X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

দাস, স্বেচ্ছাদাস ও মনোদাস

হারুন উর রশীদ
০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:৪৪আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৪১

হারুন উর রশীদ দাসপ্রথা আইনগতভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আধুনিক দাসপ্রথা বিদ্যমান। ক্রীতদাস শব্দটি নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকলেও সেটা এখনও বাস্তবে দাপট নিয়েই আছে। এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশেই এই দাসত্বের ঘটনা এখনও খবর হয়। আর আমাদের দেশে তো শ্রমদাস (যারা আগাম শ্রম বিক্রিতে বাধ্য হন) একটা প্রচলিত বাস্তবতা। তবে, এসব দাসত্ব নিয়ে আজ আমি লিখতে বসিনি।
বেশ কিছুদিন ধরেই ‘স্বেচ্ছাদাস’ ও ‘মনোদাস’ শব্দ দু’টি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কখনও প্রবলভাবে জেঁকে বসে। আবার কখনও সেটা অবচেতন মনে চলে যায়। কিন্তু যখনই ওই শব্দগুলো উসকে দেওয়ার পরিস্থিতির মুখোমুখি হই অথবা কোনও প্রভাবক ঘটনা ঘটে, তখন মনোজাগতিক তত্ত্ব মেনেই শব্দ দু’টি আবার সামনে চলে আসে। এবার কী যেন হয়েছে, জানি না। শব্দ দুটি আর আমার মাথা থেকে যাচ্ছেই না। বারবার আমাকে আঘাত করছে, পীড়ন করছে। তাই চিন্তা ভাগাভাগি করে ভার কমানোর এই চেষ্টা। মাথাটা খালি করে একটু আরামে থাকতে চাই। আর কিছু নয়।
আমি স্বেচ্ছাদাস ও মনোদাসের সাধারণ দু’টি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছি। এটাকে ঠিক সংজ্ঞা বলাও ঠিক হবে না, আসলে শব্দ দু’টির বিস্তৃত রূপ। স্বেচ্ছাদাস হলেন তিনি, যিনি স্বেচ্ছায় বা নিজের ইচ্ছায় দাসে পরিণত হন। আর যিনি চিন্তা বা মানসিক ভাবনায় দাস মনোবৃত্তির, তাকে বলতে পারি মনোদাস।
আমার বিবেচনায় স্বেচ্ছাদাসত্বের দু’টি প্রধান কারণ রয়েছে:
১. ভয়
২. সুবিধা পাওয়ার জন্য
মনোদাস বিষয়টি একটু জটিল। আর কারণও বিস্তৃত ও নানামুখী। এরপরও কিছু কারণ আমি বিবেচনায় নিয়েছি:
১. ঐতিহাসিক
২. সামাজিক
৩. সাংস্কৃতিক
৪. রাজনৈতিক
৫. অর্থনৈতিক
সমাজে যখন একটি ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করে, তখন স্বেচ্ছাদাসত্ব বেড়ে যায়। আর এই ভয় আসতে পারে রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে। অথবা অরাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে। যারা ভয় দেখায় বা যাদের পদানত করার ক্ষমতা আছে, তারাই দাসত্বে আবদ্ধ করতে পারে স্বাধীন মানুষকে। কিন্তু এই ক্ষমতা বা ভয়কে নিরঙ্কুশ হতে হয়। আপাতত ওই ভয় বা শক্তির বিরুদ্ধে আশ্রয় পাওয়ার মতো কোনও শুভ শক্তি বা ন্যায়বিচার পাওয়ার মতো কোনও প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি থাকতে হবে। আর তাহলে সাধারণ যারা, তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই স্বেচ্ছাদাসে পরিণত হন। স্বাধীন মানুষ হিসেবে ধ্বংস হওয়ার চেয়ে তারা দাস মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাকেই শ্রেয় বলে মেনে নেন।
কিন্তু আরও কিছু মানুষ থাকেন যারা, তারা হয়তো লড়াই করতে পারেন স্বাধীনভাবে টিকে থাকার জন্য। সেই সক্ষমতা তাদের হয়তো আছে। কিন্তু তারা সেটা করেন না। তারা লোভী। তারা মূলত সুবিধা নেওয়ার জন্য, সম্পদ বাড়ানোর জন্য অথবা ক্ষমতার বলয়ে যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছাদাসে পরিণত হন। এই ধরনের স্বেচ্ছাদাস সব সময়েই আছে ও থাকবে। কিন্তু যারা বাধ্য হন, তারা যদি কোনোভাবে মুক্তির ন্যূনতম সম্ভাবনাও দেখতে পান, তাহলে দাসত্বের শেকল ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন।
মনোদাসত্ব নাগরিকদের একটা মানসিক অবস্থা। যেমন, প্রায় দুশ’ বছর ধরে ব্রিটিশ শাসনে থাকায় আমাদের মধ্যে একটা দাস মনোভাব গড়ে উঠেছে। তাই যদি না হবে, তাহলে আমাদের কেউ কেউ সেই ব্রিটিশ আমলে পাওয়া তাদের পরিবারের পদবি বা নাম গৌরবের সঙ্গে ব্যবহার করবেন কেন? আমরা তো ব্রিটিশ তাড়িয়েছি। তাদের সহযোগিতার বিনিময়ে কোনও পদবি পাওয়া এই স্বাধীন ভূমিতে তো গৌরবের হতে পারে না। কিন্তু কেউ কেউ গৌরব বোধ করেন।

