তাকে কিংবা তাদের অপমান করতে পারি? এই সুযোগ আইন কিন্তু কাউকে দেয়নি। আইন সমর্থন না করলেও মোশতাক-তিশার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।

তিশার ভালোবাসা ও তিশা অ্যান্ড মুশতাক বই দুটিই আমার অপছন্দের হতে পারে। হতেই হবে এমন প্রত্যাশাও নিশ্চয়ই লেখক করেননি। কিন্তু বইয়ের কাটতি দেখে বলা যায়-পছন্দকারীদের তালিকাটা নেহায়েত কম নয়। আমার অপছন্দের বই যদি অসংখ্য মানুষের প্রিয় হয়, সেক্ষেত্রে আমার অনুভূতির প্রকাশটাও সংযত হওয়ার কথা। যদি অসংযত আচরণ করি তখন তার দায়টা আমাকেই বহন করতে হবে। অন্তত মুশতাক-তিশার অপদস্ত হয়ে মেলা ত্যাগের বিষয়ে এমনটাই মন্তব্য করা যায়।

তাদের বই যদি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে, কারো ধর্মীয় কিংবা সামাজিকতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে বইটি মেলায় নিষিদ্ধ করার বিধান আছে। প্রায়ই এমন সংবাদও আমাদের চোখেও পড়ে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ প্রয়াত জয়নাল হাজারীর লেখা ‘বাঁধনের বিচার চাই’ বইটি বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলাতেই নিষিদ্ধ হয়েছিলো। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয় জয়কার ছিল না। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ( থারটি ফার্স্ট নাইট) টিএসসিতে বাঁধন নামের এক মেয়ের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল হাজারীর লেখা বইটি মেলা কর্তৃপক্ষ মেলায় নিষিদ্ধ করেছিলো। এমন ঘটনা মেলায় আরও ঘটেছে।

সুতরাং কেউ যদি খন্দকার মুশতাক আহমেদের লেখা বইকে ক্ষতিকর মনে করেন, যদি মনে করেন এই বই সামাজিকভাবে অনিষ্টকর তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোন কারণে ক্ষতিকর তা জানিয়ে প্রথম দফায় বাংলা একাডেমিকে বইটি মেলায় নিষিদ্ধ করার আবেদন জানাতে পারেন। যদি বইটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে চান তাহলে আদালতের আশ্রয়ও নিতে পারেন।

কিন্তু তার কোনোটাই না করে যখন লেখককে অপদস্ত করা হয়, তখন এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার কারণ নেই। এটা মেলার পরিবেশ রক্ষায়ও ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যেভাবে মুশতাক দম্পতিকে মানুষ ধুর-ছাই করেছে তাকে পুলিশ দিয়ে দমন করাও সম্ভব ছিল না। বিষয়টি মানসিকতার। অন্যের স্বাধীনতার প্রতি আস্থাহীনতাই এর জন্য দায়ী। মুশতাক-তিশারও ভাবা দরকার ছিল, ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে তারা একটি শ্রেণির মানুষকে উসকে দিচ্ছেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এই প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষ প্রভাবিত হবে, কিছু আছে উশৃঙ্খলও হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং দুটি পক্ষই যে বাড়াবাড়ি করেছে তা বলা যায়, যা সম্পূর্ণ অনুচিত। বাড়াবাড়ি কিছুই মঙ্গলময় হয় না।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ
রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী নিহত
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী নিহত
পাকিস্তান সফরের জন্য সরকারের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় বিসিবি
পাকিস্তান সফরের জন্য সরকারের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় বিসিবি
‘মেসেজ দিতে রিকশা ভাঙা হয়েছিল, আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে’
‘মেসেজ দিতে রিকশা ভাঙা হয়েছিল, আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক