X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যেভাবে পাশে থাকতে পারে

উমর ফারুক
১৮ মে ২০২০, ১৬:৪৩আপডেট : ১১ জুন ২০২০, ১৮:২৪

উমর ফারুক নিউ ইয়র্ক থেকে হঠাৎ পপির ফোনকলটা বেজে উঠলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১১টা। ওর কণ্ঠে চাপা আতঙ্ক। পপি ওখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাসের ফাঁকে কথা হলো সেখানকার করোনা সংকট নিয়ে। পপি বাংলাদেশি। এখন আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। ওখানেই বাড়ি, ওখানেই গাড়ি। ওখানেই ভোট ও ভাত। কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই বললো, তোমরা দূর থেকে নিউ ইয়র্ককে যতটা ভয়াবহ মনে করছো অবস্থা আসলে তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। আমার বাচ্চাদের আমি বারান্দায়ও যেতে দেই না। জানালা খুলি না প্রায় এক মাস। ঘরে যা আছে তাই দিয়েই কোনও রকমে চলছি। বেঁচে থাকাটাই এখন আমাদের একমাত্র লড়াই। তোমরা যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো, লকডাউন অমান্য করছো, তাতে এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছো। কথায় কথায় জানা গেলো, ওখানেও খাবারের বেশ সংকট। ওখানকার মেয়র বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। অসহায় অভিবাসীদের জন্য রান্নাকরা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

ফোনটা রাখতেই হারুনের ফোনটা বেজে উঠলো। হারুন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ও যখন ভর্তি হয় তখন জাতীয় একটি দৈনিকে খবর ছাপে, অর্থের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না হারুন। তখন অনেকই এগিয়ে আসে ওর পাশে। তৎক্ষণিক সে সংকট কেটে যায়। কেমন আছো হারুন? জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘ভালো না স্যার। বড় অসহায় অবস্থায় আছি। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার কেউ আমাদের কিছু দেয়নি। আজ আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ১০ কেজি চাল ও ২০০টাকা দিয়ে গেছে।’ খবর শুনে মনটা বিষণ্ন হলো।

করোনার সংকট বৈশ্বিক, তাই কষ্টটাও বৈশ্বিক। নিউ ইয়র্ক থেকে লালমনিরহাট সবখানেই প্রায় একই আর্তনাদ। সুস্থ মানুষের ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই, আর অসুস্থ মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। মোটা দাগে পৃথিবীর সব প্রান্তের সংকট এখন এক, আর্তনাদের ভাষাও এক। চিকিৎসা সংকট ও খাদ্য সংকট প্রায় সবখানেই কমবেশি আছে। সংকটের ব্যাপ্তি যতই হোক, আমাদের বিশ্বাস, পৃথিবী এই ভয়াবহ সংকট খুব শিগগির কাটিয়ে উঠবে। তবে সম্ভবত সুস্থ পৃথিবীর আগামীর সংকট হবে অত্যন্ত ভয়াবহ!

হারুনদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা হলো। সবাই সম্পূর্ণ একমত পোষণ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ তার শিক্ষার্থীদের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় আর্থিক তহবিল গঠন করবে। বৃহত্তর অর্থে চারটি উৎস থেকে গঠিত হবে এই তহবিল। বিভাগ, বিভাগের শিক্ষক, বিভাগের চাকরিজীবী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান সচ্ছল শিক্ষার্থী। সংগৃহীত তহবিল বণ্টিত হবে বিভাগের বর্তমান ও প্রাক্তন অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের মাঝে।

শুরু হলো কাজ। প্রথমে, চাকরিজীবী প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হলো। শিক্ষকরা সাধ্যমতো মোটা অংকের টাকা নিয়ে তহবিলের সূচনা করলেন। বিভাগের একটি অব্যবহৃত তহবিলও এতে যুক্ত হলো। মুঠোফোন ও ফেসবুকে যোগাযোগ করা হলে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে তারা টাকা পাঠাতে শুরু করলো। কিন্তু সংকট দেখা দিলো কোনও এজেন্ট নম্বর না থাকায়। ফলে, কাজের সুবিধার জন্য অনেক ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করা হলো। এরই মধ্যে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের জমানো ছোট ছোট অর্থ দিয়ে তহবিল সমৃদ্ধ করতে থাকলো। মাত্র দু-তিন দিনেই তহবিলটা ফুলেফেঁপে বড় হয়ে উঠলো। ইতোমধ্যে মুঠোফোনে অভাবী শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের খবরও বাড়তে লাগলো।

