X
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
২৪ বৈশাখ ১৪৩২

শিশুর কান্না থেমে গেলে সভ্যতা হারিয়ে যায়

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী সুরভী
০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:২৫আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:২৫

একটি অবুঝ শিশু যখন মধ্যরাতে মায়ের কোল ছেড়ে একাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় আর ভয়ানক বোমার শব্দে যখন একটা তিন বছরের মেয়ে ঘুম ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘মা তুমি কোথায়?’- তখন সভ্যতার প্রতিটি স্তম্ভ যেন কেঁপে ওঠে— কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তবুও আমরা নিশ্চুপ। 

আজ ফিলিস্তিনে শিশুর কান্না থেমে যাচ্ছে, কারণ তাদের গলা চিরে যাচ্ছে ক্ষুধা, বোমা, ধ্বংস আর অবরোধ। এই কান্না শুধু একটি জাতির নয়—এটা আমাদের নীরবতার প্রতিধ্বনি।

ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে শত শত শিশুর স্বপ্ন, মা-বাবার কোলে লেপ্টে থাকা অবুঝ মুখ, স্কুল ব্যাগে ভরা অসমাপ্ত লেখাপড়া। প্রতিটি বোমার শব্দ মানে শুধু একটি ভবন ধ্বংস নয়, বরং একটি শিশুর শৈশব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া। আজ যখন শিশুর কান্না থেমে যায়, আমরা বুঝে যাই— সভ্যতা কোথাও এক ভয়ানকভাবে পথ হারিয়েছে।

ইতিহাসের ক্ষতবিক্ষত অধ্যায়: ফিলিস্তিন সংকটের উৎপত্তি

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের শিকড় ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের প্রস্তাবনা থেকে, যা ফিলিস্তিন ভূমিকে ভাগ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংকটের সূচনা করে। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে নেয় পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেমসহ বহু অঞ্চল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি জনগণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে অবরোধ, দমন-পীড়ন আর শোকের মধ্যে।

যুদ্ধ নয়, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্ব ও অবরোধ

যেখানে ইসরায়েল একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, সেখানে ফিলিস্তিন আজও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। গাজার উপর ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে অবরোধ চলছে। পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও ওষুধের অভাবে সেখানকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা, অকল্পনীয় কষ্টে দিন পার করছে।

এটা আর কোনও সাধারণ যুদ্ধ নয়। এটি একপাক্ষিক দমনপীড়ন, যেখানে ট্যাংক, ড্রোন ও রকেটের বিরুদ্ধে শিশুদের একমাত্র প্রতিরক্ষা হচ্ছে তাদের মা-বাবার কোলে লুকিয়ে থাকা।

শিশুরা রাজনীতি বোঝে না, তবুও কেন তারা মরছে? একজন ফিলিস্তিনি শিশু যখন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছায়, তখন সে জানে না তার স্কুলটি হয়তো দুপুরের মধ্যে বোমার ধ্বংসস্তুপ হয়ে যাবে। গাজা, খান ইউনুস কিংবা রাফার মতো অঞ্চলগুলোতে শত শত শিশু স্কুলে যাওয়ার আগেই নিহত হয়েছে। কোনো বিবেকবান জাতির জন্য এই ছবি সহ্য করা সম্ভব না।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩ ও ২০২৪ সালে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অগনিত, এবং অসংখ্য শিশু আজও নিখোঁজ।

বিশ্ব কী করছে?

এই প্রশ্নে আমাদের বিবেক জেগে ওঠা উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নিলেও তা প্রায়ই শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থে হারিয়ে যায়। জাতিসংঘ বহুবার ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর হয়নি বড় শক্তিগুলোর ভেটোর কারণে।

পশ্চিমা মিডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশাকে ‘self-defence’-এর আড়ালে চাপা দেয়, যেখানে আসল সত্য হচ্ছে— নিরস্ত্র মানুষদের ওপর চালানো একতরফা বর্বরতা।

আমাদের করণীয় কী?

আমরা হয়তো যুদ্ধ থামাতে পারি না, কিন্তু আমরা মানবতা জাগাতে পারি। আমরা প্রতিবাদ করতে পারি, সহানুভূতি দেখাতে পারি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারি। কিছু করণীয় হতে পারে:

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা ছড়ানো: ফিলিস্তিনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা, মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করা।

২. মানবিক সাহায্য পাঠানো: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- UNRWA, Red Crescent, বা ফিলিস্তিন রিলিফ ফান্ড-এর মাধ্যমে সাহায্য পাঠানো।

৩. প্রতিবাদ ও পদক্ষেপে অংশগ্রহণ: শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, মিছিল, ও মানববন্ধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

৪. শিক্ষা ও আলোকপাত: আমাদের সন্তানদের সত্য জানানো—কীভাবে মানবতা, সহানুভূতি ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হয়।

বাংলাদেশের ভূমিকা

বাংলাদেশ সবসময়ই ফিলিস্তিনের পাশে থেকেছে কূটনৈতিকভাবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজ এখনও এই সংকটে ফিলিস্তিনের পাশে থাকার জন্য আওয়াজ তুলছে। কিন্তু আমাদের কাজ এখানেই শেষ নয়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানবিক জাগরণে যুক্ত করতে হবে।

শেষ কথা: কান্না থেমে গেলে বিবেক হারায়

একটি শিশুর কান্না যদি আমাদের হৃদয় নাড়ায় না, তবে আমাদের শিক্ষা, সভ্যতা, উন্নয়ন—সবই প্রশ্নবিদ্ধ। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার অধিকাংশই মানুষ ভুলে গেছে। কিন্তু যারা একবার একটি শিশুর ঠান্ডা নিঃশ্বাস ধরে কবর দিয়েছে, তারা সেই ক্ষত কোনও দিন ভুলতে পারে না।

এই যুদ্ধ থামাতে না পারলেও আমরা যেন মুখ ফিরিয়ে না নেই। ফিলিস্তিনের প্রতিটি শিশুর দিকে তাকালে যেন মনে হয়—ওর চোখে আমার সন্তানের চোখের প্রতিচ্ছবি। 

যখন শিশুর কান্না থেমে যায়, সেখান থেকেই হারিয়ে যায় সভ্যতা, হারায় বৈশ্বিক বিবেক।

লেখক: শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
মহানির্বাণ
মহানির্বাণ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
সর্বশেষসর্বাধিক