X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ শতকের ইতালির গল্প

নারীটি ।। লালা রোমানো

অনুবাদ : মাইনুল ইসলাম মানিক
০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫০আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫০

হোটেলের ডাইনিং রুমে ভদ্রমহিলাটি যে আসনে বসে ছিলেন, সেখান থেকে ঠিক আড়াআড়ি সামনের আসনে বসা ভদ্রলোকটিকে তিনি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন এবং প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পরেই তিনি আন্দাজ করতে পারলেন, ভদ্রলোকটি খুবই চমৎকার। যে বিষয়টি না বললেই নয়, তার হাতজোড়া অনিন্দ্য। যেসব পুরুষের হাত রুক্ষ, খসখসে; ভদ্রমহিলাটি সেসব পুরুষকে নিয়ে দ্বিতীয়বার কখনোই ভাবেননি। বিপরীত পাশের টেবিলে বসা ভদ্রলোকটি তার হাতের প্রতি খুবই যত্নশীল। তার হাতজোড়া ছিল অধীর, আর বাঁকানো নখগুলো ছিল অত্যন্ত সুশ্রী ও তকতকে পরিষ্কার। তার চুলগুলো ছিল সুকোমল, দেখতে অনেকটা ধূসর মন্দিরের মতো, তার ছোট্ট গোলাকার মস্তকের চারপাশে সুবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে আছে চুলগুলো। ভদ্রমহিলাটি যতবার পুরুষটির একটি একটি করে নতুন অনুষঙ্গ বিবেচনায় আনেন, ততই তার হৃদয় হতে উৎসারিত সম্মতি ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে, আনন্দে উদ্বেলিত হয় তার পুরো শরীর। ভদ্রলোকটি ওপরের দিকে একবারও মাথা না তুলেই তার মধ্যাহ্নভোজ শেষ করেছেন, তাই ভদ্র মহিলাটি তার চোখে চোখ রাখতে সমর্থ হননি। ভদ্রলোকটি উঠলেন এবং বেরিয়ে গেলেন। তিনি এমনভাবে বেরিয়ে গেলেন যে, ভদ্রমহিলার দিকে চোখ রাখা তো দূরের কথা, সামান্যতম এদিক-ওদিক পর্যন্ত তাকাননি। ভদ্রমহিলাটি খাবারের যে লোকমাটি তার মুখে পুরেছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য সেটি তার গলায় আটকে যায়। তিনি খুব দ্রুতই ভাবতে থাকেন, তিনি হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছেন। তিনি সুমধুর দিবাস্বপ্ন ত্যাগ করে জানালা দিয়ে বাইরের পাহাড়ের দিকে তাকান। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট খেতের রাইগুলো বাতাসের ঝাপটা থেকে নিচে লুকাতে চেষ্টা করছে।

কেউ একজন ভদ্রমহিলাকে একটি চিরকুট দিয়ে গেছেন। এই চিরকুটটির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন কারণ তিনি যখন সকালের কোচে এখানে এসে পৌঁছান, তখন তিনি নিকোলা রসিকে দেখতে পাননি। উপস্থিত থাকতে না পারার জন্য নিকোলা রসি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তার হোটেলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিকোলা রসি একজন সংগীত সমালোচক। এই লোকটি তার স্বামীর বন্ধুও। পুরো বিকেলজুড়ে নিকোলা রসি তার পেটের পীড়ার কথা বলে গেছেন যে কারণে তিনি তার সাথে দেখা করতে পারেননি। এই পেটের পীড়াই তাকে যত সমস্যায় ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, শহরের ফার্মেসিগুলোও তার এই অসুস্থতার কোনো প্রতিকার করতে সক্ষম হয়নি। পুরো বিকেলজুড়ে নিকোলা রসি আর কোনো কথা বলেননি। সন্ধ্যায় পাশের টেবিলে বসা সেই ভদ্রলোকের প্রতি মহিলাটি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। তিন দিনের মধ্যে ভদ্রমহিলাটি লোকটির সাথে বড়জোর দুই কি তিনবার চোখাচোখি তাকাতে সমর্থ হন যদিও এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হননি। লোকটির এই দৃষ্টিপাত নিয়ে নারীটির মধ্যে জিজ্ঞাসা চলতে থাকে এবং এই জিজ্ঞাসা হেতু তার মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। তিনি তার দৃষ্টির মধ্যে কিছুটা কমনীয়তা, কিছুটা হৃদ্যতা এবং কিছুটা কামাতুর ভঙ্গি প্রোথিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও তার সন্দেহ থেকে যায় যে, এতে আসলেই কোনো কাজ হবে কি না।

