X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুছে যাক গ্লানি, দূরে যাক করোনা’

প্রভাষ আমিন
১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৮:৫২আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৮:৫২

প্রভাষ আমিন রমজান আমাদের দেশে এবং ঘরে অন্যরকম আবহ নিয়ে আসে। রমজান সংযমের মাস। কিন্তু সেই সংযমটা আমরা পালন করি উৎসবমুখরতায়। ভোররাতে সেহরি খাওয়ার সময় একধরনের উৎসব। দিনভর অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় ইফতার আরেক ধরনের উৎসব। মনে হতে পারে সারাদিন না খেয়ে থাকাটা কষ্টকর। কিন্তু একজন বিশ্বাসী মুসলমানের কাছে এটা কষ্ট নয়, এই সংযমেও আনন্দ আছে। আর এক মাসের সংযম শেষে অফুরান আনন্দ নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সংযম-আনন্দ- সব মিলিয়ে রমজান এক অনাবিল উৎসবেরই নাম।

আর নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নববর্ষে উৎসবের বাণ ডাকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। এবার রমজান আর নববর্ষ এসেছে একই দিনে। বাংলাদেশে এ দুটি উৎসবের উপলক্ষ আর কবে একই দিনে এসেছিল জানি না। কিন্তু একই সঙ্গে এ দুটি উৎসবের দিনেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছে লকডাউন।

সুনামি হয়ে আসা ভয়ঙ্কর করোনা কেড়ে নিয়েছে আমাদের সব উৎসবের রঙ। রমজান আর নববর্ষ এর আগে কবে একই দিনে এসেছিল জানি না। তবে এমন বিষণ্ন দিন আগে কখনোই আসেনি। পুলিশের কড়াকড়িতে রাস্তাঘাটে সুনসান নীরবতা। নববর্ষের ভোরে রমনা বটমূল যেন বিরানভূমি। কোথাও নেই উৎসবের ছোঁয়া। চারদিকে আতঙ্ক, ভয়, মৃত্যুর গন্ধ। অন্যসময় রমজান বা নববর্ষ এলে ফোনের মেসেজ বক্স, মেসেঞ্জার উপচে পড়ে শুভেচ্ছা বানীতে। আর এবার দুটি উপলক্ষ একসাথে। কিন্তু বার্তা এসেছে হাতে গোনা। শুভেচ্ছা জানানোর মানসিকতাটাই হারিয়ে গেছে। সকাল থেকে যে কটা ফোন পেয়েছি; সবার সাথেই কথা হয়েছে অক্সিজেন লেভেল, আইসিইউ, করোনা এসব নিয়ে। দুপুরে পেয়েছি প্রিয় বন্ধু ধনঞ্জয় দাসের পিতার মৃত্যুসংবাদ। অনেকদিন ধরেই তিনি আইসিইউতে ছিলেন। নববর্ষে পিতার মৃত্যু কতটা বেদনার বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু ফোন করে দুইজনই কিছুক্ষণ চুপ কেরে ছিলাম। এমন বেদনায় কীভাবে শোক জানাতে হয় জানি না। নীরবতায় বেদনা শেয়ার করেছি। কাছে গিয়ে যে ধনঞ্জয়কে বুকে জড়িয়ে ধরবো সে উপায়ও নেই। এই লেখা লিখতে লিখতে খবর পেলাম বাংলা একাডেমির সভাপতি, সাবেক মহাসচিব লোক গবেষক ড. শামসুজ্জামান খানকেও কেড়ে নিয়েছে করোনা। একটু পর খবর এলো, সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুও নেই। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হলেও দায়িত্ব নেওয়ার আগেই চলে গেলেন। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। এত শোক আমরা সইবো কেমন করে?

