X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ শতকের ইতালির গল্প

বিষণ্নতা ।। গফরেদো প্যারিসি

অনুবাদ : ফজল হাসান
০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:১০আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:১০

প্রতিদিন সেই ঠাণ্ডা এবং ফেলে আসা গ্রীষ্মকালে বেদিন-আলিঘিয়েরি কলোনি নামের দরিদ্রদের জন্য একটি শিবির পরিচালনা করতেন সেইন্ট ডরোথির সন্ন্যাসিনীরা। সেখানে বাচ্চাদের তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার পরপরই তৃণভূমিতে অথবা পাহাড়ের চূড়ায় পাইন বনে নিয়ে যাওয়া হতো। দুজন কম বয়সী সন্ন্যাসিনী, গরম দিনের জন্য যাদের পরনে নিয়মমাফিক কালো পোশাক ও টুপির পরিবর্তে থাকত সাদা জামাকাপড়, বাচ্চাদের দেখভাল করতেন। সন্ন্যাসিনী দুজনেরও বয়স ছিল খুবই কম এবং বাচ্চাদের প্রায় সমবয়সী। বাচ্চাদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে ছিল এবং মেয়েদের মধ্যে একজন ছিল ‘অতিথি’, যার নাম ছিল সিলভিয়া। তাকে ‘অতিথি’ বলার কারণ ছিল। কেননা তিনি ছিলেন কলোনি প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজনের নাতনি এবং সেই প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন সমাজতান্ত্রিক কর্মী। তাকে কোনোভাবেই দরিদ্র বলা যাবে না।

এ কারণে সিলভিয়া—অন্য সবার চেয়ে আলাদা, যারা সস্তা কাপড় দিয়ে তৈরি ধূসর ও গলা বন্ধনী ছাড়া ঢিলেঢালা শেমিজ পরিধান করত—প্রতিদিন তার ছোট্ট ট্রাঙ্ক থেকে নিজের পছন্দমতো সাধারণ জামাকাপড়, সবসময় ব্যবহার করার জন্য জুতা (লাল রাবারের স্যান্ডেল নয়, যা ছিল নির্ধারিত পোশাকের অংশ) এবং এমনকি তার নিজের পুতুল কিংবা খেলনা, যা সে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল, বেছে নিতে পারত। সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে বিশাল শয়নকক্ষে ঘুমাত এবং দিনের বাকি সময় অন্য সবার মতো একইভাবে কাটাত : একই ধরনের অল্প পরিমাণে সকালের নাশতা, একই মধ্যাহ্নভোজ, একই রকম বিকেলের হালকা খাবার এবং একই ধরনের রাতের খাবার। এমনকি অন্য সবার মতোই তার ছিল সাদা রঙের কলাই করা বিছানা এবং মাঝখানে মোটা সেলাই করা মোটা চাদর।

সেই প্রথম সিলভিয়া শিবিরে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থেকেছে। তবে তার আগে স্বাভাবিক কারণেই সে একা ছিল না। সারা বছর সে তার দাদু এবং আয়ার সঙ্গে থেকেছে। তার দাদু তাকে সাইকেলের ওপর বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। শুধু তার বসার জন্য সাইকেলে বিশেষ আসন ছিল। দাদুর পরনে ছিল বরাবরের মতোই কালো পোশাক : কালো অ্যালপাকা জন্তুর চামড়ার তৈরি আস্তিনবিহীন কোট, ঢিলেঢালা বো টাই, বড় কালো টুপি এবং লম্বা বুট জুতা। জুতার রং ছিল কালো, ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি এবং পাশে বোতাম ছিল। তিনি সিলভিয়াকে সন্ন্যাসিনীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল নাতনিকে সাদরে গ্রহণ করার সময় সন্ন্যাসিনীরা খুশি হয়েছে এবং তার সঙ্গে বিশেষ অতিথির মতো ব্যবহার করেছে।

