X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কার প্রচেষ্টা ও এলিটদের অনাগ্রহ

মো. সামসুল ইসলাম
০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:১৪আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:২৩

মো. সামসুল ইসলাম সাম্প্রতিককালে শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কার নিয়ে আমরা ভিন্ন ধরনের জনআন্দোলন দেখছি। এসব দাবি পূরণে সরকারের ভূমিকাকে অস্বীকার না করেও আমি বলতে চাই, সমাজে এলিট শ্রেণির অনাগ্রহ আমাদের অনেক সংস্কার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতি গঠনে বা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
এলিট বলতে আমি সংখ্যায় ক্ষুদ্র সমাজের প্রভাবশালী অংশকে বোঝাতে চাইছি। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনও তত্ত্বগত আলোচনায় না গিয়ে আমি সাধারণভাবে সমাজের রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, ধর্মীয়, আমলাতান্ত্রিক উচ্চশ্রেণিকে এলিট হিসেবে আখ্যায়িত করছি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে তাদের কতটুকু আগ্রহ আছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বহু বিতর্কিত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবির দিকে আমরা প্রথমেই দৃষ্টি দিতে পারি। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে  মানসম্মত শিক্ষার দাবিতে আমরা আন্দোলন, লেখালেখি ইত্যাদি দেখেছি। কিন্তু এখানে সংস্কারের শ্লথগতির অন্যতম কারণ আমার কাছে মনে হয় দেশের শিক্ষা নিয়ে প্রভাবশালীদের অনাগ্রহ।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত সন্তানদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী। যদিও আমরা সবাই রেজাল্ট, টেক্সটবইয়ের মান, প্রশ্নফাঁস ইত্যাদি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার চারপাশের উচ্চবিত্ত বন্ধুবান্ধবের ও পরিচিতদের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই ইংরেজি মাধ্যমে ও লেভেল বা এ লেভেল ইত্যাদি পড়ছে। এখানে পড়াশোনা শেষ করেই তারা হয় পাড়ি জমাবে বিদেশে অথবা ভালো মানের কোনও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।

কে দেশীয় বাংলা মাধ্যমে বা কে ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে এটা নিয়ে আমার বা কারোরই কোনও আপত্তি নেই। আর এখানে কারও আপত্তি থাকাও উচিত নয়। কিন্ত এর ফলে যেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো শিক্ষার উন্নয়নে প্রভাবশালীসহ সবার সম্মিলিত মনোযোগের বা আগ্রহের অভাব। সরকারও ব্যাপক চাপ অনুভব করছে না। এ কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কারের প্রচেষ্টা হচ্ছে ব্যাহত। 

শিক্ষার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বাংলা ভাষার প্রসারের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারি আসলেই অনেকেই সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের কথা বলেন, বাংলার দুরবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করেন। কিন্তু এখানেও রয়েছে প্রভাবশালীদের অনীহা। মুখে আমরা সবাই বাংলা ভাষার কথা বললেও নিজেদের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তা করি।

মনে পড়ে বেশ আগে দেশের একজন খ্যাতনামা প্রকাশক আমাকে তার এ সংক্রান্ত এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। বাংলা ভাষার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ দেশের এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে তিনি তার প্রকাশনীর কিছু শিশুতোষ বই উপহার দিয়েছিলেন তার সন্তানদের জন্য। সেই বুদ্ধিজীবী নাকি সেই প্রকাশককে বইগুলো ফেরত দিয়েছিলেন এই বলে যে উনার সন্তানরা বাংলা জানে না! এরকম ঘটনা তো আমরা হরহামেশাই শুনছি।             

আবার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা উচ্চবিত্তদের সহায়তা ছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণ করা অসম্ভব ব্যাপার। সড়ক দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারা যান সাধারণ পথচারীরা বা গণপরিবহনে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষজন। সড়ক দুর্ঘটনার কথা বাদই দিলাম, গণপরিবহনে মানুষজনের নিত্যদিনের ভোগান্তির কথা নিজস্ব গাড়িতে চলাচলকারী আমাদের প্রভাবশালীরা কতটুকু অনুভব করেন?

