X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১০

আঙ্গুরবালা দেবীর গান গাইতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী ভয় পেতেন

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
০১ আগস্ট ২০২২, ১৫:৫৭আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৮:৩১

সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘প্রতিমা বাঁশরীকণ্ঠী’। তাই সা থেকে সা তার চাইতে সুরে আর কেউ গাইতে পারে না!’ তিনি প্রতিমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। 

‘ছুটি’ ছবিতে অরুন্ধতী দেবীর সংগীত পরিচালনায় গাইতে পেরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব খুশি হয়েছিলেন। ছবিতে ভ্রমর নামে লিউকোমিয়া আক্রান্ত একটি মেয়ের গলায় প্রতিমার জন্য দুটি গান রাখা হয়েছিল। রিহার্সালে অরুন্ধতী-প্রতিমা মিলে ঠিক করলেন যথাসম্ভব সফট করে গাইতে হবে। গান দুটি-
‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ ও ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’ এই দুই গান যেন সময়কে থামিয়ে দেয়। এই কথাটা একবার প্রতিমাকে বলা হলে, উনি বলেছিলেন, ‘আঙ্গুরবালা দেবীর গান। গাইতে খুব ভয় লেগেছিল। তারপর একটু নিজের মতো করে নিলাম। ‘চৌরঙ্গী’র পর তাতেই তৃতীয়বার বিএফজেএ এসেছিল।

আঙ্গুরবালার গান গাইতে প্রতিমার মতো শিল্পী ভয় পান। এতেই, আঙ্গুরবালার গান ও গায়কি সম্পর্কে অতি সহজেই ধারণা করা যায়।

প্রখর স্মৃতির অধিকারী আঙ্গুরবালা শিশু বয়সে যে কোনও গান একবার মনোযোগ সহকারে শুনলেই, হুবহু গেয়ে দিতে পারতেন। তার এই গুণের পরিচয় পেয়ে আশেপাশের সবাই তাকে গান শেখার জন্য উৎসাহ দিতেন।

ছোট বয়সে বাবার বন্ধু অমূল্য মজুমদারের কাছে অনিয়মিতভাবে হারমোনিয়াম বাজানো শেখেন। তাল, লয়-এর সম্পর্কে কিছু জ্ঞান প্রাপ্তিও ঘটে। এরপর জিতু ওস্তাদের কাছে শিখেছেন ভাঙা খেয়াল ও ঠুংরি।

অল্প বয়সেই আঙ্গুরবালার গানের জগতে মোটামুটি একটা অবস্থান তৈরি হয়। লোকজনের প্রশংসাও পাচ্ছিলেন। এই রকম একটা সময়ে ওস্তাদ রামপ্রসাদের কাছ থেকে খেয়ালের তালিম নেওয়া শুরু করেন। তানপুরা নিয়ে বসতেন। ওস্তাদজি প্রতিদিনই তাকে  ‘সা’ বলাতেন। এবং শুনে বলতেন ‘ঠিক নেহি হুয়া।’ বেশ কিছুদিন রেওয়াজ করার পর, একদিন বললেন, ‘আভি ঠিক হুয়া।’

আঙ্গুরবালা স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘‘তানপুরার তারের সঙ্গে গলার সুরের সামঞ্জস্যের ফলে ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো একটা আওয়াজ হলো, আর ওস্তাদজি বলে উঠলেন ‘ঠিক হুয়া’, এভাবেই শুরু হয় ‘সা’র সঙ্গে আমার সম্যক পরিচিতির ইতিহাস।’’ 

এরপর তিনি গজল, ঠুংরি, দাদরা শেখার জন্য  প্রখ্যাত ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ’র থেকে তালিম নেওয়া শুরু করেন। জমিরউদ্দিন খাঁ’র শিক্ষায় আঙ্গুরবালার শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিত গড়ে উঠে।  এবং দিন দিন পোক্ত  হতে থাকেন। পেয়ারু কাউয়ালের কাছে তিনি কাউয়ালি শেখেন। খ্যাতিমান কীর্তনিয়া ইশান ওস্তাদের কাছে কীর্তনে তালিম নেন। 

