X
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনে প্রবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন কী করতে পারে?

আমীন আল রশীদ
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:১৫আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:১৫

দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আউশ ও আমনের উৎপাদন কমতে পারে ৭ লাখ টন। মার্কিন কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস দিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, চলমান বন্যায় প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমির আউশ ও আমন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার এই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে চাল উৎপাদনে। এবার আউশ মৌসুমে তিন লাখ টন এবং আমন মৌসুমে চার লাখ টন চালের উৎপাদন কমতে পারে। সব মিলিয়ে এই দুই মৌসুমে চালের উৎপাদন কম হতে পারে সাত লাখ টন। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করতে হতে পারে।

যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের তিনটি পর্যায় বা পর্ব থাকে। যেমন- ১. দুর্যোগ-পূর্ববর্তী (সতর্কতা), ২. দুর্যোগকালীন এবং ৩. দুর্যোগ-পরবর্তী।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা একটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনা। যদিও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা গেলে বন্যায় আসা পানি ও পলি দেশের কৃষি, মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। কিন্তু নদী ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, নদী দখল এবং নানা কারণে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় বলে বন্যা অনেক সময় অভিশাপে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশে বন্যা কতটা তীব্র হবে সেটি নির্ভর করে কী পরিমাণ অতিরিক্ত পানি উজানের দেশ ভারত থেকে আসবে; ভারতের চেরাপুঞ্জি ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে আর সেই অতিরিক্ত পানি কত দ্রুত নদী খাল বিলসহ নানা জলপথে ভাগ হয়ে যাবে, তার ওপর।

সম্প্রতি ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ আশপাশের এলাকা এবং পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়িতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনও ৬ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি। আর আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, চলমান বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এছাড়া দুই জেলার পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়েছে।

প্রতিবেদন বলা হয়, বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করায় বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর ক্ষতচিহ্ন ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুর্গতদের মধ্যে জীবিকা হারানো ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই জেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ৭২ শতাংশ প্রতিদিন দুই বেলা খেতে পারছে, যা পর্যাপ্ত নয়। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় খোলা জায়গায় মলত্যাগ বাড়ছে, যা ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসব রোগে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে।

মূলত বন্যার পরে দুর্গত এলাকার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোই মূল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল। কৃষিনির্ভর মানুষ, বন্যার কারণে যাদের ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। কাঠ ও টিনের তৈরি বাড়ি কিংবা একতলা দালানের ভেতরে পানি ঢুকে আসবাবপত্র নষ্ট করেছে। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যাদের ব্যাংকে অতিরিক্ত অর্থ জমা নেই। এসব মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা কোনও আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীর দোতলা তিনতলা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেয়েও কঠিন।

বন্যার দিনগুলোয় সরকারি-বেসরকারি নানা উৎস থেকে কিছু খাদ্য সহায়তা তারা পেয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত দুবেলা খিচুড়ি রান্না হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও হয়তো হয়েছে। কিন্তু বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে তার লড়াইটা একার।

বন্যার পানিতে ডুবে তার যে টিউবওয়েলটা নষ্ট হলো—সেটি ঠিক না করা পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানির সংকট তাকে চোখ রাঙাবে। নতুন করে ফসল বোনার পরে সেটি উঠতে উঠতে যে সময় চলে যাবে, এই সময়কালে তাকে কেউ ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা দেবে না। ভেঙে যাওয়া ঘর পুনর্নির্মাণে যে খরচ হবে, সেটি জোগাড়ের সামর্থ্য অনেকেরই নেই। অনেককে ধারদেনা করতে হবে। সচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তা নিতে হবে। আত্মসম্মানবোধের কারণে এই সহায়তা নিতে অনেকের মন সায় দেবে না। কিন্তু নিরুপায় হয়ে সেটিও করতে হবে।