একটা অবধারণীয় অস্থিরতা তার চেতনায় বদ্ধমূল হতে শুরু করে। কিন্তু এটি তখনও মিশে রয়েছিল এক গোপন আনন্দের ভেতর, কিছুটা দুর্বোধ্যতার ভেতর। যদিও এই নারীটি এটুকু অনুভব করেন, এই বিশেষ উৎফুল্লতা কিংবা যেটিকে বলা যায় আনন্দমুখর উত্তেজনা। এই উত্তেজনাটুকু যে হারে বাড়ছিল, তাতে সে হারে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ থাকতে পারে, তিনি যাতে চাইলেই সহজে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন, ইচ্ছেমতো এই উত্তেজনাকে প্ররোচিত করতে পারেন। তাতে অবশ্য এই আনন্দটুকু যথেষ্ট বিচিত্রতা পায় না। সেটি বরং কিছুটা অচেতন এবং মেকি হয়ে ওঠে। পূর্ববর্তী সাক্ষাৎসমূহে এই আনন্দের এটুকু অনন্যতা ছিল যে মহিলাটি যখন নতুন এই ব্যক্তিটির সাথে কমবেশি নিরপেক্ষ দৃষ্টি বা শব্দ বিনিময় করেছিলেন তখন তিনি তা সঠিকভাবে অনুভব করেছিলেন। এবার খুবই অদ্ভুত একটা জিনিস ঘটে গেল যে, তিনি ভদ্রলোকের উপস্থিতিতে আনন্দ অনুভব করতে পারেননি। ইতোমধ্যে তিনি যে, অবর্ণনীয় বিব্রতকর অবস্থার শিকার হয়েছিলেন তাকে কেবল লজ্জা বলা যেতে পারে। এটাই ছিল সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস। ভদ্রমহিলা অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি লোকটির সাথে কথা বলতে পারলে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন।

এই মুহূর্তে ভদ্রমহিলার ভেতর প্রবল কৌতূহল জেগে ওঠে, লোকটি কে এবং তার পেশা কী হতে পারে এই ভেবে। তার উত্তেজক হাতগুলো দেখে মনে হয়, একজন পিয়ানোবাদক বা একজন সার্জন হতে পারেন। অবশেষে মহিলাটি একটি ছুতো খুঁজে বের করলেন। তিনি হোটেলের রেজিস্টার দেখতে চাইলেন। অতঃপর তিনি অবগত হলেন যে, এই ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ বছর। পেশার জায়গাটি খালি রাখা হয়েছিল। ভদ্রমহিলা এবার নিজের বিষয়ে বিরক্ত হলেন। তিনি নিজের পেশার পাশে লিখেছিলেন, ‘সেট ডিজাইনার’। তিনি তার স্থপতি স্বামীকে এরকমটা পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই তিনি এখন পেশার জায়গায় সেট ডিজাইনারের পরিবর্তে ‘পেইন্টার’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করেছেন। এটি তুলনামূলক কম বিব্রতকর। তিনি তার সঠিক বয়স কমিয়ে দেওয়ার জন্য মনে মনে অনুশোচনাও করলেন। কিন্তু এখন আর সেটি সংশোধন করার সাহস তার হলো না। তাছাড়া, এই ভদ্রলোকের তুলনায় বয়সে তিনি এখনও অনেকটা তরুণ। মহিলাটি মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন এবং জানালার দিকে ঝুঁকে রাইয়ের ছোট ছোট খেতগুলো দেখছিলেন। রাইয়ের গাছগুলো যেন নেচে নেচে বাতাসের সাথে খেলা করছিল।

ভদ্রলোকটির মধ্যাহ্নভোজ প্রায় শেষ হতে চলল। যে জানালায় ভদ্রমহিলাটি দাঁড়িয়েছিলেন সেটি ঠিক তার পেছনে। মহিলাটি জানালার বাইরে ভূ-ভাগের দৃশ্য দেখছিলেন এবং মাঝে মাঝে আড়চোখে ভদ্রলোকের ঘাড়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ভদ্রলোকের ঘাড় না সোজা না অনমনীয় ছিল, বরং সেটি বালকের ন্যায় কিছুটা ঋজুভঙ্গিতে ছিল। তার অবয়বে নিষ্ঠুরতার লেশমাত্র নেই। ভদ্রলোকটি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সচরাচর যেমনটা করে থাকেন, সেভাবে দরজার দিকে পা না বাড়িয়ে মহিলাটির দিকে এগিয়ে এলেন এবং কোনোরকম ভূমিকা না টেনেই তাকে একটা সিগারেট সাধলেন। মহিলাটি আনন্দিত হলেন এবং একই সঙ্গে বিরক্তও হলেন। ভঙ্গিটি এমন ছিল যেন তিনি কোনো লাজুক তরুণী। ভদ্রলোকটি তার সিগারেটের দিকে আগুনের শলাকাটি এমনভাবে এগিয়ে দিলেন যা তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ছোটখাটো লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।