শিবিরে থাকাকালীন সময়ে সিলভিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো বিভিন্ন ধরনের গন্ধ : সে খুব সহজেই সেসব গন্ধ শনাক্ত করতে পারত, যেমন তৃণভূমিতে হরেক রকমের ভেষজ ও উদ্ভিদের ঘ্রাণ, যেগুলোর নাম সে আলাদা করে জানত না : বুনো পুদিনা, সেইজ, রৌজমেরি অথবা সাধারণ আগাছা, ড্যান্ডেলিয়ন বা ফার্ন বা তেতো বন্য আপেল বা অন্যান্য আগাছা। সেগুলো ছিল দুর্গন্ধযুক্ত এবং ইচ্ছে করেই ছেলেরা তার নাকে চেপে ধরত। অন্যদিকে পাহাড়ের চূড়ায় দেবদারু এবং লার্চ বৃক্ষের খাঁজ, যেখানে তারা বিকেলে যেত, সেখানে সে অন্য এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন গন্ধ পেত : পাইন মোচা, পাইন বাদাম, পাইন সূচ এবং কিছু ঘণ্টা আকৃতির জাম, যা সিলভিয়া ‘মৃত’ নামে অভিহিত করেছে। বাচ্চাদের কাছে সেসব জিনিস ছিল অনেক আনন্দদায়ক।

এমনকি কীটপতঙ্গেরও স্বতন্ত্র গন্ধ ছিল : সিলভিয়া দক্ষতার সঙ্গে ঘাসফড়িং ধরেছিল এবং তার গায়ে ভেষজ উদ্ভিদ ভারবীন্যার গন্ধ পেয়েছিল। এছাড়া সে কিছু পোকামাকড় বা গুবরে-পোকার মধ্যে সেলুলয়েডের গন্ধ পেয়েছিল। এই বিশেষ গন্ধটি একবার ছোট খাঁচায় আটকা পড়েছিল, যা সন্ন্যাসিনীদের মধ্যে একজন শিখিয়েছিলেন কীভাবে ঘাস থেকে তৈরি করতে হয়। তবে সিলভিয়ার প্রিয় গন্ধ ছিল তার বিছানা এবং বিছানার চাদর, যার গন্ধ সম্পূর্ণ বিশাল শয়নকক্ষের হাওয়ায় ভেসে বেড়াত : গন্ধটা ছিল বজ্রপাতের মতো এবং মাঝেমধ্যে সেই গন্ধের সঙ্গে মিশে যেত শিশুর ঘাম আর প্রস্রাবের মৃদু কটু গন্ধ, যা তার খুব ভালো লাগত।

সন্ধ্যায় যখন দোয়েল পাখিরা দিগন্তের ফ্যাকাশে বেগুনি ও হলুদ রঙের খোলা আকাশে ওড়াউড়ি করত, তখন গির্জার দরজা গলিয়ে বেরিয়ে আসা ধূপের ক্ষীণ ঘ্রাণ এবং সেই সঙ্গে গির্জার পাশের লম্বা ঘাসের জমিন থেকে উঠে আসা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ সিলভিয়ার মধ্যে এমন এক আবেগময় অনুভূতি জাগিয়ে তুলত, যা সে কখনো অনুভব করেনি এবং কী নাম দেবে, তা সে জানত না। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারত যে, সেই গন্ধে জেগে ওঠা তার আবেগ গোধূলি বেলায় হিম হয়ে যেত এবং গলা বন্ধ করে তার কাঁদতে ইচ্ছে করত। সিলভিয়া যখন-তখন দাদুর কথা স্মরণ করত, কিন্তু ক্ষণিকের জন্য। তবে তার মনে হতো না যে, সে দাদুর অনুপস্থিতি অনুভব করত। শেষ বিকেলে রাতের খাবার খাওয়ার ঠিক পরপরই যখন ছোট গির্জায় প্রার্থনা শেষ হতো, তখনও সে ঘাসের গালিচায় বসে থাকত এবং দাদুর কথা ভাবত। সেসময় সে তাকিয়ে দেখত এবং তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল যে, সে তখন দোয়েল পাখির কান্নার কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পেত। যখন বাচ্চাদের মধ্যে একজন সবচেয়ে বড় ঘণ্টা বাজিয়েছিল, তখন পাখিরা তাদের মাথার ওপর এবং শিবিরের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেছে।