সরকারের তরফে কিছু প্রণোদনা হয়তো দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রণোদনার পরিমাণ কেমন এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই সেটি পাবেন কিনা, তা বিরাট প্রশ্ন। কেননা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে গিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি ও চুরির অভিযোগ বেশ পুরনো। সেই অপসংস্কৃতি থেকে দেশ রাতারাতি বেরিয়ে আসতে পারবে, সেটি বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক খবরেই এটা দেখা যাচ্ছে যে সবই আগের মতো চলছে। শুধু মানুষের চেহারা বদলেছে।

বন্যায় যাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে জীবন বাঁচাতে হয়েছে। এ অবস্থায় আর্থিকভাবে সচ্ছল নন এমন মানুষদের পাশে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগও নিতে হয়। যেমন নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলের প্রচুর মানুষ প্রবাসী। তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসতে পারেন। প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকা প্রবাসীরা নিজ নিজ কমিউনিটিতে বন্যা পুনর্বাসন তহবিল গঠন করতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সেই তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তো বটেই, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকেও তারা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পারেন।

বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় শুরুতেই আসে গৃহনির্মাণ বা সংস্কারের বিষয়টি। এরপরে আসে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা সচল করা। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির যে উৎসগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলো সংস্কার তথা সচল করার উদ্যোগটা নিতে হয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও স্থানীয় সরকার বিভাগকে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নানারকম অসন্তোষের খবর গণমাধ্যমে আসছে। বদলি, ওএসডি, চাকরিচ্যুতি এমনকি বিগত সরকারের সুবিধাভোগী অভিযোগে আক্রমণের শিকার হওয়া এবং বিগত দিনে পদোন্নতি বঞ্চিতদের আন্দোলন—সব মিলিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই ঠিকমতো নাগরিকদের সেবা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় চার সপ্তাহ পরে গত ৪ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে কোনও ধরনের হয়রানি ও জটিলতা ছাড়া নাগরিকদের সেবা নিশ্চিতের কথাও বলেছেন। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিগত সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের একটি বড় কারণ ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় লাগামহীন দুর্নীতি এবং সেবা পেতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি। সুতরাং একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকারের আমলেও যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা না বদলায়, সেটি হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।  

অতএব, দেশের অন্য এলাকার সরকারি অফিসগুলোর সঙ্গে এ মুহূর্তে বন্যাকবলিত বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর তুলনা করা যাবে না। এসব জায়গায় স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বন্যা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে হবে।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই লাখ ৩০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হবে, যাতে কৃষকরা ফসলের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। কর্মসূচির আওতায় নয়টি জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আশি হাজার কৃষককে বিনামূল্যে রোপা আমনের উফশী জাতের বীজ, সার সহায়তা এবং খরচ বাবদ ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা দেওয়া হবে। জনপ্রতি কৃষক পাবেন ১ হাজার ৭০৭ টাকা। আর বসতবাড়িতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষের জন্য ২২টি জেলায় দেড় লাখ কৃষককে ৫ শতাংশ জমিতে চাষের জন্য জনপ্রতি ১ হাজার ৫২৩ টাকা প্রদান করা হবে। টাকার অঙ্কে এটি হয়তো খুব বেশি নয়। কিন্তু এই টাকা, বীজ ও সার যাতে তারা কোনও ভোগান্তি ছাড়া পেতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

বন্যার কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। আবার বন্যার কারণে বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে খুব দ্রুত হাসপাতালগুলোয় সেবা চালু নিশ্চিত করা এবং অসুস্থ মানুষদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা এই মানুষগুলোকে বন্যার পরে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নতুনে করে লড়াই শুরু করতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে লড়াই করা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতৃত্বে দুই শাহীন!
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতৃত্বে দুই শাহীন!
শনিবার সারা দেশে গণজমায়েতের ডাক হাসনাতের
শনিবার সারা দেশে গণজমায়েতের ডাক হাসনাতের
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ, ৭ কিলোমিটার যানজট
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ, ৭ কিলোমিটার যানজট
সর্বশেষসর্বাধিক