তাদের এই আলাপচারিতাটি খুব স্বল্পস্থায়ী হলো। বলা যেতে পারে, অল্প কয়েকটি শব্দ মাত্র কথা হয় তাদের মধ্যে। এই যেমন হোটেল, অবস্থান ইত্যকার বিষয়ে। এই আলাপচারিতায় কিছুটা তালগোল পাকিয়ে অবশেষে মহিলাটি একটা নোট নেন যে, আলাপের পরম্পরায় কোনো ছন্দপতন থাকা অনুচিত। মূলত ভদ্রলোকটি আলাপ দীর্ঘায়িত করার জন্য তাকে একটা সূত্রও দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেননি বলে তার অনুশোচনা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে পরদিন সকালের আলাপচারিতার সম্ভাব্য উক্তিগুলো কম করে হলেও বিশবারের মতো আওড়ালেন। তাতে তার কাছে কোনো সমস্যাই অনুভব হয়নি। বরং তিনি আনন্দময় একটা আলাপ চালিয়ে যাওয়ার মতো অসংখ্য অনুষঙ্গ খুঁজে পেলেন। ভদ্রলোকটি তাকে জানালেন, হোটেলের ম্যানেজারটি ঠিক সে বছরই বিয়ে করেছেন। তিনি শুধুমাত্র এ কারণেই বিয়ে করেছেন যে, তার মা মারা গেছেন এবং হোটেলে তার সাহচর্যে একজন নারী প্রয়োজন। নইলে তিনি কুমার থেকে যেতেন কারণ তিনি এবং হোটেল ম্যানেজার দুজনই বিয়ে বিষয়ে একই ধারণা পোষণ করেন। ভদ্রমহিলা চাইলে এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন এবং এর মধ্যদিয়ে নারীর বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারতেন। অপরদিকে মহিলাটি একটি বিষয় নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে, তার বিয়ে বিষয়ক এসব ধারণায় তিনি হতাশ নন, বরং তার হতাশার পেছনে অন্য একটি কারণ রয়েছে। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর খুবই চমৎকার, কিন্তু তার উচ্চারণ খুবই ম্যাড়ম্যাড়ে। বিশেষত তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। সর্বোপরি মহিলাটি বুঝতে পারেন, খুব দেরি হয়ে গেছে। আগের মুহূর্তগুলোতে তিনি প্ররোচিত হয়েছেন এটুকু বুঝে উঠতেই মূলত এই দেরিটুকু হয়ে গেছে। সবসময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার একটা তাড়াহুড়ো ছিল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাস্থানে পৌঁছার আগেই এমনটা করে ফেলতেন তিনি। পেছনে ফেলে আসা প্রিয় দৃশ্যগুলোকে তিনি হাতড়াতে শুরু করলেন। দুঃসাহসী থেকে শুরু করে ধ্বংসাত্মক—কোনো দৃশ্যই বাদ যায়নি। যেমন ধরুন, ছোট্ট হোটেলে আগুন লাগল। হুলস্থূল লোকজন ধাক্কাধাক্কি করে নিজেকে রক্ষা করতে চাইল। এই দৃশ্যটির সাথে তার মনে পড়ে গেল শৈশবের কোনো পরিচিত দৃশ্য যা তাকে প্রশান্তি দিয়েছিল। সে হয়তো স্কুলের ওপরের শ্রেণির কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছিল, যে কিনা তার প্রতি মোটেও দৃষ্টিপাত করেনি। তারপর সেসব কাল্পনিক ধ্বংসাত্মক দৃশ্যের কাছে ফিরে আসে সে যেখানে উদ্ধারের ছুতো থাকবে, নায়কোচিত কর্মকাণ্ড থাকবে, আত্মত্যাগের কৃতিত্ব থাকবে। অথচ এখন কিনা তারা অন্যের পাজামা কিংবা বিকিনি রক্ষার চেষ্টায় মাঝেমধ্যে ব্রত হয়।

নিদ্রায় ঢলে পড়ার মধ্যদিয়ে মহিলাটির সুখস্মৃতি রোমন্থনের ইতি ঘটে। তার স্বপ্নের ক্ষেত্রে সবসময়ই এই একটি বিষয় ঘটে থাকে যে, এটি সবসময়ই অস্বাভাবিক পূর্ণতা পায়।

একাকী হাঁটার সময় তিনি নিকোলা রসিকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। রসি পেটের পীড়া নিয়ে এখনও তার হোটেলেই আটকে আছেন। ভদ্রমহিলা তার পলায়নপর টুকরো টুকরো স্বপ্নের ওপর দৃষ্টিপাত করেন। তার সাথে ভদ্রলোকের কয়েকটি জটিলতা তৈরির মধ্যদিয়ে এই স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু এই টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলো তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে শুধুমাত্র তার সাথে আরও চক্রান্তই করল কারণ তিনি স্বপ্নগুলোর একপেশে স্বভাব সম্পর্কে জানতেন, কারণ এই স্বপ্নগুলো তাকে বোঝাতে যথেষ্ট সক্ষম ছিল না। স্বপ্নগুলো একটা প্রবঞ্চনার মধ্যদিয়ে, ভদ্রলোকের আচরণের পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এই জটিলতার সূচনা করেছে। এই পুরুষটি বাস্তবিক অর্থেই তার আচরণে প্রবঞ্চক ছিল, এমনকি তার স্বপ্নের ক্ষেত্রেও সে তেমনটাই করেছে। এই স্বপ্নগুলোর আরও অনেকগুলো কৌতুকপূর্ণ দিক ছিল। যদিও সাময়িকভাবে মনে হয়, মহিলাটি আরও বড় প্রবঞ্চনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন, তথাপিও এর ভেতর একধরনের অবচেতন প্রতিশোধের অস্তিত্ব ছিল।