অদৃশ্য করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার কোন অস্ত্রটা কার্যকর, তা নিয়ে এখনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বজুড়েই তাই চলছে নানান নিরীক্ষা, নানান চেষ্টা। নতুন এই ভাইরাসের কোনও সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই।

তড়িঘড়ি করে কয়েকটি টিকা এসেছে বটে, তবে কোনও টিকাই শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। টিকা নিলেও মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারে। যদিও গবেষকরা বলছেন, টিকা নিলে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি কিছুটা কমে। এখন পর্যন্ত যা যা গবেষণা, তাতে দেখা গেছে, করোনার প্রথম টিকা হলো মাস্ক। করোনা আমাদের ফ্যাশনে নতুন একটি উপকরণ যুক্ত করেছে। নানান ধরনের, নানান রঙের মাস্ক এখন মানুষের থুতনিতে। তবে বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকে মাস্কটা থুতনি থেকে মুখে তুলতে হবে। তবে করোনা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বিচ্ছিন্নতা। সুশীল ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব।

করোনা এসে আমাদের কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি অনেককিছুই শিখিয়েছে। গতবছর মার্চে এই কলামে লিখেছিলাম, ‘বিচ্ছিন্নতায় সৃষ্টি হোক মানবতার ঐক্য।’ একবছরেও পরিস্থিতি একটুও পাল্টায়নি। এখনও বিচ্ছিন্নতাই করোনা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। মানুষ সামাজিক জীব। বিপদে-আপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এবার বিশ্বে এমন এক দুর্যোগ এসেছে, যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এখন আমাদের শারীরিকভাবে দূরে থাকতে হবে, তবে মানসিকভাবে আরো কাছে আসতে হবে।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখা সত্যি কঠিন। আগেও লিখেছি, শুধু কাওরানবাজারেই প্রতিদিন যত মানুষ আসে,পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যাও তত নয়। তাই এখানে বিচ্ছিন্নতার সূত্র প্রয়োগ করা আসলেই কঠিন।

এক বছর ধরে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেছে এবং আমরা বারবার সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়েছি। গত বছর করোনা আসার পর বাংলাদেশ ৬৬ দিনের ঢিলেঢালা সাধারণ ছুটি কাটিয়েছে। এই ছুটিতে মানুষ ঈদের আমেজে বাড়ি গেছে, পিকনিকের আমেজে বেড়াতে গেছে। এবার যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামি হয়ে এসে সব ভাসিয়ে নিচ্ছে, তখনও সরকার নানা চেষ্টা করেছে। ২৮ মার্চ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেও কাজ হয়নি। ৪ এপ্রিল ‘লকডাউন’এর ঘোষণা দিলেও কাজ হয়নি। কিন্তু সরকার চাইলে যে পারে, তা প্রমাণ হয়েছে ১৪ এপ্রিলের ‘কঠোর লকডাউন’ দেখে। সরকার একটু কঠোর হতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। কঠোর লকডাউনে জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পুলিশ ‘মুভমেন্ট পাস’এর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু যে কোনও ভালো উদ্যোগকে মাঠে মারতে আমাদের জুড়ি নেই। মুভমেন্ট পাস পেতে মিনিটে ২০ হাজার মানুষ আবেদন করছে এবং এক পর্যায়ে ওয়েবসাইটটি ক্র্যাশ করার দশা হয়েছে।

আবেদনকারীর সবাই যদি মুভমেন্ট পাস নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তাহলে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার আর কোনও উপায় থাকবে না। যাদের জরুরি দরকার, তারা অবশ্যই ঘর থেকে বেরুবে। কিন্তু প্রতি মিনিটে যে ২০ হাজার জন মুভমেন্ট পাসের জন্য আবেদন করছে, তাদের সবার নিশ্চয়ই ঘর থেকে বেরোনো জরুরি নয়। সব অফিস-আদালত বন্ধ থাকলে তারা বেরিয়ে কই যাবেন? নিজেদের সুরক্ষাটা যদি আমরা না বুঝি,সরকার পিটিয়ে কতটা বোঝাতে পারবে। ঢিলেঢালা লকডাউন বা দিনের পর দিন চোর-পুলিশ খেলার সাধারণ ছুটির চেয়ে দুই বা তিন সপ্তাহের কঠোর লকডাউন অনেক বেশি কার্যকর, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে কোথাও কোথাও পুলিশের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী এবং গণমাধ্যম কর্মীরা। লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। তবে তারা যেন লকডাউনের আওতার বিষয়টা মাথায় রাখেন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, গণমাধ্যম, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানিসহ সবধরনের জরুরি সেবা কিন্তু লকডাউনের আওতামুক্ত। তারচেয়ে বড় কথা হলো করোনা আসার পর থেকে ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, কখনও কখনও নিজের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন বাঁচাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়তি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। পুলিশও যেন রাস্তায় স্বাস্থ্যকর্মীসহ জরুরি সেবার মানুষদের সহায়তা করে। তারা তো অকারণে ঘর থেকে বের হননি। যারা অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে, তাদের ব্যাপারে কঠোর হোক। কিন্তু যারা ঝুঁকি নিয়ে প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে, তাতের বিষয়টা যেন মানবিকভাবে বিবেচনা করা হয়। আমরা জানি, পুলিশ যে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করছে,তারাও মানুষ, করোনা তাদেরও ধরতে পারে। তাই তাদের প্রতিও আমাদের সম্মান থাকতে হবে। পারস্পরিক সম্মান-মর্যাদা এবং মানবিকতা দিয়েই আমাদের এই দুর্যোগের মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে।

আর এই সময়ে দিন এনে দিন খাওয়া গরিব মানুষের কথা ভুলে গেলে চলবে না। সরকারকে অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নববর্ষের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মানুষের জীবন সবার আগে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া যাবে। তাই জীবন-জীবিকার অসুবিধা হলেও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।’ সরকার যাই করুক আর না করুক, জীবনটা কিন্তু আমাদের। আমরা সবাই যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হই, সরকারকে সহায়তা করি; তাহলে অল্পসময়ের লকডাউনেই করোনার ঢেউ ভেঙে দিতে পারবে। নইলে কিন্তু করোনা সুনামি জীবন-জীবিকা সবকিছু ভাসিয়ে নেবে। এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর এলো,করোনায় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ৯৬। গত কয়েকদিনে এই রেকর্ড বারবার ভাঙছে। আমরা যদি সবাই সাবধান না হই, সামনে আরো বেদনাদায়ক সময় আসতে পারে। আর করোনা এমন এক ভাইরাস ব্যক্তি সাবধান থাকলেও সবাই সাবধান না থাকলে পুরোপুরি সুরক্ষা মিলবে না।

নতুন বছর এলে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে নানান কিছু প্রার্থনা করি। এবার চাওয়ার কিছু নেই, সুস্থ থাকাটাই বড় পাওয়া, বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় লাভ।

প্রতিবছর নববর্ষে আমরা গাই, মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এবার সেই চাওয়ায় একটু বদল আনা দরকার,  মুছে যাক গ্লানি, দূরে যাক করোনা। আমি জানি করোনার এই বিষ একমাসে যাবে না।

আসলে কবে যাবে কেউ জানে না। রমজান যতটা শঙ্কা নিয়ে এলো, আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাকে যদি একটু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি; তাহলে হয়তো ঈদ কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসবে। আপাতত সেই সুদিনের অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্কটল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে নেই ডেভি
স্কটল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে নেই ডেভি
‘জিম্মি হওয়ার পর শুধু এই দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম’
‘জিম্মি হওয়ার পর শুধু এই দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম’
বগুড়ায় নির্বাচনি ক্যাম্পে আ.লীগ কর্মীকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, থানায় মামলা
বগুড়ায় নির্বাচনি ক্যাম্পে আ.লীগ কর্মীকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, থানায় মামলা
মুগদায় রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার
মুগদায় রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