X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি, দুই শিশুর লাশ দেখে বুকটা ভেঙে গেছে’

ছত্রকান্দা (ঝালকাঠি) থেকে সালেহ টিটু
২৩ জুলাই ২০২৩, ০১:০৩আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৩, ০৭:১৭

‘বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিসহ কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা চেয়েছি— সবাইকে জীবিত উদ্ধার করতে। কিন্তু পারলাম না। ২১ জনকে উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে আট জনের লাশ পেয়েছি। বাকি ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছি। তবে ডুবন্ত বাসে দুই শিশুর লাশ পেয়ে বুকটা কান্নায় ভেঙে যাচ্ছিল। খুব অসহায় লাগছিল নিজেকে।’ উদ্ধার অভিযানের বর্ণনা দিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেছেন ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন ছত্রকান্দা এলাকার চা-দোকানি মো. রনি।

শনিবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন ছত্রকান্দা এলাকায় যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। পাশেই ছিল রনির দোকান। চোখের সামনে দুর্ঘটনা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুকুরে। উদ্ধার করেন ২১ জনকে। তার সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। চা-দোকানি মো. রনি

তাদের এই উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) মো. বাবু। তিনি বলেন, ‘বিপরীতগামী অটোরিকশাকে সাইড দিতে গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি পুকুরে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে চালক পালিয়ে যান। তাৎক্ষণিক এলাকাবাসী এবং আশেপাশের -দোকানিদের সঙ্গে নিয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। বাসটি পড়ার পর ডুবে যায়। জানালার গ্লাস ভেঙে আট জনের লাশ উদ্ধার করেছি। এ ছাড়া আহত ১৩ জনকে উদ্ধার করে সড়কে নিয়ে আসি। উদ্ধারকালে জানালার গ্লাসে আমার এবং রনির হাত কেটে গেছে। এরপরও উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাই। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধারকাজে যোগ দেয়।’

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ওই এলাকার বাসিন্দা আক্কাস সরদার বলেন, ‘এক বৃদ্ধা নারীর পা ধরে টেনে আনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি বাসের ভেতরের রড এমনভাবে ধরা ছিলেন, কোনোভাবেই তাকে আনা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে তার হাত জোর করে টেনে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে আসি।’

চা-দোকানি রনি বলেন, ‘বাসের ভেতরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাসের জানালা ও দরজা খুঁজে বের করে উদ্ধারকাজ চালাতে থাকি। ওই সময় কে মৃত কে জীবিত তা খেয়াল করিনি। আমরা চেয়েছি— সবাইকে জীবিত উদ্ধার করতে। এ সময় একটি শিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে আসি। কিন্তু কোলে তুলে দেখি মৃত। বয়স দুই-তিন বছর হবে। তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। এরপর আরেক শিশুর লাশ পাই। দুটি শিশুই মারা গেছে। তখন কান্নায় বুকটা ভেঙে আসছিল। এত লাশ একসঙ্গে আগে কখনও দেখিনি।’

ছত্রকান্দা এলাকার বাসিন্দা মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘যারা বাসের ছাদে ছিলেন তারা সাঁতরে তীরে উঠেছেন। কিন্তু ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা নারী-শিশুরা বের হতে পারেননি। পুকুরটি এতই গভীর ছিল যে, বাসটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায়। আমাদের চোখের সামনে দৌড়ে চালক পালিয়ে গেছেন। কয়েকজন ধাওয়া করেছেন। কিন্তু তাকে ধরতে পারেননি। আর সুপারভাইজার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সুপারভাইজারও পালিয়ে গেছেন।’ ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ভান্ডারিয়ার এক বাসচালক পৌর এলাকার বাসিন্দা বলেন, ‘ওই বাসটি অনেক পুরনো। চলার সময় মাঝেমধ্যে গিয়ার নষ্ট হয়ে যেতো। ব্রেকও ঠিকমতো কাজ করে না। আমার ধারণা, ঘটনার সময় অটোরিকশাকে সাইড দিয়ে ব্রেকফেল করেছেন চালক। তখন গিয়ার তুলতে পারেননি। ফলে বাসটি পুকুরে ফেলে দেন। দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালক নন; ওই বাসের মালিকও দায়ী।’