সেই সময়ের বিরূপ  সামাজিক পরিবেশে গান-বাজনা চালিয়ে নেওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। সমাজের স্বীকৃত স্থান হতে যে কোনও ধরনের স্বীকৃতি প্রচুর উদ্দীপনার সৃষ্টি করতো। ভরসার জায়গা তৈরি করতো। যেমন- হায়দরাবাদের দরবারের এক সভাকবি নিজামের প্রশংসা করে দুটি কবিতা লিখেছেন। উর্দু ভাষায়। নিজামের ইচ্ছা-আঙ্গুরবালার কণ্ঠে তা রেকর্ড করা হোক। কবিতা দুটিতে ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ সাহেব সুর দিলেন। আঙ্গুরবালা গাইলেন। রেকর্ড লেবেলের এক পিঠে নিজামের ছবি। অন্য পিঠে আঙ্গুরবালার ছবি। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেলো। বিশেষ করে হায়দরাবাদে। এই রেকর্ড এবং রেকর্ডের লেবেলে নিজামের ছবি আঙ্গুরবালাকে সম্মান প্রদর্শন হিসাবেই বিবেচিত হয়েছে। সংগীত জীবনে এই ধরনের সম্মানে, আঙ্গুরবালা  বারবার সিক্ত হয়েছেন ।

আঙ্গুরবালার জন্ম সাল বা তারিখ নিয়ে অভিন্ন মত পাওয়া যায় না। ৭ জানুয়ারি ১৯৮৪, আঙ্গুরবালার প্রয়াণ করেন। পরের দিন  বিভিন্ন সংবাদপত্র মৃত্যু সংবাদ ছাপে। মৃত্যু সংবাদে জন্ম সাল-তারিখ নিয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। যেমন- যুগান্তর পত্রিকা লিখেছে আঙ্গুরবালার জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৭ শ্রাবণ।

The Telegraph-এ প্রকাশিত মৃত্যু সংবাদে বলা হয়েছে,- Angurbala Devi was born in a Barhmin family in 1899. The Statesman- এ লেখা হয়েছে, Born Prabhabati Banerjee at the turn of the century. 

তার জন্ম হয়েছিলো উত্তর কলকাতার কাশীপুরে। পিতার নাম সুধীর কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম হরিমতী দেবী। পরিবারের কর্তারা তার নাম রাখেন প্রভাবতী দেবী। দর্জি পাড়ায় জয়রাম মিত্র স্ট্রিটের মিশনারি স্কুলে পড়ালেখার শুরু। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। 

ললিতমোহন ছিলেন স্টার থিয়েটারের নৃত্য পরিচালক। সুধীর বাবুর বন্ধু। বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছেন অনেকদিন পর। কিশোরী আঙ্গুরের গান শুনে তিনি মুগ্ধ। থিয়েটারে গান গাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সুধীর বাবু সমাজের কথা চিন্তা করে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। সুধীর বাবুর সাথে সুবিধা করতে না পেরে এবার হরিমতী দেবীকে বোঝাতে লাগলেন। এবং সুধীরকে রাজি করাতে তার সাহায্য চাইলেন। অবশেষে দু’জনেই রাজি হলেন। পরের সপ্তাহে বুধবারে  আঙ্গুরকে নিয়ে স্টার থিয়েটারে যাবার দিন ঠিক করলেন ললিতমোহন। তখনকার দিনে বুধ, বৃহস্পতি, শনি ও রবিবার পেশাদারি থিয়েটার হতো। 

তখনও তিনি আঙ্গুরবালা হননি। সেই সময়ে তার পোশাকি নাম প্রভাবতী। ডাক নাম ন্যারা। বুধবারে ললিতমোহন স্টার থিয়েটারে গিয়ে জানালেন, প্রভাবতী নাম চলবে না। এই নামে স্টার থিয়েটারেই দু’জন অভিনেত্রী আছেন। তিনি নতুন নাম দিলেন- আঙ্গুরবালা। 