এবার শুরু হলো টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানো খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতারকচক্র অত্যন্ত কার্যকর। ফলে সম্ভাব্য সকল প্রকার যাচাই-বাছাই করে চেষ্টা করা হলো যথাযথ প্রাপকের কাছে অর্থ হস্তান্তর করার। অর্থগ্রহীতার ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করা হলো। এবং পাশাপাশি চেষ্টা করা হলো, শ্রেণি প্রতিনিধির সাহায্য নিয়ে, উপযুক্ত গ্রহীতা খুঁজে বের করতে ও যাচাই-বাছাই করতে। তারই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে বিভাগের অসহায় অসংখ্য শিক্ষার্থীর হাতে করোনাকালীন উপহার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন যুগপৎ চলছে তহবিল সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম। তহবিলের পর্যাপ্ততা সাপেক্ষে, দ্বিতীয় দফায় তাদের পাশে দাঁড়ানো হবে। সম্ভব হলে আবারও।

ইতোমধ্যে করোনার অভাব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে। পূর্বাভাস বলছে, করোনার প্রভাবে, দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক ছুটির কারণে অনেক শিক্ষার্থী মেসের সিট ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ পায়নি। ফলে তিন মাস পর তারা যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবে তখন তাদের একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে পুরো তিন মাসের ভাড়া। এই সংকটে সেটি কীভাবে সম্ভব? বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে প্রায় সাত হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। কিন্তু আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র হাজার খানেক। ফলে করোনাকাল শেষে ফিরে এসে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে মেস মালিকদের চাপের মুখে পড়তে হবে। বলতে আপত্তি নেই, আমাদের উচ্চশিক্ষা এখন অনেকাংশেই বাণিজ্যিক। একই সময়ে হয়তো, কোনও কোনও শিক্ষার্থীকে ভর্তি ও ফরম ফিলাপের জন্য গুনতে হবে আরও মোটা অংকের টাকা। যা অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। এই চিত্রটা সারা দেশের প্রায় সবখানে একই।

এই সংকটগুলো সমাধানে শিক্ষার্থীরা আরও খানিকটা সময় পাবে। ফলে, ওই ভাবনাগুলো ক’দিন পরও ভাবা যাবে। আমরা আশা করি, তখন নিশ্চিতভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু এই মুহূর্তে জীবনের প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ানো আবশ্যক। দেশের এই মহাসংকটে সব ব্যাপারেই রাষ্ট্রের উদ্যোগ ও সাহায্যের দিকে চেয়ে থাকা ভালো দেখায় না। সে ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইতোমধ্যে আরও কয়েকটি বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাউন্টিং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনও শিক্ষার্থীদের জন্য তহবিল গঠনের কার্যক্রম শুরু করছে। এভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি তাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এই সংকট উত্তরণ সহজতর হবে। এই মুহূর্তে, বিশ্ববিদ্যালয়/ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, যখন অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সক্রিয় হবে তখন ভর্তি ও পরীক্ষার ফি অন্তত এক বছরের জন্য সম্পূর্ণ মাফ করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বকেয়া মেস ভাড়ার বিষয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অগ্রজরা সবসময় অনুজদের পথ দেখায়। সংকট সমাধানের পথ দেখায়। অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। পাশে দাঁড়ায়। হাত বাড়ায়। সাহস দেয়। অগ্রজরা সবসময় আমাদের প্রেরণা। তারা নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। এই করোনা সংকটেও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যদি প্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে তা হবে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের পারিবারিক সংকট কেটে যাওয়া মানে অসংখ্য পরিবার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এই দুর্দিন মোকাবিলা করতে পারবে। রাষ্ট্রের ওপর থেকেও চাপ কমবে। নিশ্চিত হবে সামাজিক নিরাপত্তা। পুরাতন ও নতুনের মধ্যে এই সেতুবন্ধন নিশ্চয়ই একটি শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থারও ইঙ্গিত দেবে। তাই আমরা আশা করি, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগ্রজরা তাদের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে করোনা সংকট মোকাবিলায় অবশ্যই অনুজদের পাশে দাঁড়াবে।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