X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা না করলেও নারীকে অন্তত বাঁচতে দিন

রুমিন ফারহানা
০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:২৮আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:২৮

রুমিন ফারহানা প্রতি বছর ৮ মার্চ এলেই অবধারিতভাবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমার ডাক পড়ে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মূলত একই প্রশ্ন নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়। যে দেশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, সেই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি কতদূর? সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই করা হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত হলো? নারীর রাজনীতিতে আসার পথের প্রতিবন্ধকতা কী? দলের সব স্তরে ৩৩% নারী সদস্য থাকার যে বাধ্যবাধকতা আরপিওতে করা হয়েছে সেটার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অগ্রগতি কতদূর? ইত্যাদি ইত্যাদি।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার থাকা দরকার, রাজনীতি সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, সুতরাং সমাজে সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন না হলে, নারীর বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে সেটি রাজনীতি হোক কিংবা অন্য যা কোনও পেশা, নারীর প্রকৃত উন্নয়ন কিছুতেই সম্ভব না। পুরো বিশ্বই পুরুষতান্ত্রিক, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই দেশটি কেবল পুরুষতান্ত্রিকই নয়, সেই সঙ্গে নারী বিদ্বেষীও বটে। একটা উদাহরণ বিষয়টি স্পষ্ট করবে। একই অপরাধ যদি একজন পুরুষ এবং নারী দু’জনই করে তবে নারীর ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিক্রিয়া হয় অনেক বেশি হিংস্র, আক্রমণাত্মক, ব্যক্তিগত এবং লিঙ্গ নির্দেশক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচার সালিশ চলার সময় যদিও বা পুরুষের পক্ষে দুই পাঁচ জনকে কিছু বলতে শোনা যায়, কিন্তু নারীর পক্ষে অসম্ভব।

যে পরিবারে আমার জন্ম এবং যে পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা, তাতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগ পর্যন্ত নারী-পুরুষের অসমতার বিষয়টি আমার সামনে তেমনভাবে আসেনি। ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে নিজস্ব ল’ ফার্ম তৈরির আগে দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীর অধীনে কাজ করতে গিয়ে প্রথম যে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তা হলো, আমি নারী। কেউ স্পষ্ট, কেউ ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন, দু’দিন পর যেহেতু বিয়েই হয়ে যাবে, তাই একজন নারীকে কাজ শেখানো অর্থহীন। আমাদের দেশে যেহেতু বিয়ের পর একজন নারীর পক্ষে সারা দিন আদালত করে রাত জেগে চেম্বার সামলানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না, সেহেতু তাদের মতে আমাকে চেম্বারে নিয়ে কাজ শেখানো সময় নষ্টের নামান্তর। বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলি, কাজ শেখার আগেই আমি যে কাজ শিখতে চাই, পেশায় থাকতে চাই, কোর্ট প্র্যাকটিস করতে চাই, সেটুকু প্রমাণ করতে আমাকে বছর খানেকের বেশি সময় ভোরবেলা সবচেয়ে আগে চেম্বারে ঢুকে, সারাদিন আদালতে কাটিয়ে, বেশ রাতে সর্বশেষ জুনিয়রের সঙ্গ চেম্বার থেকে বেরোতে হয়েছে। অথচ আমার পুরুষ সহকর্মীকে দেখেছি চেম্বারে ঢোকার কয়েক দিনের মাথায় ফাইল হাতে বাসায় যেতে। এত প্রিভিলেজড অবস্থা থেকে এসে যদি আমাকে ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হয় শুধু এটুকু প্রমাণের জন্য যে আমি কাজ শিখতে চাই তাহলে প্রিভিলেজড অবস্থা থেকে না আসা নারীটিকে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়, সেটা সহজেই অনুমেয়।

আগেই বলেছি, যে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের মন-মানসিকতা এত নারীবিদ্বেষী, সেখানে একজন নারীর যেকোনও পেশায় এগিয়ে আসা ও উন্নতি করা খুব চ্যালেঞ্জিং। পুরুষের দ্বিগুণ-তিনগুণ শ্রম দিয়ে আসতে হয়। রাজনীতিতে এটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। সুতরাং আমরা চাইলেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারি না। তার ওপর যেকোনও পেশার মতো রাজনীতিতেও নারীর সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানের দিকে লক্ষ রাখা উচিত। আর তাই কেবল ৩৩ শতাংশ দেখানোর জন্য নারীর সংখ্যা বাড়িয়ে কমিটি করে লাভ নেই। যোগ্যতাসম্পন্ন নারী এলে সেটা ফলপ্রসূ হবে। গুণগত পরিবর্তন হবে।

রাজনীতিতে আর একটি বড় সমস্যা হলো কালো টাকা। পেশিশক্তির এই প্রবল দাপটের সময় ভালো পরিবারের শিক্ষিত একটা ছেলেই যেখানে রাজনীতিতে আসতে ভয় পায় সেখানে নারীর জন্য পথটাতো আরও অনেক বেশি পিচ্ছিল, বিপদসংকুল। দুর্ভাগ্য হলো, এই দেশে ঘর, পথ কিংবা কর্মস্থল কোনোটিই নারীর জন্য নিরাপদ করতে পারিনি। সেখানে রাজনীতির মাঠ তো অনেক দূরের বিষয়।