জীবনের শেষদিকে এসে আঙ্গুরবালার মন্তব্য, ‘সেদিন সে মুহূর্তে স্টার থিয়েটারের লবিতে দাঁড়িয়ে যে নামকরণ করেছিলেন ললিত কাকা, সেই নামের গ্লামার ও মোহ আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ওই নামের চটকের আড়ালে কোথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আমার মায়ের শখ করে দেওয়া নাম প্রভাবতী। এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ললিত কাকার দেওয়া আঙ্গুরবালা নামের সব গৌরব আর যন্ত্রণা।’

তবে স্টার থিয়েটারে দিনটি মোটেও ভালো যায়নি। ললিতমোহন তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টার থিয়েটারের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা কুসুমকুমারীর কাছে। পরিচয় দিয়েছিলেন। গানের ওপর আঙ্গুরের দখল নিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু কুসুমকুমারী একটি কথাও বলেননি। আঙ্গুরের উপস্থিতিকে চরমভাবে উপেক্ষা করেছেন। এই অপমান তিনি মেনে নিতে পারেন নি। মানসিকভাবে বেশ কিছুদিন বিপর্যস্ত ছিলেন। এবং একসময় অসুস্থ হয়ে পরেন। 

রোগমুক্তির পর আঙ্গুরবালা আবারও রেওয়াজ শুরু করেন। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া, স্টার থিয়েটারের ঘটনার কথা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। তবে হাল ছেড়ে দেন না। ওই অল্প বয়সে মনে মনে শপথ নেন, যত কষ্টই হোক, নিজেকে অনেক বড় গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এবং অল্প বয়সে খেলাধুলা, দুষ্টুমিসহ সব ধরনের চাওয়া-পাওয়া বাদ দিয়ে গানকেই একান্ত নিজের করে নেন। গানেই পূর্ণাঙ্গভাবে নিজেকে সমর্পণ করেন।

এই মগ্নতায় একদিন তিনি রেওয়াজ করছিলেন। পাশের ঘরে তার বাবার বন্ধু সনতাবাবু ও জিতেন ঘোষ এসেছেন। রেওয়াজ শুনে তারা বিস্মিত হন। তাদের ধারণা ছিল না যে, তাদের স্নেহের ন্যারা এতো ভালো গাইতে পারে। দু’জনারই গ্রামোফোন কোম্পানিতে ভালো যোগাযোগ ছিল। তারা আঙ্গুরবালাকে গান রেকর্ড করার জন্য বলেন। কিন্তু আঙ্গুরবালা রাজি নন। বারবার বলার পরও সে রাজি হচ্ছে না। সবাই ভেবে ভেবে অস্থির কেন সে রাজি হচ্ছে না। আসলে একেবারে ছোটবেলা থেকেই আঙ্গুরবালার মধ্যে গ্রামোফোন ভীতি কাজ করে। এই ভীতির সূত্রপাত নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘‘স্কুলে যাওয়ার পথে একটি বাড়ির জানালার বাইরে ভিড় দেখে আর গানের আওয়াজ শুনে আমি আর আমার বোন বিজু দাঁড়িয়ে পড়লাম। …জানালার গরাদের ভেতর দিয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে অবাক। ...একটা কালো মতন কী যেন ঘুরছে আর একটা বিরাট চোঙের ভেতর থেকে একটা মেয়ে গান গাইছেন। বিজু বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ‘ওই যে বাক্সটা, ওটার মধ্যে একটা মেয়ে বসে গান গাইছে, আর চোঙটার ভেতর দিয়ে সেই গান বাইরে চলে আসছে’। বিজু বলল, ‘হাত পা সব কেটে নিয়ে, ছোট করে ওর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, গান তো গাইবে গলা দিয়ে, হাত পায়ের কী দরকার বল। যারা কলের গান করে তাদের হাত-পা আগে থেকে কেটে কেটে ছোট করে দেয়।