ভদ্রমহিলাটি যখন ছোট মেয়ে ছিলেন, তখন তিনি একটি ভাস্কর্য জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলেন। তাকে একটি নগ্ন পুরুষমূর্তির কাছে নেওয়া হয়েছিল। মূর্তিটির লিঙ্গের ওপর নিয়মমাফিক ডুমুরের পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ছিল না। তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিস্ময় ও অস্বস্তির কারণ এই নয় যে তিনি সাধারণত যা লুকানো থাকে তা দেখেছিলেন। বরং গোপনাঙ্গটি ভাস্কর্যের আকারের তুলনায় খুব ছোট ও চিকন ছিল। তখন এ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অস্পষ্ট। প্রকৃতিগতভাবেও তার এটুকু বোঝার কথা ছিল না। ব্যাপারটা তাকে অচেতনভাবেই হতাশ করে। পরবর্তীকালে তিনি পুরো ঘটনাটি ভুলে যাওয়ার মধ্যদিয়ে তার হতাশার পরিসমাপ্তি ঘটে।

রাতের স্বপ্নে মূর্তিটি একটি বাগানে তার সামনে হাজির হয়। বাগানটি ছিল ঘন ও অন্ধকার। মূর্তিটি ছিল অস্বাভাবিক লম্বা এবং এর মাথাটি ছায়ার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা মূর্তিটিকে চিনতে পারলেন। তিনি আবারও সেই আগের মতোই অস্বস্তি বোধ করলেন। যদিও এটিকে খুব শক্তিসম্পন্ন ও পীড়াদায়ক মনে হয়েছিল। যে অঙ্গটি তাকে হতাশ করেছিল দ্রুতই সেটির দিকে তার নজর চলে যায়। কিন্তু সে তখন যা দেখেছিল তার কোনো চিহ্নই ছিল না। সেখানে শুধু চিরাচরিত ডুমুরের পাতা দিয়ে ঢাকা ছিল। ভদ্রমহিলা জানতেন যে এই ভাস্কর্যটি হোটেলে দেখা লোকটি। অন্য একটি স্বপ্নে লোকটি আরও স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন। পুরো শহরে আগুন লেগে গেছে। আতঙ্কিত জনতা পাহাড়ের দিকে পালাতে চেষ্টা করছে। ভদ্রমহিলা সুস্থির হয়ে আছেন কারণ তিনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ভদ্রলোকটি এই স্বপ্নদৃশ্যের ভেতর প্রবেশ করেন। তিনি লম্বা পা ফেলে ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছিলেন। তিনি এমনভাবে ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছিলেন যেন কেউ ধীরগতিতে তার ছবি তুলছে। ভদ্রমহিলা দ্রুতই ভদ্রলোকের পা দেখে তাকে চিনতে পেরেছিলেন। পদযুগলের অদ্ভুত নড়াচড়া তাকে অবাক করেনি কারণ তিনি টেবিল থেকে উঠে ভদ্রলোককে পর্যবেক্ষণ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি লক্ষ করেন, একজন তরুণের মতো তার লম্বা চটপটে পা আছে। কিন্তু তার হাঁটুতে প্রায় ধীর ও স্থির হয়ে আছে সেগুলো। বিব্রতকর বিষয় হলো ভদ্রলোক একটি লম্বা আলখাল্লা পরেছিলেন। তাকে এ ধরনের আলখাল্লা পরতে ভদ্রমহিলা কখনো দেখেননি। সম্ভবত তার শৈশবের কিছু নীরব হাস্যরসের ঘটনা ছাড়া এমনটা তিনি কখনোই দেখতে পাননি। আচমকা ভদ্রমহিলা বুঝতে পারেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য তিনি একটা সুযোগ নিতে চাইলেন। তিনি ভদ্রলোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন এবং হাত বাড়িয়ে দিলেন। মূলত তার দীর্ঘ আলখাল্লাটিকে ওপরের দিকে টেনে তোলার উদ্দেশ্যেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেই মাত্র ভদ্রলোকের আলখাল্লাটিকে ওপরের দিকে তুলতে যাচ্ছিলেন, তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। এটি যে স্বপ্ন ছিল তিনি অন্তত সেটুকু স্মরণ করতে পারেন। তারপর আরেকবার আলাপচারিতা হয়। ভদ্রলোক জানান তিনি তার এক বন্ধুর আগমনের অপেক্ষায় আছেন। বন্ধুটি এলে তারা ওপরের হিমবাহের দিকে যাবেন। এই আলাপচারিতাটি খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু এটি অপরাপর আলাপের মতো শেষ হয়ে যায় না। কারণ ভদ্রলোক কোথাও যাননি। বরং অন্য কিছু ঘটে। প্রাত্যহিক জানালার কাছে তারা দুজন মুখোমুখি বসে থাকে। তখনও সিগারেটটি পর্যন্ত শেষ হয়নি, আচমকা ভদ্রলোকটি জানালার বিপরীত দিকে মাথা অবনত করেন। ভদ্রমহিলা কোনোরূপ ক্ষতির শিকার হননি, কিন্তু তিনি তার হৃদয়ের ভেতরের