X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

‘হয় আমি মরবো, না হয় ওদের মারবো’

নুরুজ্জামান লাবু
৩০ জুন ২০১৭, ২৩:০২আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৭:১৮

এসআই ফারুক হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার খবর পেয়ে প্রথম ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন। ঘটনার দিন (২০১৬ সালের ১ জুলাই) তার নাইট ডিউটি ছিল। চারজনের ‘কিলো ৮১’ কল সাইন হিসেবে পেট্রোলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এই দল জরুরি প্রয়োজনে মুভ করে। রাত ৮টার দিকে এসআই ফারুক অবস্থান করছিলেন গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনের পেছনে। হলি আর্টিজানে হামলার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি সবার প্রথম ছুটে যান সেখানে। জঙ্গিদের সঙ্গে মুখোমুখি বন্দুকযুদ্ধ করেন। নিজের পায়েও গুলি লাগে এসআই ফারুকের। তবে লক্ষ্য ছিল, ‘হয় আমি মরবো, না হয় ওদের মারবো।’
সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা এই প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা করেছেন তিনি। এসআই ফারুক বলেন, ‘তখন আনুমানিক রাত পৌনে ৯টা। গুলশানের এসি রফিক স্যার ওয়্যারলেস সেটে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে বলে জানান। একটু পরেই গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম আমাকে ফোন করেন। বলেন, কিলো ৮১ কোথায় আছো? আমি বলি, স্যার, আমি গুলশান দুই নম্বরে ওয়েস্টিনের পেছনে আছি। ওসি বলেন, তুমি এখনই মুভ করো, লেকভিউ ক্লিনিকে যাও। দেখো সেখানে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে।’
জঙ্গি হামলায় আহত এক পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নিচ্ছেন সহকর্মীরা গাড়ি রেডি ছিল, ড্রাইভারকে দ্রুত ৭৯ নম্বর সড়কের লেকভিউ ক্লিনিকে যেতে বলেন তিনি। লেকভিউ ক্লিনিকে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বলেই প্রথমে পুলিশের কাছে খবর এসেছিল। ফারুক বলেন, ‘আমি যখন ২ নম্বর (গুলশান-২) ক্রস করি তখন আবার ওয়্যারলেসে কল আসে। ওসি সাহেব বললেন, ওখানে হেলমেট-লেগগার্ড ছাড়া কেউ যাবা না। ফোর্সকে বললাম, তোমরা হেলমেট-লেগগার্ড পরে নাও। আমি নিজেও গাড়িতে বসেই হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরলাম। হলি আর্টিজানের গেটের কাছে পৌঁছানোর পর রাস্তায় আড়াআড়িভাবে রক্তাক্ত একজনকে পড়ে থাকতে দেখেন।
আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। আমিসহ ফোর্স গিয়ে তাকে টেকআপ করলাম। ওই ব্যক্তি আমাকে বললেন, স্যার আমি (আব্দুর রাজ্জাক রানা) জাপানি নাগরিকের ড্রাইভার। ভেতরে কে বা কারা দেশি-বিদেশি নাগরিক জিম্মি করছে। লোকজনকে গুলি করে মারতেছে। আমি দৌঁড়ায়া এই পর্যন্ত আসছি। আর যেতে পারছি না। আমাকে বাঁচান স্যার। আমি ওকে ধরে পাশে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।’
রানাকে যখন উদ্ধার করছিলেন পুলিশ কনস্টেবলরা তখন এসআই ফারুক অস্ত্র হাতে পজিশন নিচ্ছিলেন। দুজন কনস্টেবল ও দুজন আনসার সদস্য এবং একজন ড্রাইভারসহ এসআই ফারুক হলি আর্টিজানের সামনে পৌঁছান। তখন রাত কটা বাজে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিলেন না তিনি।
হামলার পর হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ এসআই ফারুক বলেন, ‘আমরা যখন রানাকে উদ্ধার করছি তখন দেখি ৪-৫টা ছেলে দৌঁড়ে আসছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে আর্মস। ব্যাগ ছিল দুজনের হাতে। একটু অন্ধকার, কী ধরনের অস্ত্র সেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পারিনি। লম্বা একটা ছেলে ব্যাগ থেকে একটা গ্রেনেড বের করে পিন খুলতেছে। আমি দ্রুত ফোর্সকে সরে যাও বলে নিজে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে ক্রলিং করে দ্রুত উত্তর দিকের বিল্ডিংয়ের পাশে চলে গেলাম। যেতে যেতেই গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হলো। আমার ফোর্সের চারজনের মধ্যে দুজন ইনজুরড হল।’
জঙ্গিরা গ্রেনেড নিক্ষেপের পর আহত দুজন কনস্টেবল একটি ভবনের গ্যারেজে এবং এসআই ফারুকসহ অপর দুজন ১০ তলা আরেকটি ভবনের গ্যারেজে আশ্রয় নেন। চালক গাড়িটি দ্রুত পেছনের দিকে নিয়ে যায়। এসআই ফারুক তার সঙ্গীদের ফায়ার করার নির্দেশ দেন। আহত এক কনস্টেবলের শটগান নিয়ে নিজেও গুলি করেন।