সিলভিয়া একজন সন্ন্যাসিনীকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তিনি অন্যদের মতো পোশাক পরতে পারেন কি না : ধূসর ক্যাম্বিস কাপড়ের শেমিজ এবং রাবারের লাল স্যান্ডেল। কিন্তু সিলভিয়াকে অবাক করে সন্ন্যাসিনী বলেছিলেন, না।

‘কেউ কী তোমার জামাকাপড় অথবা খেলনা নিয়ে তোমাকে কিছু বলেছে?’ সিলভিয়াকে প্রধান সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞেস করেন। ‘ওরা কী তোমাকে খ্যাপায়, নাকি বকাঝকা করে?’ সিলভিয়া বলেছে, না। কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু কীভাবে বিষয়টি প্রধান সন্ন্যাসিনীকে বুঝিয়ে বলবে, তা সে জানে না (তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর)। সিলভিয়া অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে। এক অর্থে সে তার পুতুল, খেলনা ও তার জামাকাপড় নিয়ে লজ্জা বোধ করে : আসলে সে তার খেলনা অন্যদের নিতে দিয়েছিল, কেননা সে খেলনাগুলো দেওয়ার জন্য কোনো অনুতাপ অনুভব করেনি। সিলভিয়া একাকিত্ব বোধ করে : তবে তার অর্থ এই নয় যে, অন্যারা তার সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করে কিংবা তাকে তাদের খেলা থেকে বাদ দিয়েছে। না, উলটোদিকে বরং তাকে সবসময় গূরুত্বপূর্ণ কাজে আমন্ত্রণ জানাত অথবা তাকে উৎসাহিত করত কিংবা তাদের খেলায় বা ছোট কুঁড়েঘর তৈরি করার সময় বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করত। সিলভিয়া তার পরিবারের কারণে বিচ্ছিন্ন বোধ করেনি—সম্ভবত তার জন্মের পর দাদু ছাড়া পরিবারে অন্য কেউ ছিল না। অন্য বাচ্চারা তার কাহিনি শুনে ভীষণ অবাক হয় এবং তারা তাকে আলাদা মনে করার পরিবর্তে, যেমনটি সে ভেবেছিল, কৌতূহল প্রকাশ করে এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নের উত্তর সিলভিয়ার জানা নেই।

না, হয়তো সিলভিয়া তার বাবা এবং মায়ের সঙ্গে কখনোই দেখা করেনি। তার মনে পড়ে, কিছু ক্ষুদ্র ঘটনার কথা ও  বিশেষ উপহারের জন্য ধন্যবাদ, একজন যুবতী মহিলা নিশ্চয়ই তার মা : ছোট্ট সোনার মালার সঙ্গে প্রবালের তৈরি কানের দুল ও সোনালি চুলের একজন কমবয়সী নারীকে সে দুই কিংবা তিনবার দেখেছে। তার কোনো ভাই বা বোন নেই। যা হোক, প্রশ্ন করার সময় সে উৎসাহ নিয়ে দীর্ঘ সময় তার দাদু সম্পর্কে কথা বলেছে, যা অন্যসব ছেলেমেয়ে দেখেছে। সেদিন তিনি সমস্ত শিবির ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেছেন।

‘তোমার দাদু কি প্রচুর অর্থকড়ির মালিক?’ বাচ্চাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে। তিনি কলোনির মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ, যিনি কিনা কয়েক বছর ধরে আসছেন। তার ত্বক খসখসে, যা মাছ ও ডিমের মতো গন্ধযুক্ত।

‘আমি জানি না,’ জবাবে সিলভিয়া বলল।

‘কিন্তু তিনি কী করেন?’