সংক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধতাটুকু অনুভব করেন। তিনি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকান। ঘুমের মধ্যেও চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। মনে হচ্ছিল সে কাঁদছে। তারপর ভদ্রমহিলাটি পাহাড়ের দিকে তাকান। সেখানে রাইয়ের খেতগুলো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দুলছে। দেখে মনে হচ্ছিল ছোট হ্রদের মধ্যে ঝড় বইছে। ভদ্রলোকটি সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সহসাই তিনি জেগে ওঠেন এবং বলেন, কেউ চমৎকার ঘুমাতে চাইলে তাকে খোলা আকাশের নিচে কোমল ঘাসের গালিচায় গিয়ে ঘুমোতে হবে। ভদ্রমহিলা পোশাক পরিবর্তন করে একটি আলখাল্লা পরতে যান। তিনি তার শর্টস পরেন। সাথে একটি বই নিয়ে আসতেও ভুল করেন না। কারণ তিনি অনুমান করেছিলেন, যদিও তিনি খুবই তড়িঘড়ি করছেন তাতে কোনো কাজই হবে না। হোটেলের পেছনে একটি পথ বেয়ে মহিলাটি ওপরের দিকে উঠলেন। তিনি বেয়ে উঠতে থাকলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি একটি বিচবনের ছায়াঘেরা তৃণভূমিতে পৌঁছলেন। আলখাল্লাটি খুলে তিনি ঘাসের ওপরে রাখলেন। যেই মাত্র তিনি ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিলেন, তখনই ভদ্রলোক সেখানে পৌঁছান। তারপর ঝোঁপের ভেতর দিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যান। সম্ভবত আরও ওপরের দিকে তিনি আরেকটি তৃণভূমি সন্ধান করছিলেন। ভদ্রমহিলাটি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন কারণ সূর্য পর্যাপ্ত উত্তাপ দিচ্ছিল। চমৎকার একটা সময় কেটে গেল। বিচবনের ছায়া এসে পড়ল নারীটির শরীরের ওপর এবং তিনি কাঁপতে শুরু করলেন। হিমবাহের ওপর সূর্যকে খুব বিষণ্ন মনে হচ্ছিল। তিনি পাথরের নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। লোকটি ওপরের পথ ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছিলেন। ভদ্রমহিলা তার উলঙ্গ ধড়ের দিকে তাকালেন। তার পাতলা ধড় দেখতে লাবণ্যময় লাগছিল। কোনো কিছু না ভেবেই তিনি লোকটিকে ‘হ্যালো’ বললেন। ভদ্রলোকটি থামলেন। ভদ্রমহিলার মনে হলো লোকটি তার পায়ের দিকে তাকাচ্ছেন কারণ তীব্র সংবেদে তার শরীরের তামাটে রং রক্তিম হয়ে উঠছিল। তিনি কোনো আনন্দ না পেলেও এক সুতীব্র লজ্জা অনুভব করলেন।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তার আলখাল্লাটি তুলে নিলেন। সন্ধ্যায় ভদ্রলোকের সামনে আসনটি দখল হয়ে গেল। বাদামি প্যান্ট পরিহিত এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক মহিলার দিকে তার পিঠ পেতে বসেছেন। তার এবং ভদ্রলোকের মাঝখানে এই লোকটি একধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন যার ফলে তিনি ভদ্রলোকটির দিকে তাকাতে পারছেন না এবং ভদ্রলোকটির বিভ্রান্ত দৃষ্টিও পড়ছে না তার দিকে। মধ্যখানের ভদ্রলোকটির দীর্ঘ বাহু ভেদ করে পার্শ্ববর্তী পর্বতটিও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। বরফ পেরিয়ে একফালি রোদ এসে পড়ছে পাহাড়টির ওপর। দুপুরের খাবারের পর নতুন লোকটি নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি ছিলেন বন্ধুত্বপূর্ণ এবং তার বড় বড় হাতজোড়া ছিল অমলিন ও সুন্দরতম। সঙ্গে ছিল তার আঠারো বছরের ছেলে। ভদ্রমহিলা তার রুমে গেলেন এবং তার পোশাকের মধ্য থেকে বেছে নিলেন একটি নৈশকালীন সাদা গাউন যা তিনি প্রথম দিন আলাদা করে রেখেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এ ধরনের হোটেলে এরকমের গাউন পরাটা অনুপযুক্ত হবে। এটি এমন এক পোশাক যা তার কাঁধকে উন্মুক্ত করেছে, একটি ছোট লাল মখমলের ব্লাউজের সাথে তিনি এটি পরেছেন। ভদ্রমহিলা এটি পরেছেন এবং তার চুলের স্টাইল পরিবর্তন করেছেন। ছোট চিরুনি দিয়ে চুলগুলো তার মাথার ওপরে এনে জড়ো করেছেন। তিনি যত্ন সহকারে মেকাপ লাগালেন এবং তারপর রুমে ফিরে গেলেন।