এই ঢাকা শহরেই দেখি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চলন্ত বাস বা মিনিবাস থেকে মানুষ নামছে বা উঠছে। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করে সবাইকে উঠতে এবং নামতে হয়, যা বয়স্কদের জন্য অসম্ভব এক ব্যাপার। আবার উবারে চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ভাড়া বাড়তে থাকে। আমি নিজেই দেখেছি স্বাভাবিক সময়ের ভাড়ার চেয়ে উবারের ভাড়া প্রায় দেড় বা দুইগুণ হয়ে যায় পিক আওয়ারে বা অফিস টাইমে, যা গরিব বা মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে।

কিন্তু উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালীরা যানবাহন চলাচলের উন্নয়নে কি কোনও রকম ত্যাগ স্বীকার করবেন? রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের এই চক্র কীভাবে ভাঙা সম্ভব? উচ্চবিত্তরা কি লন্ডন শহরের মতো তাদের নিজস্ব গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাবেন? কঠিন প্রশ্ন নিঃসন্দেহে!

ড্রাইভারদের অদক্ষতা বা তাদের হাতে মৃত্যু আমাদের পরিবহন সেক্টরে সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখলে এ ব্যবস্থার কোনও উন্নয়ন ঘটবে না। যারা পরিবহন ব্যবস্থার পলিটিক্যাল ইকনমি বোঝেন তারা জানেন এ সেক্টরের অব্যবস্থা দূরীকরণে প্রয়োজন প্রভাবশালী অংশীজনদের সহায়তা। 

একইভাবে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বলা যায় যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আমাদের এলিটদের আস্থা খুবই কম। শুধু ভারত বা থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিতে যাওয়া উচ্চবিত্ত বাংলাদেশিদের সংখ্যা এ বক্তব্যের সত্যতা নির্দেশ করে। এর কারণও আছে; যদিও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তবে আগ্রহীরা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে টিআইবির সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো তাদের ওয়েবসাইটে পড়তে পারেন। আমাদের স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে।

তবে আমি আমার আশপাশে যেটা দেখি তা হলো অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার জন্য উচ্চবিত্তরা বিদেশে পাড়ি জমান। তাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে, যেটা সাধারণ মানুষদের নেই। আমাদের দেশে অনেক খ্যাতিমান ডাক্তার আছেন। তারপরও স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের অন্যতম বাধা হলো আমাদের এলিটদের নিজের দেশে চিকিৎসা গ্রহণের অনিচ্ছা বা অনাস্থা। তারা যদি প্রকৃত অর্থেই দেশের চিকিৎসায় আগ্রহী হন, স্বাভাবিকভাবেই এই খাত চাঙ্গা হবে, সেবা ও জবাবদিহিতার মান আরও বাড়বে। এবং সেটা তারাই নিশ্চিত করতে পারবেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা একই কথা বলবো। আমাদের প্রথম শ্রেণির রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের কাছে সরকারি চাকরি মোটেই আকর্ষণীয় কিছু নয়। বিদেশে বসবাস বা করপোরেট সেক্টরে চাকরি বা ব্যবসা পরিচালনাই তাদের মূল লক্ষ্য। আমরা দেখলাম নেহায়েতই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়ে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সীমাহীন হতাশাই তাদের যে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে তা বলাই বাহুল্য। যদিও পত্রিকায় দেখলাম এমনকি পুরো কোটা ব্যবস্থা উঠিয়ে দিলেও আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগেরই কোনও লাভ হবে না। যেহেতু সরকারি চাকরির পরিমাণ খুবই কম, তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই সরকারি চাকরি পাবেন।

এক্ষেত্রে তারা যেটা আরও করতে পারেন তা হলো তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন এবং এর মাধ্যমে নিতে পারেন করপোরেট এলিটদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা–যাতে দেশে ব্যাপক সংখ্যক বিদেশি চাকরিজীবীর স্থলে তারা কিছুটা হলেও নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

আসলে দেশের উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের মতৈক্য বা এলিট কনসেনসাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সমস্যা সমাধানে শুধু রাজনৈতিক এলিট নয়, অরাজনৈতিক এলিটদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দেশের সাম্প্রতিক কিছু জনদাবি পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে এসব সমস্যার ক্ষেত্রে আমাদের এলিটদের এক ধরনের অনাগ্রহ রয়েছে, যা সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ আমাদের অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারে।     

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইলঃ [email protected]

   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
কবিগুরুর  ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
কবিগুরুর ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