‘তিনি একটা বাইসাইকেল দোকানের মালিক।’

‘তার অর্থ তিনি বড়লোক,’ ছেলেমেয়েরা একই সঙ্গে বলল। ‘সে কারণেই তোমার জামাকাপড় আমাদের জামাকাপড়ের চেয়ে সুন্দর।’

সিলভিয়া বিত্তশালী দাদু পছন্দ করেনি অথবা অন্য বাচ্চাদের চেয়ে ভালো জামাকাপড় চায়নি। এমন না যে অন্য বাচ্চারা গরিব এবং তার চেয়ে আরও বেশি দরিদ্র, কিংবা তার দাদুর তথাকথিত ধনসম্পদ বা তার ভিন্ন ধরনের জামাকাপড় থাকার কারণে তাকে কৌতূহলের ও প্রশ্নের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু আসল কারণ হলো সে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে। আর গন্ধের প্রতি তার ভীষণ সংবেদনশীলতার কারণে সে মূলত একাকিত্ব অনুভব করে। এছাড়া তার নাকের কাছে আগাছা, তেজপাতা ও প্রজাপতি আটকে থাকা গন্ধ অন্য শিশুদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সে প্রতিবারই চোখ বন্ধ করে সঠিক গন্ধ উপলব্ধি করতে পারে এবং একবারও তার ভুল হয় না। এছাড়া সে আরও একটি কারণে একাকিত্ব অনুভব করে এবং তা হলো, যা গন্ধের প্রতি তার সংবেদনশীলতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, সেই গোধূলি বেলার অনুভূতি, কেবল এখন সে সেই গন্ধ, এমনকি দিনের বেলায়, এমনকি রাতেও অনুভব করে। সে শুধু নিজেকে বলতে পারে, ‘আমি কান্নার মতো অনুভূতি উপলব্ধি করি।’

আগস্ট মাস এসেছে এবং ‘আমি কান্নার মতো অনুভূতি উপলব্ধি করি’ অনুভূতিটা সিলভিয়ার মধ্যে আরও জোরালো হয়। কিছু কিছু কারণে তা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে আবির্ভূত হয়, তবে আগের চেয়ে অন্য রকম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো বদলে যায় : হয়তো সূর্য ঠিকমতো উত্তপ্ত করতে পারছে না এবং এছাড়া তার কাছে মনে হয় যে, ঘাসফড়িং এবং ঝিঁঝি পোকার ডাক আগের মতো তত বেশি নেই। গন্ধের গুণমান এবং শব্দের বিবর্তন দেখা যায় সন্ধ্যায়। একই সময়ে গির্জার সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের পর আরও স্পষ্ট এবং উপলব্ধি করা যায়, এমনকি তখন আকাশের রংও আর আগের মতো থাকে না। কয়েক দিনের জন্য সিলভিয়াকে অন্যদের মতো জামাকাপড় ও স্যান্ডেল পরার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু—যা সে কখনোই আশা করেনি—তার ভেতর বিচ্ছেদের অনুভূতি বেড়ে যায়। অন্যদের মতো জামাকাপড় পরিধান করার পরে সে আরও বেশি অন্যরকম অনুভূতি উপলব্ধি করে এবং তখন তার মধ্যে ‘কান্নার’ অনুভূতি বেড়ে যায়। সে তার নিজের জামাকাপড় পরা শুরু করে। একদিন বজ্রপাতের জন্য শিবিরের মধ্যে শীত নেমে আসে এবং একসময় সূর্য ফিরে আসে, তবে শুধু মাঝেমধ্যে দ্রুত চলমান ধূসর, গোলাপি ও ছাই রঙের মেঘের মধ্যদিয়ে উঁকি দেয়। সেই আবহাওয়া পরিবর্তনের দিনগুলোতে সিলভিয়ার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল এবং মাঝেমধ্যে সে টয়লেটে কাঁদতে যেত।