কেউ তার দিকে মনোযোগ দেয়নি। ছোট দলটি রেডিওর চারপাশে জড়ো হয়। এক দৈত্যাকার লোকের চারপাশ ঘিরে ছিল তারা। লোকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রযুক্তিবিদ যিনি এই ডিভাইসটির সাথে সম্পৃক্ত কাজের দায়িত্বে ছিলেন। ভদ্রলোকের বন্ধুর ছেলেটি মহিলাটির দিকে অবিরাম তাকাতে শুরু করে এবং মহিলার পক্ষ থেকে ইশারা পেয়ে সে জানতে চায় গানটি তার পছন্দ হয়েছে কি না। এরপর সে ভদ্রমহিলাকে নাচের আমন্ত্রণ জানায়।

দীর্ঘদেহী ভদ্রলোকটি তাদের ওপর খানিকটা দৃষ্টিপাত করেন এবং তারপর বন্ধুর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপে মশগুল হয়ে পড়েন। নাচের মধ্যে ভদ্রমহিলা অতিথি লোকটির কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তার আঞ্চলিক ভাষার শব্দগুলো ভদ্রমহিলার কানে বাজতে থাকে। তাদের আলাপচারিতার একটি বিষয় তিনি বুঝতে পারেন এবং কান পেতে সে অবশিষ্ট আলাপটুকু শুনতে থাকেন। ভদ্রমহিলার স্বামী ছিলেন একজন বামপন্থি বুদ্ধিজীবী। নিকোলা রসি এবং ভদ্রমহিলার অন্যান্য বন্ধুগণও একই ঘরানার লোক ছিলেন। ভদ্রলোক ও তার বন্ধুর মধ্যে যে আলাপ হচ্ছিল তা ছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল। বিশেষত ভদ্রলোকের দিক থেকে চরম প্রতিক্রিয়া আসে। অপরদিকে, ভদ্রলোকের বন্ধুটিকে মনে হচ্ছিল, তিনি বিষয়টির সাথে একমত হতে পারছিলেন না। সর্বোপরি, তাকে খুব একটা ক্ষিপ্তবৎ মনে হয়নি। প্রধান প্রযুক্তিবিদও এই আলাপচারিতায় যোগ দেন। মহিলাটিকে চমকে দিয়ে তিনি উচ্চৈঃস্বরে তার মতামত ঘোষণা করেন। এটি অনেকটা অর্বাচীনের মতো ছিল। যেহেতু মহিলাটি তাদের আলাপচারিতা শুনছিলেন, তর্কের বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়। তিনি কোনোরকম একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করেন এবং এই ভেবে কিছুটা পুলকিত হন যে, তার এই অধঃপতনটুকুর সাক্ষী হতে পারে, তার এমন কোনো বন্ধু সেখানে উপস্থিত নেই। বিরতির সময় ভদ্রলোকটি মহিলার চপ্পলজোড়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং তারপর খুব বিচক্ষণতার সাথে সেগুলোর প্রশংসা করেন। মহিলাটি চরম আনন্দ অনুভব করেন এবং একই সাথে চরম বিব্রতও হন। এরপর তিনি ভদ্রলোকের জুতাজোড়ার দিকে মনোযোগ দেন। ভদ্রলোকের জুতাজোড়া বিস্ময়কর সুন্দর। তার জুতাজোড়া সাদা সোয়েড চামড়া দ্বারা তৈরি, তার ওপর রয়েছে বাদামি রঙের প্যাঁচানো চামড়া। মহিলাটি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেন এবং প্রশংসা করেন। আর এই প্রথম মহিলাটি দেখতে পেলেন লোকটি অকারণেই হাসছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলাটির কথার জবাবে লোকটির বন্ধু বলেন, তার বন্ধুর এরকম সুন্দর জুতাজোড়া না থাকলে আর কারই বা থাকতে পারে? তিনি আরও জানান এগুলো তার নিজের তৈরি। তারপর বন্ধুটি এ বিষয়টি আরও সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন যে, ভদ্রলোকটি চামড়া নিয়ে কাজ করেন। তারপর তিনি ভদ্রমহিলাকে জুতা ক্রয়ের বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন। যদিও তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার, তিনি ভদ্রলোকের প্রতি তেমন একটা বিদ্বেষ পোষণ করেননি, কিংবা অবজ্ঞাও করেননি। মূলত তিনি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, তার বাকযুদ্ধ করার বা বিদ্বেষমূলক অনুভূতির সুযোগ ছিল না। তিনি জানতেন, কিছুই ঘটবে না। তবুও তিনি এই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করলেন যদিও পরিস্থিতির সবটুকু মনোভঙ্গ হওয়ার মতো ছিল না, বরং কিছুটা এ ধরনের ঝুঁকিরও ছিল যে তিনি যেন হেঁটে হেঁটে রসাতলে যাচ্ছেন। কিন্তু এটুকু উপলব্ধি করার মতো প্রজ্ঞা তার ছিল যে, তার জীবনে এই প্রথমবার ভয়ংকর কিছু একটা তার ভেতরে শেকড় গেড়েছে। একটি নিতান্তই দুর্বল কিছু নয় এবং অনিবার্যভাবেই এটি তার নিয়তিকে পরাজয়ের দিকে নিয়ে গেছে। তার এই উদ্ঘাটন এতটাই বড় কিছু ছিল যে, এটি তার প্রতিটি কল্পনা প্রতিটি সুনিশ্চিত ধারণাকে চিরতরে বিভ্রান্ত করে, ছোট করে।

মহিলাটি একটি অস্পষ্ট আত্মসম্মানবোধ উপলব্ধি করলেন অথবা এমনটিও হতে পারে, তিনি তার নিজের ভেতরে জন্ম নেওয়া উপলব্ধিটুকুর প্রতি এই সম্মান বোধ করেছেন।