একইভাবে যারা ধনী, যারা ক্ষমতাবান, তারা সমাজ ও দেশের ‘সবকিছু’—এই মানসিকতা আমরা পোষণ করি। তাই তারা সম্মানের যোগ্য না হলেও অযথাই তাদের সম্মান করি। তাদের দেখলে নুইয়ে যাই। তাদের সামনে একটু জোরে কথা বলাকেও আমরা অপরাধ বিবেচনা করি, মানুষ হিসেবে তারা যত নিকৃষ্টই হোন না কেন।
আরও উদাহরণ দেওয়া যাক। কিছু লোককে দেখবেন সাদা চামড়ার কাউকে দেখলেই বিগলিত হয়ে যায়। নিজের ভাষা ভুলে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে একটু হাঁটতে পারলে বা ছবি তুলতে পারলে ধন্য হয়ে যায়। এটাও একটা মনোদাসত্বের অবস্থা।
দীর্ঘদিনের অভ্যাস বা পরাধীন অবস্থাও দাস মানসিকতা তৈরি করে। তাইতো খাঁচার পাখিকে ছেড়ে দিলে সে উড়ে চলে যায় না। আবার যাওয়ার চেষ্টা করলেও বুনো স্বাধীন পাখিদের সঙ্গে মিশতে না পেরে আবার খাঁচায় ফিরে আসে।
চা বাগানের একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। বেশ কয়েক বছর আগে মৌলভীবাজারে একটি চা বাগানে গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে দেখেছি বাইরে থেকে আসার পর গৃহকর্মী এসে জুতা খুলে দেন। আবার ম্যানেজার যখন বাগানে ঘুরতে বের হন, তখন কোনও শ্রমিকের পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল থাকলে তারা তা খুলে ফেলে কুর্নিশ করে সালাম করেন। বাংলোর ভেতরে তাদের যদি বসতেই হয়, তাহলে তারা ফ্লোরে বসেন। চেয়ারে বসার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। আমি পরে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এটাকেই মনে করেন সম্মান দেখানোর উপায়। চা বাগানের শ্রমিকরা এভাবেই দীর্ঘদিন চলে আসা নিয়মে পিষ্ট হয়ে মনোদাস হয়ে গেছেন।
দেখবেন কোনও কোনও দেশে রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। এটা দীর্ঘদিন চলতে থাকার পর আর সরকার বা রাষ্ট্রকে তা করতে হয় না। সংবাদমাধ্যম নিজেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। কোনও আদেশ না পেলেও নিজেই নিজেকে সেন্সর করে।
যে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক কোনও পরিবর্তনের পথ বন্ধ হয়ে যায়, ব্যক্তির ইচ্ছায় সবকিছু পরিচালিত হয়, প্রতিবাদ বা মত-প্রকাশের সুযোগ থাকে না, সেখানে স্বেচ্ছাদাসত্বের সংস্কৃতি তৈরি হয়। দীর্ঘকাল ধরে সেই অবস্থা চলতে থাকে, তখন সেই নেতিবাচক পরিস্থিতিই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। অধিকাংশই তখন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে শুরু করেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে স্বেচ্ছাদাস এবং পরে তারা মনোদাসে পরিণত হন। এই মনোদাসত্ব একপর্যায়ে জেনেটিক হতে পারে। মনোদাসত্ব পরের প্রজন্মের জিনগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে পারে।
আমাদের দেশে করপোরেট কালচারের নামে এই মনোদাসত্ব একটি সাংস্কৃতিক রূপ পাচ্ছে। আর রাজনীতিতে আমরা স্বেচ্ছাদাস ও মনোদাসের উপস্থিতি দেখতে পাই। এটা রাজনীতি যারা করেন, তাদের বাইরে থেকে রাজনীতির ও ক্ষমতার সুবিধা নিতে চাওয়া লোকজনের মধ্যেই প্রবল বলে আমার মনে হয়।
দেখবেন আজকাল বিভিন্ন পেশার লোকজন, যারা রাজনীতি করার কথা নয়, তারা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার প্রমাণ হাজির করতে চান বারবার। সময় বুঝে তারা ব্যানারও হাজির করেন, স্লোগানও দেন, আদর্শের সৈনিক দাবি করেন। তারা সুবিধা নেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাদাসে পরিণত হন। তবে কেউ কেউ আবার চাপের মুখে পড়ে অস্তিত্ব রক্ষায় স্বেচ্ছাদাস হন।
কিন্তু ভয়ঙ্কর হচ্ছে মনোদাসত্ব। এটা যদি হয়, তাহলে তা সঞ্চারিত হতে পারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তখন তারা স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মত-প্রকাশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে ভুলে যান। তার চিন্তার বন্দিত্বকেই স্বাভাবিক মনে করেন। আর তাই যদি হয়, তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ তার প্রগতিশীল চরিত্র হারায়। টিকে থাকে, কিন্তু সেখানে স্রোত থাকে না। মাঠ থাকে, ফসল থাকে না। জন্মায় আগাছা আর শ্যাওলা।
আর একটি কথা। এই দাসত্বের পরিবেশ যদি রাজনৈতিক কারণে হয়, তাহলে তা দীর্ঘকাল বজায় থাকতে পারে। অরাজনৈতিক শক্তি চেষ্টা করলেও দীর্ঘকাল ওই দাসত্বের পরিবেশ ধরে রাখতে পারে না। কারণ, রাজনৈতিক শক্তিই তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি দাসত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কে?

পাদটীকা: মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের একটি কথা এখানে বলছি, হয়তো আপনাদের কারও কাছে এই কলামে কথাটি প্রাসঙ্গিক মনে নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ‘স্বেচ্ছাদাস’ ও ‘মনোদাস’ তৈরিতে যারা ভূমিকা রাখেন, তাদের জন্যই আব্রাহাম লিংকন হয়তো এই কথাটি বলেছিলেন, ‘Those who deny freedom to others deserve it not for themselves; and, under a just God, cannot long retain it.’

লেখক: সাংবাদিক
ই-মেইল:[email protected]

 

 

/এমএনএইচ/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি অংশের ডাউন র‌্যাম্প খুলে দেওয়া হচ্ছে
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি অংশের ডাউন র‌্যাম্প খুলে দেওয়া হচ্ছে
পোস্ট অফিসে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট উদ্বোধন করলেন সুইডেনের প্রিন্সেস
পোস্ট অফিসে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট উদ্বোধন করলেন সুইডেনের প্রিন্সেস
এক‌দি‌নের রিমান্ড শে‌ষে কারাগারে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম
এক‌দি‌নের রিমান্ড শে‌ষে কারাগারে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম
যে কারণে রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করলো মলদোভা
যে কারণে রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করলো মলদোভা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