ফারুক বলেন, ‘বিল্ডিংয়ের আড়াল থেকে শটগান দিয়ে ফায়ার করা শুরু করলাম। ওপাশ থেকে দুজন ফায়ার করতেছে। এপাশ থেকে আমি ফায়ার করতেছি। জঙ্গিরা তখন গেটের প্রায় বাইরে চলে আসছে। একপাশে তিনজন আরেক পাশে দুজন। আমি ফায়ার করতে থাকলে ওরা আবার গেটের ভেতরে ঢুকে দেয়ালের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে তারা গুলি করতেছে। আমিও চাইছিলাম যে কোনোভাবে তাদের আটকিয়ে রাখতে। যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে।’
ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা থেমে থেমে গুলি করছিলেন যাতে জঙ্গিরা বুঝতে পারে বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার শটগানের গুলি শেষ হয়ে যায়। গাড়িতে যে ফোর্স ছিল তারাও নামতে পারতেছে না। ওর কাছে চায়না রাইফেল আছে। আমি ওকে বললাম হাতিয়ারটা দাও। ড্রাইভার হাতিয়ারটা ছুঁড়ে মারলো। আমি চায়না রাইফেল দিয়ে গুলি করতে শুরু করলাম। ওই সময় মনে হচ্ছিল ওরা আমাকে এসে ধরবে। মনে হচ্ছিল মারা পড়বো কিছুক্ষণের মধ্যে। তখন দাঁড়িয়ে পড়লাম মনে হলো, হয় আমি মরবো না হয় ওদের মারবো। যেই দাঁড়িয়ে গুলি করা শুরু করছি তখন ওরা আবার দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেল এবং হলি আর্টিজানের মেইন গেটটা আটকে দিলো। আমি তখন পাশের বিল্ডিংয়ের গ্যারেজের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে পজিশন নিলাম, যেন গেটটা আর খুলতে না পারে। ওইখান থেকে বের হলে আমি গুলি করতে পারবো।’
জঙ্গিদের পালানো ঠেকাতে গিয়ে প্রথম দফা গ্রেনেড হামলায় আহত হন ফারুক। তার পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব দেননি। জঙ্গিরা হলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে গেলে তিনি চালককে আহত দুই কনস্টেবলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইনজুরড, কিন্তু সেটা খেয়াল করি নাই। আমার এক কলিগ জয়নাল বললেন, ফারুক ভাই আপনার তো পায়ে রক্ত। পরে দেখি আমার পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে একটা স্প্লিন্টার আটকে আছে। আমি বললাম, সমস্যা নাই। ওসি (সিরাজুল ইসলাম) স্যার বললেন যে, তুমি থাকো। তোমার সাহস আছে।’
রাত সাড়ে ১০টার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। হলি আর্টিজানের মূল ফটকের বাম দিকের ভবনের নিচে অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে সোয়াট টিমের সদস্য ও র্যামব যোগ দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডেকে কমিশনার বলেন, ‘আমাদের তো রিকভারের জন্য কিছু করতে হবে, যাতে বিদেশিদের না মারতে পারে। লাইফ সেভ করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। তখন হলি আর্টিজানের ভেতরে কিছুটা নীরব। গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
এসি রবিউল ও ওসি সালাউদ্দিন হলি আর্টিজানের পৃথক তিনটি দরজায় একযোগে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, কমিশনার নিজে একটি দল এবং ডিসি গুলশান আরেকটি দল নিয়ে এগিয়ে যাবেন। মূল ফটকের ভেতরে ঢুকেই ভাগ হয়ে যাবেন তারা, জঙ্গিরা যেনও কোনোভাবে পালিয়ে যেতে না পারে।
এসআই ফারুক বলেন, ‘আমরা যখন মূল দরজায় ঢুকে হলি আর্টিজানের রাস্তার গেটটা খুলতে গেছি তখন একটা বিকট শব্দ হয়। একটা গ্রেনেড এসে বিস্ফোরিত হয়। ওরা হলি আর্টিজানের হলরুমের গেটের কাছ থেকে গ্রেনেডটা ছুঁড়েছে। আমাদের মাঝখানে এসে গ্রেনেড পড়লো। আমরা ৩০-৩৫ জন ইনজুরড হলাম। আমার পেছনে সালাউদ্দিন স্যার পড়েছিলেন। এসআই সুজন কুমার কুণ্ডু, এসআই নুরুজ্জামান, সোয়াট সদস্যসহ আমরা ৪-৫ জন সেখানে পড়েছিলাম। আমার হাঁটুর বাটিটা ভেঙে চার খণ্ড হয়েছিল। শরীরে ২০-২৫টা স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। আমি পা তুলতে পারছিলাম না। র্যাশবের একজন মেজর, উনি আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন। উনি আর এসআই জয়নাল আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসেন। পরে গাড়িতে তুলে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি গাড়িতে সেন্স হারিয়ে ফেলি। ইউনাইটেডে নেওয়ার আগে আমার অনেক রক্ত ঝরেছে। আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে হয়তো আমিও মারা যেতাম।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন ফারুক। ২০১৫ সালে এসআই হিসেবে পদোন্নতি পান। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের সদর থানার পারচন্দ্র দীঘলিয়ায়। তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান শেখ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