তিনি জানতেন, এটি হঠকারিতার বিষয় নয়, তবে এটি এমন কিছু যা আভিজাত্য ও অহংকারকে অতিক্রম করেছে। তার সমস্ত মনোবৃত্তি এভাবে নিস্পৃহ ছিল নিষ্ফল প্রত্যাশার অবস্থায়। ভদ্রলোকের বন্ধুর উপস্থিতি ভদ্রমহিলার কোনো কাজে আসেনি। বন্ধুর ছেলেটি তার হাঁটাহাঁটি থেকে ফিরে আসার সময় মহিলাটির জন্য ফুল এনেছিল। ছেলেটি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকায় এবং তার বন্ধুদের অপরিপক্বতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। মহিলাটির কাছে ছেলেটিকে বিরক্তিকর মনে হয়, কিন্তু সেই মুহূর্তগুলোতে তাকে অন্তত নিকোলা রসি এবং অপরাপর লোকদের চেয়ে উত্তম মনে হয়। ইতোমধ্যে নিকোলা রসি পাকস্থলির সমস্যায় ভুগছিলেন এবং শহরে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। মহিলাটি রসির মাধ্যমে তার স্বামীকে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি এখানে অবস্থানের ক্ষেত্রে বিরক্তিবোধ করছেন।

ভদ্রলোক ও তার বন্ধু হিমবাহের দিকে তাদের সফরের বন্দোবস্ত করলেন। হোটেলের ম্যানেজার নিজেই একজন গাইড হিসেবে তাদের সাথে যাচ্ছেন। বন্ধুর ছেলেটি ভদ্রমহিলাকে যাওয়ার জন্য পীড়া দিতে থাকে। তাদের এই দুঃসাহসী অভিযানের প্রতি মহিলাটির কোনোরূপ চিত্তাকর্ষণ হয়নি। কিন্তু তিনি তার মনস্থির করতে পারলেন না। সে রাতের আগেই তিনি হোটেল লবিতে আইস এক্স, রশি ও ক্র্যাম্পন দেখতে পান। প্রত্যুষের আগেই তাদেরকে যাত্রা করতে হবে।

ভোর চারটায় ভদ্রমহিলার মনে হলো তিনি একটা গাড়ির আওয়াজ শুনেছেন। পরবর্তী এক ঘণ্টায়ও যেহেতু তিনি আর ঘুমোতে পারলেন না, তাই তিনি শয্যা ত্যাগ করলেন। তার মনে হলো, তাকে একা একাই পাহাড়ে উঠতে হবে।

কিন্তু তিনি রশি ও ক্র্যাম্পন হাতে সবাইকে হোটেলের লবিতে দেখতে পেলেন। কেউই তাকে হ্যালো বলল না। যে গাড়িটি তাদেরকে ক্যাবল কারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেটি তখনও আসেনি এবং এখন তারা দুধের ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছেন। হোটেল ম্যানেজার রাস্তাটি অনুসন্ধান শেষে আধাঘণ্টা পর খবর পাঠালেন। দুধের ট্রাকটি ছিল বড়সড়। ট্রাকের পাশে রেলিং ছিল না। যথারীতি লোকজন দুধের পেটির ওপর গাদাগাদি করে বসে পড়েছেন। গাইড যখন তাকে ডাকল, তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলে সাড়া দিলেন। আর এভাবেই মহিলাটি নিজেকে ট্রাকে তুললেন। ট্রাকের ওপর ভারসাম্য রাখা খুবই কঠিন ছিল। রাস্তা পাহাড়ের দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। যেহেতু ট্রাক বাঁকা রাস্তা ধরে নিজেকে ঘুরিয়ে ওপরের দিকে উঠছিল, সবার শরীর বেঁকে উলটে পড়ার দশা হয়েছিল প্রায়। গ্রামের লোকজন তাদের ঝুড়ি নিয়ে গাড়ির দিকে আসছিল। কিন্তু ভদ্রলোকটি এবং তাদের গাইড উভয়ই খুব বিপজ্জনক লোক। তারা গ্রাম্য মহিলাদের কাঁধে থাবা মারছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছিল, এই মহিলারা পাথরের তৈরি। ভদ্রমহিলাটি দুটো পেটির মাঝখানে একটা ঝুড়ির ওপর বসেছেন। এই ঝুড়িটা অনেকটা টেকসই। মহিলাটি যথারীতি নিজের কথা এবং নিজের বেদনার কথা ভুলতে চলেছেন। প্রতিটি মোড় ঘোরার সময়ই তার তেষ্টা পেল। একটার পর একটা দীর্ঘ পাহাড় সামনে আসছিল আর ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছিল সুগভীর পাইন বনের ছায়ায়। তিনি একটা বিষয়ে খুবই সতর্ক যে, ভদ্রলোকটি তার খুব কাছাকাছি এবং খুব অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন কারণ তিনি কারও হাত ধরে রাখার জন্য একটা হাত খুঁজছিলেন। ভদ্রমহিলা দ্রুতই তার হাত ধরতে যাচ্ছিলেন প্রায়, হাত তখনও বাতাসে ভাসছে, ভদ্রলোকটি কিছুটা বিব্রত হলেন এবং তাকে ধন্যবাদ জানালেন। ভদ্রমহিলা যেইমাত্র তার হাত ধরলেন, তিনি এক অন্তহীন আনন্দ অনুভব করলেন। তার হাত সুকোমল, উষ্ণ ও শুকনো। ভদ্রলোকের হাতটি তার হাতকে শক্ত করে ধরেছিল, তবে তা শুধুমাত্র নিজেকে স্থির রাখার জন্য, এটুকুই।

