ছবিতে টুপি পরে থাকা নায়ক মাহফুজ আহমেদকে ভিলেন বানানোর ছবি ‘প্রহেলিকা’। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে না যাওয়ার পরোক্ষ অনুরোধ বা আকুতিময় ছবি ‘প্রহেলিকা’। চার খুনের কাহিনি বয়ানের ছবি ‘প্রহেলিকা’। উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পীর অন্দরমহলে বন্দিনী এক নারী ও দুই আশ্রিত পুরুষের গল্প ‘প্রহেলিকা’। এক অর্থে প্রেম-অবিশ্বাস-সন্দেহ আর প্রতিশোধের ছবিও ‘প্রহেলিকা’। গল্পই যদি সিনেমার আসল নায়ক হয়, তবে সেই গল্প প্রহেলিকা হয়ে যাবার ছবি ‘প্রহেলিকা’। ডিবি পুলিশের সিরিয়াল ব্যর্থতার ছবিও ‘প্রহেলিকা’।
উলের টুপি পরা মনা খুন করে আশ্রয় নেয় উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী অবস্থাসম্পন্ন জামশেদ সাহেবের বাড়িতে। শুরুতেই জামশেদ সাহেবকে ভয় পায় মনা, পরক্ষণেই আশ্রয়দাতার স্ত্রী অর্পার সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় তার! আবার জামশেদ সাহেব তার স্ত্রীকে বাধ্য করেন কাজের ছেলে আবুলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়তে!
এমন পরিস্থিতিতে ‘প্রহেলিকা’র গল্পের বিস্ময় এখানেই যে মনা আর অর্পার প্রেম ওই বাড়ির সবাই দেখে ও জানে, কিন্তু আশ্রয়দাতা জামশেদের তাতে কিছু যায় আসে না!
কিন্তু অর্পা-মনার প্রেমের মাঝখানে একদিন খুন হয়ে যান জামশেদ সাহেব। তুমুল পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয় মনাকে। সে কিছু স্বীকার করে না। কী হয় তাহলে শেষমেশ? সেটা দেখতে হবে সিনেমা হলে গিয়ে।
‘প্রহেলিকা’ ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই। পুলিশ বাড়িতে এলে প্রথম জানা যায় অর্পা বেড়ে উঠেছিল পতিতালয়ে! সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই পুলিশ অফিসারের! অন্যদিকে অর্পাকে জামশেদ সাহেব বিয়ে করে বাসায় আনেন, শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন, যা সংলাপের মাধ্যমে বোঝা যায়। তাহলে কাজের ছেলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে করতে অর্পাকে বাধ্য করলেন কেন জামশেদ?
আবার মনা প্রথম খুন করে গ্রামের এক মারামারিতে। এটা দেখানো হয় না অর্থাৎ ভিজুয়ালি চেপে রাখা হয়। ধরলাম এটা ছবির গল্প বলার ধরন। কিন্তু একটা বাড়ির ভেতর প্রেম হয়, দুই দুইটা খুন হয়, কেউ দেখতে পায় না! সম্ভবত এসবই প্রহেলিকা!
এই ছবির পরিচালক চয়নিকা চৌধুরী, তার প্রথম ছবি ‘বিশ্বসুন্দরী’। রোমান্টিক নাটক নির্মাণের জন্য খ্যাত চয়নিকা চৌধুরীর এই ছবিও রোমান্টিকতায় ভরা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাই মনা বলতে পারে অর্পাকে, আমি ডুবসাঁতার শিখিয়েছি তোমায়! চয়নিকার নাটকের মতোই তেমন আলো আর ফুলের সমাহার ছিল ছবিতে। সিলেটের হেরিটেজ পার্ক কটেজ, কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিনে শুটিং হলেও গানের দৃশ্য আর প্রথম ও শেষ দৃশ্য ছাড়া বেশিরভাগ দৃশ্যের শুটিং হয়েছে ইনডোরে বা এক বাড়ির ভেতরে।
মনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহফুজ আহমেদ। মাহফুজ অভিনীত শেষ সিনেমা ‘জিরো ডিগ্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৫ সালে। অর্পার চরিত্রে অভিনয় করেছেন শবনম বুবলী। এই ছবিতে মাহফুজ আহমেদ ও শবনম বুবলী ছাড়াও অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান, রাশেদ মামুন অপু, এ কে আজাদ সেতু, রহমতউল্লাহ, সাবিহা জামান প্রমুখ। মাহফুজ ও বুবলী ছাড়াও নাসিরউদ্দিন খান, রাশেদ মামুন অপু এবং এ কে আজাদ সেতু দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।
‘প্রহেলিকা’ ছবির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পান্থ শাহরিয়ার। ছবির ‘মেঘের নৌকা’ শিরোনামের গান লিখেছেন আসিফ ইকবাল, সংগীতায়োজন করেছেন ইমরান মাহমুদুল এবং এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ইমরান ও কোনাল। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘হৃদয় দিয়ে’ শিরোনামের গানটিও লিখেছেন আসিফ ইকবাল এবং সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন কিশোর দাস এবং গেয়েছেন স্বরলিপি ও কিশোর নিজে। এই গান শুনে কেউ কেউ মনে করতে পারেন হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে নেই! হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে দুঃখই পেতে হয়! ‘বিধুর ভালোবাসা’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন জামাল হোসেন এবং সংগীতায়োজন করেছেন আকাশ মাহমুদ। গানটি গেয়েছেন আকাশ মাহমুদ ও সিঁথি সাহা।
ছবির আবহসংগীত কানে লেগেছে, অনেক সময় সংলাপ শুনতে কষ্ট হয়েছে। বাংলা বা যেকোনও ছবির নায়করা সাধারণত সত্যের পক্ষে কথা বলেন। এই ছবিতে চার চারটা খুন কোন যুক্তিতে করানো হলো, তার কোনও বিশ্লেষণ নেই! সবচেয়ে অত্যাচারিত দেখানো হলো জামশেদ চরিত্রে নাসিরউদ্দিন খানকে। মনে হতে পারে সেই সবচেয়ে ভালো লোক। এমন অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে দর্শক মনে।
তবু হলভর্তি দর্শক ছিল। ছবির বাণিজ্য বাড়ুক, জয় হোক বাংলা ছবির।
প্রহেলিকা: রেটিং ৫.৫/১০
ধরন: সেমি রোমান্টিক
নির্মাতা: চয়নিকা চৌধুরী
চিত্রনাট্য: পান্থ শাহরিয়ার
অভিনয়ে: মাহফুজ আহমেদ, শবনম বুবলী, নাসিরউদ্দিন খান, রাশেদ মামুন অপু, এ কে আজাদ সেতু, রহমতউল্লাহ, সাবিহা জামান প্রমুখ
প্রযোজক: জামাল হোসেন
ব্যানার: রঙ্গন মিউজিক
আবহসংগীত: ইমন সাহা
গীতিকবিতা: আসিফ ইকবাল
চিত্রগ্রাহক: সুমন হোসেন
সম্পাদক: রমজান আলী
পরিবেশক: জাজ মাল্টিমিডিয়া
মুক্তি: ২৯ জুন ২০২৩
দেশ: বাংলাদেশ
ভাষা: বাংলা
নির্মাণ ব্যয়: প্রায় ২ কোটি
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়