আমি বললাম, ‘মেয়েটা খাবে কী করে? বিজু বললে, ‘ওই যে অতো বড় চোঙটা দেখছিস, ওটা তবে কী জন্য? ওর ভেতর দিয়ে মাছ, মাংস, ভাত, রসগোল্লা- সব দিয়ে দেয়। আর মেয়েটা চোঙের ওপারে বাক্সের ভেতর থেকে গপগপ খেয়ে নেয়’।’’

বিজুর বলা কথাগুলোকে তিনি সত্য ধরে নেন। এবং তার মধ্যে গ্রামোফোন সম্পর্কে এক ধরনের ভয় তৈরি হয়। সেই ভয় তখনও কাজ করছিলো। যে কারণে, গ্রামোফোনের জন্য রেকর্ড করতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে বিজু যখন বলল এইসবই তাকে বোকা বানানোর জন্য বলেছে, তখন আঙ্গুরবালা গান রেকর্ড করতে রাজি হন। 

আর ওই দিনই সুধীর বাবু মেয়েকে নিয়ে তার  দুই বন্ধুর সঙ্গে বেলেঘাটায় রেকর্ডিং স্টুডিওতে গেলেন। এক বিদেশি সাহেব  তাদের স্বাগত জানালেন। সুধীর বাবু ও তার বন্ধুদের সাথে তিনি কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন। কথা শেষে তার বাবা ও সাহেব আঙ্গুরবালাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। সেই ঘরে একটা উঁচু জায়গায় তিনটি বড় বড় চোং বসানো। চোংগুলোর পেছনে সারা ঘর কালো পর্দায় ঢাকা। মঞ্চের মতো উঁচু একটা জায়গাতে  তবলা হারমনিয়ামসহ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র আছে।

সুধীর বাবু আঙুরবালাকে বললেন, ‘সাহেব তোমার গান শুনতে চাচ্ছেন।’

বাবার কথায় আঙ্গুরবালা উঁচু জায়গায় উঠে নিজের কাছে হারমনিয়াম টেনে নিলেন। একজন এসে তবলায় বসলেন। সাহেব পর্দা সরিয়ে অপরদিকে গেলেন। অল্পসময় পরে ফিরে এসে ইংগিতে গাইতে বললেন। আঙ্গুরবালা গাইতে শুরু করলেন, ‘বাঁধ না তরীখানি আমার এই নদীকূলে’। অসাধারণ গায়কি। শুরু থেকেই গানের সাথে একাত্ম হয়ে  গেছেন। চোখ বুজে গেয়ে যাচ্ছেন। গান শেষ হলে, সাহেব এসে ওয়ান্ডারফুল ওয়ান্ডারফুল বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বয়সের দিক থেকে কিশেরী শিল্পী এবার চোখ খুললেন। বাবা ও বাবার বন্ধুদের চেহেরায় আনন্দের ছোঁয়া। এরপর আরও একটি গান রেকর্ড করা হয়। গানের প্রথম লাইন ছিল—
‘কালা তর তরে কদমতলায় এসে থাকি’। গান দুটি দারুণ হিট হয়। 

গানের সুর কে করেছেন তা জানতেন না আঙ্গুরবালা। একইভাবে জানতেন না কে গানের কথা লিখেছেন। গান দুটির জন্য আঙ্গুরবালাকে চল্লিশ টাকা সম্মানী দেওয়া হয়। গান দুটি জনপ্রিয়তা পায়। বিক্রিও ভালো হয়। আঙ্গুরবালা

কয়েক মাস পর গ্রামোফোন কোম্পানি আঙ্গুরবালার আরও ছয়টি গান রেকর্ড করে। তার মধ্যে একটি গান ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোমারি গৃহে পালিছ স্নেহে’। এই গানে রবীন্দ্রনাথের নামের কোনও উল্লেখ ছিল না। আঙ্গুরবালার রেকর্ড প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হতে থাকে। 