মহিলাটি জানতেন, ভদ্রলোকের এরচেয়ে বেশি আর কিছুই করার নেই। কিন্তু সচরাচর যে ধরনের অস্বস্তি বোধ করার কথা, তেমনটা বোধ তো করলেনই না বরং তিনি একটা সৌম্য শীতল অধিকারবোধ অনুভব করলেন। এই যে হাত ধরে রাখা, শেকড়ের সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই, এই যে ঘূর্ণিবায়ুর চক্কর, ভয়ংকর মোড় আর আনত হয়ে থাকা দানবাকৃতির পাহাড়ের দৃশ্যপট, এসবের সাথে স্বপ্নে তাদের যে সাক্ষাৎ হয়েছিল যা আপাত একদমই স্ববিরোধী, তা সেই স্বপ্নের ঘনিষ্ঠতার খুব কাছাকাছি। কিন্তু এই স্বপ্নগুলোতে যদিও একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল, সর্বোপরি, এই স্বপ্নগুলোতে একটা নিঃসঙ্গতার অনুভূতি থেকে যায় এবং যে উষ্ণতা এই স্বপ্নগুলোর ভেতর থাকে, তা বাস্তবিক, স্বস্তিদায়ক এবং একদমই চেনাজানা। ট্রাক থেকে যখন নামার সময় হলো, তিনি অনুভব করলেন, ভদ্রলোক খুবই দ্রুততার সাথে তার হাতটি সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি অবশ্য ভদ্রলোককে তার সবকিছু থেকেই যথারীতি সরিয়ে দিয়েছেন।

একটা গাড়িতে চড়ে তারা হোটেলে ফিরে এলেন। হোটেলে এসে তিনি তার স্বামীর একটা টেলিগ্রাম পান। তার হাতে তখন শুধুমাত্র ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়ার মতো সময় ছিল এবং তিনি বিকেলের কোচে ফিরে গেছেন।

(ইতালিয়ান ভাষায় রচিত ‘La signora’ নামের এই গল্পটি ১৯৪৮ সালে La villeggiante গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।  ঝুম্পা লাহিড়ীর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন মাইনুল ইসলাম মানিক)


লালা রোমানো (১৯০৬-২০০১)

লেখক পরিচিরোমানোর গদ্যের প্রথম বইটি রোমান কবি ওভিডের ম্যাগনাম ওপাসের শিরোনাম থেকে নেওয়া যেটি রূপান্তরের কাজটিকে নান্দনিকভাবে প্রতিভাত করে। তিনি একজন চিত্রকর হিসেবে জীবনের সৃজনশীল অধ্যায় শুরু করেন। কিন্তু এর অল্প কিছুকাল পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমার আঘাতে তার তুরিনের বাড়ি ও স্টুডিও গুঁড়িয়ে যায়। তার ক্যানভাস বিষণ্ন, বিবর্ণ ও ধূসর হয়ে পড়ে। দৃশ্যকল্পকে চরমভাবে তুলে আনা এ লেখিকা জীবনের শেষভাগে প্রায় সবটুকু দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি লেখার জন্য প্রচুর পরিমাণে কাগজ ব্যবহার করেছেন এবং কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, তিনি একটা কাগজে একটামাত্র শব্দ লিখেছেন। তার এই সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞ তার ‘লাস্ট ডায়েরি’তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

রোমানোর গদ্যসমূহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগ গদ্যই শুরু হয়েছে অবারিত বর্ণনা ও ব্যঙ্গাত্মক খোঁচার মধ্যদিয়ে। তার মধ্যে একটা বৈপরীত্য ছিল যে, তিনি ব্যক্তিক জীবন ও প্রকাশ্য জীবনের মধ্যে একটা সীমারেখা বজায় রাখতেন। তাকে লালা নামে কেউই ডাকতেন না। পরিবার ও বন্ধুদের দেওয়া গ্রাজেইলা নামে ডাকা হতো তাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার জীবনের আলো-আঁধারের অধ্যায়ের স্বীকারোক্তিমূলক একটি আত্মজীবনী লিখে গেছেন Nei mari estremi (In Extreme Seas) নামে। একজন সঙ্গীর জাগতিক বিদায় কতটা বেদনাবহ, তা নিয়েই এই আত্মজীবনীটি রচিত হয়েছে। তবে তার Le parole tra noi leggere (The Light Words between Us) উপন্যাসে সন্তানের সাথে সম্পর্কের যে দূরত্ব তা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেছেন। এই বইটির জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে Strega পুরস্কার পান।

যদিও যুদ্ধের পর তিনি মিলানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, এই গল্পটি কুনেউ পর্বতের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। তার জন্ম সেখানেই হয়েছিল। এই গল্পটি থেকে একজন চিত্রশিল্পীর সূক্ষ্মতম দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। অধিকন্তু, রোমানো একজন চিত্রশিল্পী ও লেখক তো বটেই, তিনি একজন গ্রন্থাগারিক ও অনুবাদক ছিলেন। তিনি ফ্লবেয়ারের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গদ্য রচনায় ব্রত হন।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সৈকতে জনসমুদ্র!
চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল
জঞ্জালের নগরে প্রাণ ভরানো সবুজের খোঁজে...
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে