X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

অশুদ্ধ তালিকা দেশপ্রেমের শুদ্ধ লড়াইকে ম্লান করে না

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:০২আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:৩৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা পুরনো সমস্যা, নতুন মোড়। বহুদিন ধরেই আমরা জানি, অনেকে মুক্তিযুদ্ধ না করেও ঢুকে পড়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। আবার অনেক স্বীকৃত রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। তবে এবার ঘটলো আরও জটিল ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাঁই হলো রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের তালিকায়। শুধু তাই নয়, গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা, বেশ কয়েকজন সুপরিচিত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামও ঢুকে পড়েছে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীদের এ তালিকায়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলিকেও। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক, দেশজুড়ে বইছে সমালোচনার ঝড়। ইতোমধ্যেই বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ‘রাজকারের তালিকা’টি স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রথমে বলার চেষ্টা করেছেন, তালিকাটি ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি প্রশাসনের করা, তাদের নয়। পরে বলেছেন, তারা দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন কিছুই বদলাননি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যা পাওয়া গেছে, তাই তিনি যাচাই-বাছাই না করে প্রকাশ করেছেন। তবে, এখন তিনি রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম আসায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলছেন, ভুলের পরিমাণ বেশি হলে পুরো তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। মানুষ ক্ষোভ ঝাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে, বলছে, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। যাচাই-বাছাইয়ের দরকার ছিল। 
রবিবার প্রকাশিত রাজাকারের এ তালিকায় ঠাঁই হয়েছে বরিশালের ভাষা সৈনিক মিহির লাল দত্তের। বরিশালের সুপরিচিত সাংবাদিক মিহির লাল দত্ত একাধারে কবি, নাট্যকার, গীতিকার, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পিতা জিতেন্দ্র লাল দত্ত ও মেঝো ভাই সুবীর দত্ত পান্থ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। রাজাকারের তালিকায় পিতার নাম আসায় মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তালিকায় আছেন বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তী। তার মাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ তালিকায়। তার মা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও কীভাবে তাদের নাম এসেছে, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বরিশাল বাসদের জেলা সেক্রেটারি ডা. মনীষা চক্রবর্তীর অভিযোগ, স্থানীয় রাজনীতির রোষানলের শিকার হয়েছেন তারা।

এরকম প্রতিটি জেলা ধরে ধরে বলা যাবে, তালিকাটি কতটা ত্রুটিপূর্ণ। একটি ভালো কাজকে কীভাবে নষ্ট করে দেওয়া যায়, তার দৃষ্টান্ত এই তালিকা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যেকোনও রাজাকার এখন বলতে পারবে, সে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তালিকা ঠিক না হওয়ায় তার নাম আসেনি। সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক বিষয় হলো, যে মানবতাবিরোধী অপরাধের  বিচার করার জন্য এই সরকার চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে, সেই বিষয়টাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এই তালিকা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষা সৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ আরও অনেকের নামই উঠে এসেছে এই তালিকায়। 

সামাজিক মাধ্যমজুড়ে যেন হাহাকারের রোল। এত ঢাক ঢোল পিটিয়ে, এত অর্থ, সময়শক্তি, উৎকণ্ঠা উল্লাস, আর স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে এত লড়াইয়ের পর এই তালিকা! আমাদের দক্ষতা বা সততার এতই অধঃপতন ঘটেছে যে, এমন একটা প্রশ্নবিদ্ধ তালিকার পরও সংশ্লিষ্টদের মনে রেখাপাত করে না? একটা ত্রুটিহীন ‘রাজাকার তালিকা’র জন্য আর কত সংগ্রাম করতে হবে আমাদের? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আজকের পর থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে যেতে পারবেন? হয়তো পারবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রশ্নের তো মীমাংসা হয়নি যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর প্রকৃত রাজাকার কে! যেহেতু এই তালিকাকে সবাই অস্বীকার করতে চাইছে, বলা হচ্ছে এটি ভুলে ভরা এবং যেহেতু ভুল নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যেহেতু প্রচুর প্রকৃত রাজাকারের নাম বাদ গিয়েছে, ফলে এই ঠিক-বেঠিক, সংযোজন-বিয়োজনের খেলা হয়তো চলতেই থাকবে অনন্তকাল। 

প্রশ্ন হলো— রাজাকারের তালিকা যদি পর্বতের মূষিক প্রসব হয়, তবে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর বাদই দিলাম, গত ১১টি বছর এই সরকার ক্ষমতায়, তার পরিক্রমা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে কত লড়াই, কত ত্যাগ, লক্ষ মানুষের শ্রম, শক্তি ব্যয়, উৎকণ্ঠা হয়রানি, এই সব কিছুর কোনও মূল্য থাকবে না? 

এই তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশে ব্যর্থতার কারণগুলো ব্যাখ্যা করা দরকার। খারাপ লেগেছে এখনও যে ভাষায় কথা বলছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলছেন, কেউ আবেদন করলে সেই আবেদন বিবেচনা করে তালিকা সংশোধন করা হবে। এটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা ভিক্ষা দেওয়া নয়? ভুল করেছেন আপনি, মাফ চাইবে মুক্তিযোদ্ধারা? 

এই তালিকা কাউকেই খুশি করতে পারেনি। ভিক্টিম মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ছেড়েই দিলাম, এমনকি খোদ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও তুষ্ট নয়। জামায়াতের  মতো স্বাধীনতাবিরোধী দল ও এ জাতীয় গোষ্ঠীর সারাজীবনের চেষ্টা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়া, বিতর্কিত করা। মন্ত্রী একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সেই ফাঁদে যেন পা দিলেন। 

এই তালিকাটি হয়তো শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হবে, প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু এতেও পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া যাবে না, কারণ বারবার রাজনৈতিক কারণে এই তালিকাই আগামীতে রেফারেন্স হিসেবে আসবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিলো আর তিনি কোনও কিছু নিশ্চিত না হয়ে তা প্রকাশ করে দিলেন–মন্ত্রীর এই বক্তব্য আমাদের আতঙ্কিত করে।  

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। সবাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও সেই সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোনও না কোনোভাবে যুদ্ধ করেছে। রাজাকার, আল বদর আর আল শামস বাহিনী ভয়ঙ্কর সব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা কখনও মুক্তিপাগল মানুষের চেয়ে বেশি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে এই তালিকা নির্ভুলভাবে করা। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি কাজ আছে এই মন্ত্রণালয়ের। মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ শক্তিশালী করা, সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করা, সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।   

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের অনেক নেতাই চিরকাল তাদের ভুল জনগণের ওপর চাপাতে চেষ্টা করেছেন, নিজেরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় নিতে চাননি, আজও সেই পথেই চলেছেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা বা পরিবারের সদস্যরা রাজাকারের তালিকায় নিজেদের বা স্বজনদের নাম দেখে কষ্ট পেয়েছেন, তাদের জন্য শুধু একটিই সান্ত্বনা–অশুদ্ধ তালিকা কোনোভাবেই দেশপ্রেমের শুদ্ধ লড়াইকে ম্লান করতে পারে না। 

মহতী উদ্যোগ যেন ব্যর্থ না হয়, সেই প্রচেষ্টায় ত্রুটি রাখা ঠিক নয়। তাই তালিকা প্রত্যাহার করে নির্ভুল নতুন তালিকা করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে–যেকোনও অর্ধ-ক্রিয়ার বিপরীতে পূর্ণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
সর্বশেষসর্বাধিক