ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ভয়াবহ হামলার পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নতুন রূপ পেতে পারে। একই সঙ্গে তা নতুন ধাপে যেতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শনিবারের হামলার ভয়াবহতা ইসরায়েলিদের অবাক করেছে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতি উঠে এসেছে।
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আমির মাখুল বলেছেন, এটি নজিরবিহীন কৌশলগত হামলা। এর অবসান আন্দাজ করা মুশকিল। কারণ উত্তেজনার এমন বৃদ্ধি অস্বাভাবিক প্রকৃতির। এমনকি ফিলিস্তিনি হামলার অবসান হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগত প্রভাব থাকবে। এটি সংঘাতের পরিস্থিতির বদলে দিতে পারে।
শনিবার সকালে কয়েকশ’ ফিলিস্তিনি যোদ্ধা গাজা উপত্যকার সীমানা অতিক্রম করে ইসরায়েলে প্রবেশ করে। তারা স্থল, সাগর ও আকাশ পথে প্রবেশ করে ইসরায়েলি শহর, থানা দখল করে বিস্ময় ছড়ায়। একই সঙ্গে তারা কয়েক হাজার রকেট ছুড়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে। হামাসের পক্ষ থেকে সব ফিলিস্তিনি সংগঠন ও তাদের মিত্রকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
রবিবারও সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, বেশ কিছু স্থান ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হামাস বলেছে, তারা সেনাসহ কয়েক ডজন ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছে। তাদের দাবির সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়েছে।
শনিবার ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরুর পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। ইসরায়েলিদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েল একটা দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধে প্রবেশ করেছে।’ ইতোমধ্যে দুই দেশের অন্তত সাত শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ফিলিস্তিনে ৩ শতাধিক, ইসরায়েলে চার শতাধিক। উভয়পক্ষে আহত কয়েক হাজার। নিহত ও আহতের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরও বাড়বে।
ইসরায়েল ও বিভিন্ন দেশে হামলার পর পরিস্থিতিকে ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্রায় ৫০ বছর আগে আকস্মিক ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল মিসর।
বিশ্লেষক আমির মাখুল বলেছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা, সামরিক ও রাজনৈতিক দ্বিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে শত্রু অঞ্চলে ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিচালনার যে নীতি রয়েছে সেটির অবসান ঘটলো।
ইসরায়েল কী করতে পারে?
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক হানি মাসরি বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার দুর্বিষহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলাফল। ইসরায়েল নিয়মিত দখলকৃত পশ্চিম তীর, পবিত্র মসজদি এবং ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের হামলা চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নিপীড়নের নীতি রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে।
মাসরি আরও উল্লেখ করেছেন, ইসরায়েল হয়ত বর্তমান পরিস্থিতিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে কাজে লাগাবে। নেতানিয়াহু সরকারের বিতর্কিত বিচার ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এই সংস্কার ঘিরে পুরো ইসরায়েল বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং বড় ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু এই হামলা নিশ্চিতভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ধারা পাল্টে দেবে, কিন্তু তা কত মাত্রায় তা আগামীতে জানা যাবে।
ইসরায়েলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে তা হলো, গাজায় উপত্যকায় সেনা মোতায়েন করতে পারে নেতানিয়াহুর সরকার। এর ফলে ২০০৫ সাল থেকে বিদ্যমান উপকূলীয় ছিটমহলটির বর্তমান অবস্থা পাল্টে যেতে পারে।
মাসরি বলেন, ইসরায়েল হয়ত ফিলিস্তিনি ও প্রতিরোধকারী গোষ্ঠীগুলোর ওপর শক্তিশালী হামলা চালাবে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের হত্যা করতে পারে।
সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নতুন রণক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় লেবানন সীমান্তে।
তবে মাসরি বলছেন, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলার যে প্রক্রিয়া ইসরায়েলের রয়েছে তা বদলানো কঠিন হতে পারে। কারণ হামাসের কাছে ইসরায়েলি বন্দি রয়েছে। সংঘাতের অবসানে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হয়ত সফল হতে পারে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি পাল্টা পদক্ষেপের ভয়াবহত কমাতে পারে। ফলে ইসরায়েল হয়ত একটি দৃঢ় কিন্তু পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেবে, যাতে করে তাদের ইসরায়েলি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রিত রাখার কৌশল একেবারে বাদ দিতে না হয়।
তৃতীয় দৃশ্যপটে ইসরায়েল হয়ত নিজের ক্ষয়ে যাওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পেতে চাইবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা ফেরত আসা যাবে না এমন কোনও উদ্যোগ নিতে চাইবে না।
মাসরি মনে করেন, বেশ কিছু বিষয় ইসরায়েলকে উত্তেজনা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমাদের আরেকটি বড় সংঘাতের প্রতি অনীহা এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন সৌদি আরব-ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে তখন সহিংসতা এড়াতে চাইবে দেমটি।
তিনি বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে তা বলার সময় এখনো্ আসেনি। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর যা আসবে তা অতীতের তুলনায় ভিন্ন হবে।