X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ভালোবাসার জন্মদিন

রেজানুর রহমান
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৫আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:১৮

রেজানুর রহমান
তোমার জন্য সকাল, দুপুর, তোমার জন্য সন্ধ্যা। তোমার জন্য সকল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা। ভালোবাসার এই দিনে কবি হেলাল হাফিজের কবিতার এই লাইন দুটি বিশেষভাবে মনের ভেতর নাড়া দিলো। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেইন্টাইন ডে। বাংলায় আমরা বলি ভালোবাসা দিবস। এই দিবসটিকে ঘিরে নানা জনের নানা মত আছে। কেউ কেউ বলেন, বছরের একটি দিন ভালোবাসার দিন হলে বাকি দিনগুলোতে কী করবো? ভালোবাসবো না? অবশ্যই ভালোবাসবো। বছরের অন্যান্য দিনে আরও বেশি করে ভালোবাসবো প্রিয়জনকে। কিন্তু সবকিছুর একটা শুরু থাকে। যাকে বলি জন্মদিন। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভালোবাসার জন্মদিন’। শুভ, শুভ, শুভদিন, আজ ভালোবাসার জন্মদিন।

একথা সকলেই মানবেন ভালোবাসার অনেক শক্তি। এই করোনাকালে উপলব্ধিটা আরও বেশি জোরালো হয়েছে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর, বর্ণিল ও মায়াময়। ভালোবাসার টানেই মূলত মানুষ সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দেয়। প্রিয়জনের মুখে একটু খানি হাসি দেখার সীমাহীন অপেক্ষা থাকে একমাত্র ভালোবাসার কারণে। তোমাকে অনেক দিন দেখি না, এ ধরনের হাহাকার অথবা অভিযোগ যখন কেউ কাউকে করে তখন বুঝতে হবে সে তাকে অনেক পছন্দ করে। অনেক, অনেক বেশি ভালোবাসে। মোট কথা ভালোবাসাই জীবনশক্তি। সে কারণে কেউ কারও ভালোবাসা পেলেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। আকাশের চাঁদ এখানে একটি উপমা মাত্র। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া মানে নিজেকে যোগ্য এবং ক্ষমতাবান হিসেবে আবিষ্কার করা। তরুণ বয়স। একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। রোজ বাড়ির ছাদে উঠে নানান কাজের ছুতোয় নিজেরা ভাবের আদান-প্রদান করে। কিন্তু ছেলেটি যত না সাহসী মেয়েটি ততটাই ভীতু। আর তাই ছেলেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করে প্রতিদিন। পাছে না কেউ দেখে ফেলে এই ভয়েই মেয়েটি বেশিদূর এগোয় না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে কোত্থেকে যেন সাহস পায় মেয়েটি। ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আই লাভ ইউ! যার বাংলা অর্থ আমি তোমাকে ভালোবাসি... ব্যস, এই একটি লাইনই মেয়ে এবং ছেলেটির জীবন বদলে দেয়। ভালোবাসার শক্তিই তাদের সাহসী করে তোলে। একটু আগে যা ছিল তার কাছে অনেক দুরূহ কাজ, হঠাৎ সেটিই সহজ-সরল হয়ে ওঠে।

অনেকে বলেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটা জৈবিক তাড়নাও কাজ করে। ফেসবুকে কেউ একজন লিখেছেন পুরুষ তুমি কতটা পৌরুষদ্দীপ্ত সেটা ভালো বলতে পারবে তোমার স্ত্রী। তার এ কথার জবাবে অন্য একজন লিখেছেন, তাহলে কী জীবনে যৌনতাই আসল? ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই? অর্থাৎ শুধু যৌনতা নয়, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর মায়াই হলো মূল বিষয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে বিশ্বাস। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটা শুধু কথার কথা নয়। এটি একটি বিশ্বাসের আয়না। যেখানে মুখ ফেললেই পাওয়া যাবে সাফল্যের ঠিকানা। আয়নায় দেখা যাচ্ছে কঠিন গন্তব্যের রাস্তা। তবু ভয় হয় না। কেন হয় না? ওই যে ভালোবাসা আছে সাথে। ভালোবাসা মানেই শক্তি আর বিশ্বাস। তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই ঘর ছেড়েছি... তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই ত্যাগ করেছি জগৎ সংসার। তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি সাফল্যের ঠিকানা।

ভালোবাসার শক্তি জোগাতে অন্য অনেক কিছুর মতোই সিনেমার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কালজয়ী সিনেমা জুটি ওপারের উত্তম-সুচিত্রা আর আমাদের এখানে রাজ্জাক-কবরী জুটি এখনও অনেকের প্রেমিক মনে সাহস জোগায়। উত্তম-সুচিত্রা সিনেমা জুটি বহু পুরনো। অথচ এখনও সবার কাছে অনেক প্রিয়। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখে এখনও প্রেমিক মন চঞ্চল হয়। আবার কেউ কেউ প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে সাহস, শক্তিও পায়। রাজ্জাক-কবরী সিনেমা জুটিও অনেকের প্রেরণার উৎস। প্রশ্ন উঠতেই পারে একটি সিনেমা কী করে ভালোবাসার প্রেরণাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়? সহজ উত্তর। সিনেমা যখন জীবনের কথা বলে তখন তা শুধু সিনেমা থাকে না। জীবন গড়ার প্রেরণা হয়ে ওঠে। উত্তম-সুচিত্রার যুগে বহু বাঙালি যুবক সিনেমা দেখেই তাদের প্রেমের রাজ্য সাজিয়েছিল। উত্তম-সুচিত্রাকে দেখে অনেকে জীবন গড়ার সাহস খুঁজে নিতো। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না? এই সাহসে ভর করে জীবন সাজাতো। রাজ্জাক-কবরী সিনেমা জুটিও এমনটাই জরুরি হয়ে উঠেছিল অনেকের কাছে। মন ভালো নেই, নিজের কাজে গতি পাচ্ছি না, চলো সিনেমা দেখে আসি। সিনেমার ভালোবাসাই একটা সময় প্রেরণার আলো ছড়াতো। সিনেমায় রাজ্জাক যদি পারে, তাহলে আমি কেন পারবো না? অর্থাৎ জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে রাজ্জাকের অভিনীত সকল চরিত্রই তরুণ মনে দাগ কাটতো। একইভাবে কবরীসহ অন্য নায়িকারাও হয়ে উঠেছিলেন অনেক তরুণীর আইডল। কবরী পারলে আমিও পারবো... এই প্রেরণাই ছড়াতো তখনকার দিনের সিনেমাগুলো।

বর্তমান যুগে ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গিটাই অন্য রকম হয়ে গেছে। আগেরকার দিনে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই একটি কথা বলতেই হয়তো বছরের পর বছর সময় পার হয়ে যেতো। আর এখন যখন মন বলল ভালোবাসার কথা তখনই ফেসবুক অথবা এসএমএস-এর মাধ্যমে লেখা হলো প্রেমের সংক্ষিপ্ত চিঠি। আই লাভ ইউ লিখতেও যেন অনেক কষ্ট। তাই লেখা হলো–  I L U। এভাবেই অতি সংক্ষিপ্ত শব্দের আদান-প্রদান করেই হয়তো চলতে থাকলো ভালোবাসাবাসি খেলা। হঠাৎ হয়তো একজনের অন্যজনকে পছন্দ হলো না। ব্যস ব্রেকআপ... একথা আবার সগৌরবে অন্যকে জানিয়ে দেয় কেউ কেউ। আমার সাথে ওর ব্রেকআপ চলছে।

সে কারণে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সুখ শব্দটার পাশাপাশি দুঃখ শব্দটাও এখন বেশ পরিচিত। আগের দিনে ভালোবাসার এক একটা চিঠি যেন ছিল ভালোবাসার মহাকাব্য। আর তাই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার আশায় মন সারাক্ষণ উন্মুখ থাকতো। ডাকপিয়ন ছিল সবার পছন্দের মানুষ। একটা চিঠির অপেক্ষায় বিরামহীন অপেক্ষা ছিল অনেক আনন্দের। সেখানে দুঃখের চেয়ে সুখের ঘটনায় ছিল বেশি।

তাহলে মূলকথা কী দাঁড়ালো? ভালোবাসা আসলে কী? এটা কি দিল্লি কা লাড্ডুর মতো। ‘জো খায়া সে ভি পস্তায়া, জো নেই খায়া সে ভি পস্তায়া’। দিল্লির লাড্ডু, যে খেয়েছে সেই ভুগেছে আবার যে খায়নি সেও ভুগেছে... আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। আগেই বলেছি ভালোবাসা হলো একটা শক্তি। যা হতাশ মানুষকেও বেঁচে থাকার সাহস জোগায়। যেকোনও মহৎ কাজে সাফল্যের পথ দেখায়।

পরিবারের কথাই বলি। অনেক ধনী পরিবার। প্রাচুর্যে ভরা চারপাশ। অথচ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোনও সদ্ভাব নেই। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। কে কখন এলো, কে কখন গেলো তারও ঠিক ঠিকানা নাই। এই পরিবার আসলে কোনও পরিবারই নয়। আবার অন্য একটি পরিবার। তেমন প্রাচুর্য নেই। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলো পরস্পরের প্রতি অতিমাত্রায় যত্নশীল। একজনের প্রতি অন্যজনের অনেক মায়া। এই পরিবারটিকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে এই পরিবারটিই একদিন সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভালোবাসার ছায়া ফেলবে। কারণ, ভালোবাসার শক্তিতেই বেড়ে উঠেছে পরিবারটি।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ভালোলাগা এমন এক জিনিস, যা একবার শুরু হলে সবকিছুই ভালো লাগতে থাকে। কথা সত্য। একবার আপনাকে ভালোবাসায় পেলে বুঝবেন জীবন কত সুন্দর। তবে ভালোবাসায় যত্ন জরুরি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। এই সংলাপই ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ভালোবাসায় বিশ্বাস, নির্ভরতা, শ্রদ্ধা এবং মায়া খুবই জরুরি। ক্রোধ ভালোবাসার চরম শত্রু। সহজ কথায় রাগ। সেজন্য কথায় বলে ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। 

একটি ছোট্ট গল্প শোনাই আপনাদের। প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তারা। ধরা যাক ছেলেটির নাম রাজ্জাক। মেয়েটির নাম কবরী। সিনেমায় রাজ্জাককে দেখে বাস্তবের কবরী বাস্তবের রাজ্জাকের প্রেমে পড়ে যায়। সিনেমার রাজ্জাক গরিব ঘরের সন্তান। আর সিনেমার কবরী ধনীর দুলালী। বাস্তবের রাজ্জাক কবরীও সে রকম। সিনেমায় অচলায়তন ভেঙেছে কবরী। সিনেমার রাজ্জাকের সঙ্গে প্রেম করেছে। অতঃপর তার জন্য ঘর ছেড়েছে। বাস্তবের রাজ্জাক, কবরীও তাই করে। কিন্তু পরবর্তীতে আর সিনেমার রাজ্জাক-কবরীর সঙ্গে নিজেদের মিলাতে পারে না। সিনেমায় দেখানো হয়েছিল রাজ্জাক প্রথমে সাইকেল তারপর মোটরসাইকেল চালালেন, তারপর গাড়ি চালালেন। পরের দৃশ্যেই তার বাড়ি হয়ে গেলো। বাস্তবের রাজ্জাক সাইকেল কেনার পর আর মোটরসাইকেল কেনার সামর্থ্য গড়তে পারেন না। শুরু হয় ভালোবাসার সুখ দুঃখের কঠিনতম গল্প...।

এই গল্পেরও একটা উল্টো পিঠ আছে। আমাদের বাস্তবের রাজ্জাক কবরী বিয়ের পর সিনেমায় দেখা কাহিনি ভুলে গিয়ে শপথ করলেন জীবনযুদ্ধে যে করেই হোক জয়ী হবেন। দু’জন হাতে হাত রেখে বললেন, যেখানেই থাকি, যেভাবেই বাঁচি, ভালোবেসে যাবো। কেউ কারও হাত ছাড়বো না... একে বলে ভালোবাসার শক্তি। সেখানে সুখ যেমন আছে দুঃখও আছে... ভালোবাসার জয় হোক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
বেসিস নির্বাচন২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি
মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