নবাগত গায়িকা হিসেবে তার রেকর্ড বিক্রির পরিমাণ বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তা ভগবতী বাবু একদিন নিজেই সুধীর বাবুর বাসায় এলেন। জানালেন, গ্রামোফোন কোম্পানি নিয়মিতভাবে আঙ্গুরবালার গানের রেকর্ড প্রকাশ করতে ইচ্ছুক। এবং এজন্য তাকে সম্মানজনক সম্মানী দেওয়া হবে। এরপর কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী আঙ্গুরবালা নিয়মিতভাবে গান রেকর্ড করতে থাকেন। 

১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট নাট্যকার, অভিনেতা, কবি গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুতে একধরণের শূন্যতা তৈরি হয়। নাটকের দর্শকও কমে যায়। সে সময়ে নাটকের দর্শক আকর্ষণ করার জন্য নাটকে ভালো গান ব্যবহার করা হতো।

‘ম্যাডন কোম্পানি’র মালিক ম্যাডন সাহেবর জামাইর প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গলি থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’র নাটক ‘মুক্তার মুক্তি’ নাটকে গান গাইবার জন্য আঙ্গুরবালাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছিলেন মনিলাল বাবু। সুধীর বাবু আবার দ্বিধায় পড়লেন। উনি মেয়েকে থিয়েটারে গান গাইতে দিতে চাননি। কিন্তু মেয়ের অতিমাত্রায় উৎসাহ দেখে রাজি হয়ে যান। 

এই অতিমাত্রার উৎসাহ নিয়ে আঙ্গুরবালা স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘মনিলাল বাবুর প্রস্তাবে আমার এই বাড়তি রাজি হওয়া দেখে বাবা খুবই খুবই অবাক হয়ে গেছিলেন। কিন্তু বাবা তো আর জানতেন না, স্টার থিয়েটারে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে কী শপথ নিয়েছিলাম। যে কুসুমকুমারীর কাছে সেদিন আমি প্রত্যাখ্যাত, সেই কুসুমকুমারী অভিনীত নাটকের টিকিট বিক্রি বাড়াবার জন্য আমার ডাক, এই আহবান কি উপেক্ষা করা চলে? আর তা ছাড়া যে অভিনেত্রীমণ্ডলী আমাকে ডাক পাঠিয়েছেন তার মধ্যে কুসুমকুমারীও তো আছেন।’

এই থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর কুসুমকুমারীর সাথে আঙ্গুরবলার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। ‘মুক্তার মুক্তি’ নাটকে মঞ্চে আঙ্গুরবালা গাইতেন ‘ভোরের পাখির সুরে সুরে, আজকে বাজে বীনা বেণু’। গানটির সুর করেন মনিলাল বাবু। প্রথমদিন গানটি গাওয়ার পর দর্শক-শ্রোতাদের অনুরোধে উনাকে আবারও স্টেজে আসতে হয়।  কিছুদিনের মধ্যে আঙুরবালার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আঙ্গুরবলার গান শোনার জন্য থিয়েটারে ব্যাপক ভিড় হতো। অবস্থা এমন হলো যে একই দিন একাধিক নাটকে তাকে গান গাইতে হতো। পত্র-পত্রিকা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নানা বিশেষণ তার নামের আগে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে। আঙ্গুরবালার সমকক্ষ তখন আঙ্গুর বালাই।  

কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসার পর আঙ্গুরবালার সংগীত জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। নজরুলের গান তার জন্য, নতুন জগতের দ্বার খুলে দেয়। একইভাবে নজরুলের ব্যক্তিত্ব ,জ্ঞান-শিক্ষাও আঙ্গুরবালাকে প্রভাবিত করে। এতদিনের গড়ে উঠা আঙ্গুরবালা আবার নতুন সাজে সবাইকে তার গানে আকৃষ্ট করতে থাকেন। নজরুলের গান আঙ্গুরবালাকে খ্যাতির শীর্ষে উন্নীত করে। 
গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুম ছিল উত্তর কলকাতায়। নলিনী সরকার স্ট্রিটের সেই রিহার্সাল রুমে গেলে, নজরুলের দেখা পাওয়া যেত। তিনি তখন গ্রামোফোন কোম্পানির প্রশিক্ষক। নজরুল বাংলা গান শেখাতেন। ওখানেই আঙ্গুরবালাকে নিয়ে যান গ্রামোফোন কোম্পানির অধিকর্তা ভগবতী ভট্টাচার্য। পরিচয় করিয়ে দেন নজরুলের সাথে। 

নিজের লেখা ও সুর করা গান নজরুল নিজেই শেখাতেন। পরিচয়ের পর আঙ্গুরবালা নজরুলের কাছে গান শেখা শুরু করেন। বেশির ভাগ সময় গজল শেখাতেন। আঙ্গুরবালা প্রথম যে দুটো গান শেখেন, সেগুলো হচ্ছে—‘ভুলি কেমনে আজও যে মনে’ ও ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলো কেবা বলো’। এই গান দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করে। 

আঙ্গুরবালা বলেন, ‘অজস্র নজরুলগীতি শিখেছি ও গেয়েছি। কিন্তু কাজী দার কাছে শেখা ওই প্রথম গান দুটোর স্মৃতি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এমন মানুষ দ্বিতীয় আর দেখিনি। আমি ভাগ্যবান যে, তার কাছে গান শেখার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম। অত্যন্ত ভালো মানুষ তিনি। সৌম্যকান্তি, সর্বদাই হাসিখুশি। ধমকে বা কর্কশভাবে কথা বলতেন না। বারবার আমরা ভুল করলেও, তিনি কখনও চটতেন না। শান্ত কণ্ঠে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। যত্ন করে, দরদ দিয়ে, ভালবেসে গান শেখাতেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংগীতশিল্পী হিসাবে আমার যদি কোনও সাফল্য থেকে থাকে তো তার পেছনে অনেকখানি অবদান কাজী দার। তার ঋণ এ-জন্মে শোধ করার নয়।’

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আঙ্গুরবালা ছোট বোন ইন্দুমতিসহ ঢাকা আসেন। সংগীত গুরুর কাছে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। গান গেয়ে শোনান। অতীতের কথা বলেন, এই আশায় যে যদি কবির স্মরণে কিছু আসে। কবি নির্বাক। কোনও প্রতিক্রিয়া নাই। পাউডার দিয়ে কবির বুকে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেন। 

আঙ্গুরবালার কাছে শিক্ষক হিসেবে নজরুলের উপরে কেউ নাই। গান বিচারে নজরুলের গানের উপরে কোনও গান নাই। 

চলবে...

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি


তথ্যসূত্র:

‘বাংলার বুলবুল আঙ্গুরবালা’ প্রশান্ত দাঁ

‘অতীতের পাতা থেকে: কলের গান, রেকর্ডের গান’

পণ্ডিত অনিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ আনন্দবাজার অনলাইন। ২৪ আগস্ট ২০১৯

‘মনে পড়ে’ আঙ্গুরবালা দেবী, বিনোদন সংখ্যা, দেশ ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ

প্রথম পর্ব: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

দ্বিতীয় পর্ব: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

তৃতীয় পর্ব: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

চতুর্থ পর্ব: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পঞ্চম পর্ব: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক

ষষ্ঠ পর্ব: অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

সপ্তম পর্ব: প্রথম রেকর্ড হাতে পেয়ে ইন্দুবালা নিজেই ভেঙে ফেলেন!

অষ্টম পর্ব: টাইটানিক থেকে ঢাকা, রেডিওর গপ্পো

নবম পর্ব: দৃষ্টি হারিয়েও সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে

/এম/
সম্পর্কিত
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৬রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৫ (গ)নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!