দলের সব ছেলেমেয়ের ছবি তোলা হয়েছে : সিলভিয়া তার জামাকাপড় পরেছিল। ঝাঁকড়া লাল চুলের আড়ালে তার চোখ লুকিয়ে ছিল। সে ছিল অন্য সবার মাঝে এবং সবাই একই রকম পোশাক পরেছিল। সন্ন্যাসিনীরা ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ছবিগুলো প্রতি বছর স্যুভেনিরের জন্য তোলা হয় এবং সিলভিয়া আগের বছরগুলোর ছবি দেখতে চায়। প্রধান সন্ন্যাসিনী তাকে তার অফিসে নিয়ে যান, যেখানে সদ্য তোলা ছবিগুলোসহ অন্যান্য বছরের ছবি দেয়ালে ঝুলছিল : সে একই ব্যাকগ্রাউন্ডে একই সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে শিবিরের নির্দিষ্ট পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের দেখে। সেই বছরও একই ছেলেমেয়েদের কয়েকজন উপস্থিত রয়েছে।

‘আর অন্যরা?’ সিলভিয়া প্রধান সন্ন্যাসিনীকে জিজ্ঞেস করে।

‘অন্যরা বড় হয়ে গেছে,’ প্রধান সন্ন্যাসিনী বললেন। ‘ওরা শিবিরে আর আসে না।’

এমনকি এই জবাবের পরও এবং সেসব ছবি, যা একটা আরেকটার মতো, তারা কয়েকদিন আগে বড় চত্বরের একই কোনায় পতাকাদণ্ডের নিচে তুলেছিল, সিলভিয়াকে সেই ‘কান্নার’ মেজাজে ডুবিয়ে দেয়। তার সেই কান্না দিনের পর দিন আরও খারাপ হয়, এমন খারাপ যে তাকে টয়লেটে গিয়ে কাঁদতে হতো। তবে তা ছিল মাত্র এক মুহূর্ত; তারপর সেই মুহূর্ত চলে যায়।

আগস্ট মাস শেষ হয়ে আসে এবং তার দাদু তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন। বাচ্চারা তাকে দেখতে এবং তার ট্রাউজার স্পর্শ করতে চেয়েছিল, যখন দাদু ওদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করছিলেন। সিলভিয়ার স্যুটকেস গোছানো হয়েছে এবং বিদায় জানানোর জন্য বাচ্চারা সবাই অন্যান্য সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে প্রধান সন্ন্যাসিনীর কক্ষে প্রবেশ করে। স্বাভাবিকভাবেই দাদু সন্ন্যাসিনীদের জিজ্ঞেস করেন গরমের সময় সিলভিয়া কীভাবে কাটিয়েছে এবং সে কেমন আচরণ করেছে।

‘আমি বলব যে, সে খুব পছন্দ করেছে। আমি কি ঠিক বলেছি?’ সিলভিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রধান সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞেস করেন।

‘ওহ্ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন,’ জবাবে সিলভিয়া বলল।

‘বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তুমি কি মন খারাপ করেছ?’ দাদু সিলভিয়াকে জিজ্ঞেস করেন।

সিলভিয়া না বলল। সে সন্ন্যাসিনী এবং তার দাদুর কথা শুনছিল। প্রধান সন্ন্যাসিনী সিলভিয়ার চরিত্র সম্পর্কে বলছিলেন এবং এমন একটি কথা বলেছেন, যা সিলভিয়া বুঝতে পারেনি : তিনি বলেছেন যে সিলভিয়া খুব ভালো মেয়ে, অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এবং অন্যান্য আরও অনেক শব্দ উচ্চারণ করেছেন। সেসব শব্দের মধ্যে একটা ছিল বিষণ্নতা, বিষাদময়।