গত কয়েক বছরে দেশের রাজনীতি এতটাই কলুষিত হয়েছে যে এখন এখানে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষিত, মার্জিত পুরুষরাই রাজনীতিতে আসে না; রাজনীতি পরিণত হয়েছে মূলত অর্ধশিক্ষিত, অমার্জিত পুরুষের বিচরণক্ষেত্রে। আবার রাজনীতিতে যদি ক্ষমতার কাছে যাওয়া যায় তবে সেটা তো বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে কারও হাতে আক্ষরিক অর্থেই আলাদিনের প্রদীপ দিয়ে দেয়। ফলে শিক্ষিত ভদ্র মানুষের রাজনীতিতে টিকে থাকা এক নিরন্তর কঠিন যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এ কারণে শিক্ষিত, মার্জিত পুরুষরাই রাজনীতিতে আসার আগে ভাবেন বহুবার। আর যদি চলেও আসেন তাহলে টিকে থাকতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই। সেখানে একজন নারীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কেমন, সেটা বোঝার জন্য অতি সামান্য কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।

একজন কর্মজীবী নারীকে মূলত দু’টো চাকরি করতে হয়। আমাদের সমাজ এখনও বিশ্বাস করে নারীর প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সংসার সামলানো। সে কারণেই রাজনীতির ঝুঁকিপূর্ণ জীবন, ঘড়ি ধরা সময়সূচির বাইরে যেকোনও সময়ে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং আমাদের সমাজে এখনও অভ্যস্ততা পায়নি। সবেমাত্র সমাজ শিক্ষকতা আর ডাক্তারি পেশার বাইরে নারীকে ভাবতে শিখছে, কিন্তু তাই বলে রাজনীতি? ‘নৈব নৈব চ’। আছে নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব, পারিবারিক বাধা, সমাজের চোখ রাঙানি এবং সর্বোপরি নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো।

নারীবিদ্বেষী এ দেশের আর একটি চরিত্র হলো সব সফল নারীর পেছনে একজন পুরুষের ছায়া খোঁজা হয়। সম্ভবত একজন নারী একা একা কেবল নিজ যোগ্যতায় সফল হয়ে যাবেন, এটা সমাজ এখনও মানতে শিখেনি, তার ইগোতে লাগে। তাই নারীর সাফল্যের সিঁড়ি হিসেবে যদি স্বামী, পিতা কিংবা ভাইয়ের ছায়া পাওয়া না যায়, তখন সমাজ নিজে একটি কাল্পনিক ছায়া তৈরি করে নেয়, যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যা এবং অসম্মানজনক। রাজনীতিতে এই চর্চা আরও বেশি। এখানে প্রতিপক্ষ বহুমুখী এবং স্টেইকটাও অনেক উঁচু। আর তাই এই ক্ষেত্রে সাফল্যও অনেক সময় নারীর জন্য ভীতিকর।

মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের নিচে মানুষের করা মন্তব্যগুলো একটু খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায় নারীর বিষয়ে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে সমাজ। লৈঙ্গিক পরিচয় আক্রমণ করে দেওয়া সেই বীভৎস মন্তব্য থেকে বাদ যান না রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে কেউই। নারী তিনি যত ক্ষমতাধর কিংবা সম্মানীয় হন না কেন, দিনের শেষে তার লৈঙ্গিক পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। অবাক লাগে ডিজিটাল আইনে এত মামলা, এত কঠোরতা অথচ নারীর হয়রানির ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নাই বললেই চলে।

এই বছরের নারী দিবসে একটি পোর্টাল রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমার মন্তব্য চায়। অনেক কথা বলেছিলাম, যার মধ্যে ছিল নিচের কথাগুলোও; প্রাসঙ্গিক হওয়ায় যুক্ত করছি এখানে -

‘কীসের নারী দিবস? বাংলাদেশে কোন নারী দিবসের কথা বলেন? সাধারণ একটা মেয়ের কাহিনি কোথাও এলে তাকে নিয়ে যে ধরনের কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়, যে ধরনের স্ল্যাং (গালি) ব্যবহার হয়, নোংরা কাটাছেঁড়া হয়; এই যে নাসির ও তার স্ত্রীকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই লেখা হয়েছে; মিথিলাকে নিয়ে তার জন্ম থেকে সবকিছু কাটাছেঁড়া করা হয়েছে; তার আগে শমী কায়সারকে নিয়ে কী হয়েছে; আমি অবাক হয়ে যাই, আমাদের দেশের মানুষ যে মানসিকতা ধারণ করে সে অবস্থায় আপনারা কীসের নারী দিবস আর অধিকারের কথা বলছেন? ন্যূনতম সম্মান দেখান না। ফটোশপের সবচেয়ে বড় শিকার নারীরা। তা সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লেখক-সাংবাদিক ও বিরোধী মত দমনে ব্যবহার হয়, কিন্তু এই নারীদের সুরক্ষায় ব্যবহার হয়েছে, তেমনটা দেখছি না। ক্ষমতায়নের আগে নারীদের শ্রদ্ধা করেন। অন্তত শ্রদ্ধা না করলেও মানুষ হিসেবে তাকে বাঁচতে সুযোগ দেন।’

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