আরও পড়ুন-

হলি আর্টিজান এখন

দুঃস্বপ্নের রাত, মমতার ইতিকথা

অবিন্তা নেই, বেঁচে আছে তার স্বপ্ন

তুমি কোথায়, ‍গুলশানে জঙ্গি হামলা!

দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তারা

এসি রবিউলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন এডিসি আব্দুল আহাদ

গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে অনুষ্ঠান নিয়ে দূতাবাসগুলোয় সতর্কতা

হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা রাজশাহীতে, কৌশল নির্ধারণ গাইবান্ধায়, চূড়ান্ত অপারেশন প্ল্যান ঢাকায়

/এনএল/এসটি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তৃণমূলের আরও ৬১ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
তৃণমূলের আরও ৬১ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
জমি নিয়ে বিরোধ, বৈদ্যুতিক শকে চাচাতো ভাইকে ‘হত্যা’
জমি নিয়ে বিরোধ, বৈদ্যুতিক শকে চাচাতো ভাইকে ‘হত্যা’
আগামী সপ্তাহে ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং
আগামী সপ্তাহে ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং
গরমে বদলে যাচ্ছে জীবনযাপন, মার্কেটে ভিড় বাড়ছে সন্ধ্যায়
গরমে বদলে যাচ্ছে জীবনযাপন, মার্কেটে ভিড় বাড়ছে সন্ধ্যায়
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