ঝালকাঠির সহকারী পুলিশ সুপার মাসুদ রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালক ও সুপারভাইজার জীবিত রয়েছেন। তাদের নাম-পরিচয় পেয়েছি। যেকোনও মুহূর্তে তাদের আটক করা হবে। আটকের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় জানাতে পারছি না।’

নিহতরা হলেন—পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া পৌর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য ভান্ডারিয়ার সালাম মোল্লা (৬০), তার ছেলে শাহীন মোল্লা (২৫), ভান্ডারিয়া উপজেলার উত্তর শিয়ালকাঠি এলাকার রাবেয়া বেগম (৮০), একই উপজেলার পশুরবুনিয়া এলাকার জালাল হাওলাদারের শিশুকন্যা সুমাইয়া (৬), রিজার্ভ পুকুরের পাড় এলাকার রহিমা বেগম (৬০), তার ছেলে আবুল কালাম হাওলাদার (৪৫), একই এলাকার সাদিয়া বেগম (২২), ভান্ডারিয়া পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের তারেক রহমান (৪৫), কাঁঠালিয়া উপজেলার বাঁশবুনিয়া গ্রামের সালমা আক্তার মিতা (৪২), রাজাপুর উপজেলার নিজামিয়া এলাকার নজরুল ইসলামের মেয়ে খুশবু আক্তার (১৭), একই এলাকার খাদিজা বেগম (৪৩), দক্ষিণ রাজাপুরের বলাইবাড়ী এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. নয়ন (১৬), একই উপজেলার মো. রিপনের স্ত্রী আইরিন আক্তার (২২), তার শিশুকন্যা রিপা মনি (২), রাজাপুরের আহসান খানের ছেলে জাহাঙ্গীর খান (৫৫) ও বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরবোয়ালিয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ (৮)। তবে একজনের লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি।

জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল ‍নিঝুম বলেন, ‘স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ জনের মধ্যে ১৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি একজনের লাশ শনাক্তের পর হস্তান্তর করা হবে।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকালে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে ছেড়ে আসা বরিশালগামী ‘বাসার স্মৃতি’ পরিবহনের একটি বাস ছত্রকান্দা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে পুকুরে পড়ে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এবং স্থানীয়রা উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সেইসঙ্গে নিহতদের লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে পাঠায়।

/এমএস/এএম/
টাইমলাইন: ঝালকাঠিতে বাস পুকুরে পড়ে দুর্ঘটনা
২৩ জুলাই ২০২৩, ০১:০৩
‘১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি, দুই শিশুর লাশ দেখে বুকটা ভেঙে গেছে’
সম্পর্কিত
বজ্রাঘাতে ৮ জেলায় ১০ জনের মৃত্যু
গরু কিনতে যাওয়ার পথে বাবা-ছেলে নিহত
যাত্রাবাড়ীতে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ২
সর্বশেষ খবর
চালককে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাই: ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড
চালককে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাই: ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড
হজের ভিসায় মক্কা, জেদ্দা ও মদিনার বাইরে ভ্রমণ করা যাবে না
হজের ভিসায় মক্কা, জেদ্দা ও মদিনার বাইরে ভ্রমণ করা যাবে না
‘মোবাইলে দেখেন, ভারতের মানুষের দিনে ইনকাম কত আর আমাদের কত’
‘মোবাইলে দেখেন, ভারতের মানুষের দিনে ইনকাম কত আর আমাদের কত’
রাষ্ট্রপতি পেলেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ লেখা স্মার্ট এনআইডি
রাষ্ট্রপতি পেলেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ লেখা স্মার্ট এনআইডি
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র