সিলভিয়া কিছুই বলল না। কিন্তু খানিকক্ষণ পরে, যখন তার দাদু পাইন বাগানের পাশে শ্যাওলা পড়া উঁচু দুই দেয়ালের মাঝে বিশাল গেটের দিকে বাইসাইকেল ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সিলভিয়া বিষণ্নতা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে।

সিলভিয়ার দাদু শ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন (তার গায়ে বাতাস লাগছিল) এবং জবাব দেওয়ার আগে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে এদিক-ওদিক তাকান।

‘বিষণ্নতা? এখন দেখা যাক...’ তারপর তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য থামলেন।

‘সময় বয়ে যাওয়ার জন্য বিষণ্নতা দেখা দেয়,’ দাদু বললেন। ‘কেন? তোমার কি মন খারাপ করেছে?’

সিলভিয়া লাফ দিয়ে সাইকেলের ওপর নিজের সিটে বসে। তারপর তারা নিচের দিকে নামতে থাকেন।

‘মাঝেমধ্যে,’ সিলভিয়া বলল।

(‘বিষণ্নতা’ গল্পটি গফরেদো প্যারিসির ইংরেজিতে ‘মেল্যানক্যাল’ গল্পের অনুবাদ। ইতালিয়ান ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ঝুম্পা লাহিড়ী এবং তারই সম্পাদিত ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব ইতালিয়ান শর্ট স্টোরিজ’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত।)


গফরেদো প্যারিসি (১৯২৯-৮৬)

গফরেদো প্যারিসি ছিলেন একজন ইতালিয়ান লেখক, সাংবাদিক, চিত্রনাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং কবি। তিনি ১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ভিসেনজায় জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি ভিসেনজা প্রদেশের প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা সমাপ্ত করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু কোনো ডিগ্রি অর্জন করেননি। পরে (১৯৮৬ সালে) পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে।

লেখকজীবনের শুরুতে গফরেদো বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের জন্য লিখেছেন। তখন তিনি গল্প ও উপন্যাস লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তার প্রথম প্রধান উপন্যাস ছিল দ্য ডেড বয় অ্যান্ড দ্য কমেটস্ (১৯৫৩)। উপন্যাসটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করার পরেও মাত্র কয়েক কপি বিক্রি হয়েছিল। তার প্রথম বেস্ট সেলার গ্রন্থ ছিল দ্য হ্যান্ডসাম প্রিস্ট, যা ১৯৫৫ সালে ডন গ্যাস্টোন অ্যান্ড দ্য লেডিস শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। এছাড়া দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রচিত তার দুই খণ্ডের সিল্লাবারিও গ্রন্থে চুয়ান্নটি তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত গল্প এবং একটি মাত্র আবেগ নিয়ে লেখা হয়েছে। গল্পগুলো বর্ণমালার অক্ষর অনুসারে সাজানো হয়েছে। দ্বিতীয় সিল্লাবারিও ইংরেজিতে সলিচিউডস শিরোনামে প্রকাশিত হয়। লেখকজীবনের প্রথমদিকে তিনি ইতালির মধ্যবিত্ত গ্রামীণ মানুষের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মানব বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন রূপের বিশ্লেষণের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ইল পাদ্রোনে (দ্য বস) উপন্যাসের জন্য ‘ভিয়ারেজিও প্রাইজ’ এবং ১৯৮২ সালে সিল্লাবারিও (দ্বিতীয় খণ্ড) গল্প সংকলনের জন্য ‘স্ট্রেগা প্রাইজ’ লাভ করেন। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট তিনি ত্রেভিসো শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সৈকতে জনসমুদ্র!
চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল
জঞ্জালের নগরে প্রাণ ভরানো সবুজের খোঁজে...
সর্বশেষ খবর
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার