X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘কীসের বিল্ডিং কোড, কীসের আইন?’

এম আর ইসলাম
০৫ মার্চ ২০২৪, ২৩:০৮আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪, ১৭:১৩

‘রোম যখন পোড়ে, নিরো তখন বাঁশি বাজায়!’ ‘নিরো’ হচ্ছে সে/ তারা যাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না, ভ্রুক্ষেপহীন; অথবা যে নিজেই অনাচার সৃষ্টি করে, গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরেছিল সেই নগর রাষ্ট্রের রোমে।

বঙ্গদেশে ‘নিরো’ কারা? এই প্রশ্নের উত্তরের আগে আসি আরেক প্রশ্নে। আচ্ছা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম কেন হয়েছিল? হবস, রুশো, কান্টের মতো দার্শনিকরা একমত যে, রাষ্ট্রের জন্ম হয় মূলত এর নাগরিক/জনগণদের রক্ষা করার জন্য অথবা এদের জন্য সর্বোচ্চ ভালো’র ব্যবস্থা করার জন্য। বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ করলে, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র সংজ্ঞায়িত করা কঠিন কিছু না। এখানে গরিব আর মধ্যবিত্তদের জন্য মৃত্যুর আয়োজন যেন সবখানে। শুধু পালাবদলের অপেক্ষা মাত্র।

বাংলাদেশে একটা রাজধানী আছে বটে; যার নাম ঢাকা। এই ঢাকাতে ঢেকে আছে যেন সারাদেশ। এত জনবহুল একটা শহর বিভিন্ন কারণেই বদনামের শীর্ষে। দূষিত পানি, দূষিত বাতাস, দূষিত খাবার, আর নিম্নমানের যানবাহনের জন্য এই শহরের কুখ্যাতি চূড়ান্তে। স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও একটা পরিকল্পিত নগর আমরা তৈরি করতে পারিনি। তবে নগরের ইমারত নির্মাণের জন্য আমাদের আছে গালভরা যত আইন। আইনের শাসনের সাবলীল বা বৈষম্যহীন প্রয়োগ এ দেশে এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। তাই তো নগরায়ণের পরিবর্তে তৈরি হয়েছে ইট-পাথরের জঞ্জাল।

 বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে যে ৪৬ জন মানুষ নির্মমভাবে আগুনে পুড়ে বা আগুনসৃষ্ট ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন, তা রাষ্ট্রের কাছে একটা সংখ্যা বা পরিসংখ্যান মাত্র, কিন্তু তাদের পরিবারের বা স্বজনদের কাছে এ এক অবর্ণনীয় বেদনা, যা মাপা যায় না, অথবা পৃথিবীর কোনও কিছু দিয়ে যার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব না। অথচ এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য আইনের কোনও অভাব ছিল না। ঢাকাসহ সারা দেশের জন্যই রয়েছে ভবন নির্মাণের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন। 
২০০৮ সালের ২৯ মে, ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮’ প্রণীত হয়। ইমারত নির্মাণ আইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে ১৯৫১ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ইমারত নির্মাণ অধ্যাদেশ’ ছিল। এই অধ্যাদেশের পরে ১৯৫২ সালে ‘ইমারত নির্মাণ আইন’ হয়, যা ১৯৫৩ সাল থেকে কার্যকর হয়। ১৯৫৩ সালে মূলত গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর কর্তৃক প্রণীত টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা, যা বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) নিয়ম অনুসরণ করে তৈরি করা। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে নতুন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। এ বিধিমালার বাস্তবায়নকারী সংস্থা হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক। 

ইমারত নির্মাণ আইনের ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ইমারত ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসিক বাড়ির জন্য ইমারত নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বর্তমানে বড় শহরের আবাসিক ভবনের বিভিন্ন তলায় দোকান, রেস্টুরেন্ট, গুদাম বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অফিস করার প্রবণতা দেখা যায়। এমনটা আইনের ব্যত্যয়, কারণ আইনের এমন লঙ্ঘন ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংক্রান্ত বিধিতেও মামলাযোগ্য অপরাধ। ইমারত আইনের ১৫ ধারায় স্পষ্টভাবে আলো-বাতাসের চলাচলের ব্যবস্থার কথা বলা আছে। এই আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, জরুরি নির্গমনের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ের যেকোনও ফ্লোরের সর্বোচ্চ ২৫ মিটার থাকতে হবে। এই নির্গমন পথ সিঁড়ি আকারে হতে হবে এবং নিচতলার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে।

 ধারায় আরও বলা আছে, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রকাশ্য স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বা বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রত্যেক ফ্লোরে ফায়ার অ্যালার্মের কথাও বলা আছে।  একই কোডের ৪ ও ৫ ধারায় এমন ফায়ার অ্যালার্ম রাখার কথা বলা আছে, যা আগুন, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্ত করতে সক্ষম।

অন্যদিকে, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন নির্বাপণের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা বিল্ডিং নির্মাণের ১৮০ দিনের মধ্যেই ফায়ার ব্রিগেডের মহাপরিচালকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। এই আইনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভবন পরিদর্শন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শন শেষে যদি তার কাছে প্রতীয়মান হয় যে উক্ত ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে নেওয়া হয়নি, তাহলে ভবনটি ব্যবহারের উপযোগী নয় বলে ঘোষণা দেওয়া যাবে।

 এই মর্মে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি হাইকোর্ট ডিভিশনে একটা রিট পিটিশন (৭১৮/২০০৮) দায়ের করে, যেখানে ভবনের মৌলিক বা ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিতের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানানো হয়। হাইকোর্ট এই বিষয়ে গাইডলাইনও দেয়। তারপরও নিমতলি, তাজরিন ফ্যাশন, চকবাজার, গুলশান ডিসিসি মার্কেট এবং সর্বশেষ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ট্র্যাজেডিগুলো বন্ধ হয় না।

বেইলি রোডের এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে, যেখানে ভবনের মালিকসহ ৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার সূত্রে জানা যায়, রাজউকের পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে চলছিল এই স্থাপনার বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। কোন ভবন, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কোন শ্রেণিভুক্ত হবে, তা আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হবে, এবং পরবর্তীতে কোনোভাবেই শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ সবার নাকের ডগায় একটা আবাসিক এলাকায়, আবাসিক ভবন তৈরি করে, পরে তা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হলো। এই অন্যায়ের বিচার হলে, হয়তো এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটতো না। নিশ্চয় এমন ভবন সারা দেশে একটা নয়, বরং রয়েছে অগণিত। একই ভবনে, সব চলছে আইনের তোয়াক্কা না করে, আর রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের ম্যানেজ করে। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয় না, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তাদের থাকে না কোনও জবাবদিহি। 

এভাবেই আইনের পাশ কাটিয়ে চলছে কত কিছু চলছে ‘ম্যানেজ’ করে। হয়তো আরও কোনও ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে নিকট ভবিষ্যতে। তখন আগেরটা ভুলে, আমরা নতুনটা নিয়ে মাতম করবো। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। অন্তত তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সব কিছু ঢেলে সাজানোর জন্য যে বিপ্লবী উদ্যোগ দরকার, তা রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে হবে। বরং আলোচনা করতে হবে, তারা কেন শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে পারছে না?


লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