X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্পই যখন লক্ষ্য

রুমিন ফারহানা
১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৪৩আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৪৫

রুমিন ফারহানা

বাংলাদেশ ভারি মজার দেশ। এখানে নানান আজব আজব কাণ্ড হয়। এই যেমন করোনা বীভৎস আকার ধারণ করতেই হঠাৎ দেখি খবরে বলছে এক হাসপাতাল নাকি ‘উধাও’ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে মানুষ উধাও হয়, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার উধাও হয়, রাস্তা উধাও হয়, সরকারি দলের বিরুদ্ধে মামলা উধাও হয়, ব্যাংক-শেয়ার বাজার, এমনকি দেশ থেকেও টাকা উধাও হয়; তবে জীবন-মরণের নির্ণায়ক হাসপাতাল মহামারির সময় উধাও হওয়ার নজির বিশ্বেই বোধ করি প্রথম।
     
করোনা মহামারি মোকাবিলার জন্যে বসুন্ধরায় প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালটি বানিয়েছিল স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। দুই হাজার শয্যার করোনা আইসোলেশন হাসপাতালটি বানানোর সময় বলা হয়েছিল, পৃথিবীর আর কেউ এত অল্প সময়ে এত বড় হাসপাতাল বানাতে পারেনি। রোগী না থাকার অজুহাতে সেই হাসপাতাল কয়েক মাস আগেই তুলে ফেলা হয়েছে।

ওদিকে মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় গত বছর একটি হাসপাতাল বানানো হয়েছিল করোনা মহামারি মোকাবিলার জন্যে। অন্য হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকটের মুখে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালটি বানানো হয়েছিল। এক হাজার ৩৯০ শয্যার এই হাসপাতাল বানাতে খরচ হয়েছিল ১৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এবার মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আগেরটির চাইতে অনেক বেশি প্রকট হওয়ার কারণে রোগীর চাহিদা বাড়ায় একই ভবনের পঞ্চম তলায় এখন আরেকটি হাসপাতাল বানানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন রোগী ভর্তি না থাকায় দোতলার হাসপাতালটি ধুলো-ময়লার স্তূপে পরিণত হয়েছে। এখন প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তো সেই হাসপাতালটিকে সাফ-সুতরো করেই ব্যবহার করা যেত। একই ভবনে আরেকটি নতুন হাসপাতাল বানানোর মতো তুঘলকি কাণ্ড হচ্ছে কেন?

আমরা এখন এমন সময় পার করছি যখন করোনা ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি কোনও হাসপাতালে হাইফ্লো অক্সিজেন, এইচডিইউ, আইসিইউ পাওয়া স্বপ্নের মতো; এমনকি একটা শয্যা পাওয়াও ভীষণ সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সরকারের ন্যূনতম কর্তব্য ছিল প্রতি মুহূর্তে এই সংক্রান্ত খবরের রিয়ালটাইম আপডেট মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানানো, সেখানে আজ যা জানানো হচ্ছে তা আসলে দুদিন আগের। সে কারণে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি, মানুষ মারা যাচ্ছে রাস্তায় কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে স্রেফ অক্সিজেনের অভাবে।

বসুন্ধরার হাসপাতালটি যদি থাকতো, কিংবা ডিএনসিসি মার্কেটে নতুন হাসপাতাল না বানিয়ে গত বছর তৈরি মার্কেটের দ্বিতীয় তলার হাসপাতালটি যদি কাজে লাগানো হতো তাহলে সেটা এখনই ‘একটি শয্যার অভাবে চরমভাবে ভোগা’ মানুষদের জন্য আশার আলো হতে পারতো। ডিএনসিসি মার্কেটে আরেকটি নতুন হাসপাতাল তৈরি রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিশাল অপচয় তো বটেই, এটা কার্যকর হতে দেরি হয়ে যাবে অনেক। প্রতিটি হাসপাতালই হাসি হাসি মুখে উদ্বোধন করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যিনি সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছেন, সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলে পুরো ঢাকা শহরকে হাসপাতাল বানালেও কাজ হবে না।

নাগরিক হিসেবে সারা ঢাকাকে হাসপাতাল বানানোর উদ্ভট, অসম্ভব কল্পনা বা দাবি আমাদের কারোরই নাই, তবে এটুকু নিশ্চয়তা নিশ্চয়ই দাবি করতে পারি, সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটা নিশ্চিত করা সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব ছিল। অথচ দেখা গেলো, ৮ মার্চ ২০২০ থেকে ৮ মার্চ ২০২১-এ স্বাস্থ্য খাতে কোনও পরিবর্তনই আসেনি। মাঝখান থেকে সরকারের নানা অসংলগ্ন কথা, আচরণ এবং সিদ্ধান্তে করোনা নিয়ে যে ভীতিপ্রসূত সচেতনতা ছিল,এখন সেটুকুও নেই। মানুষকেই বা দোষ দেই কী করে? সরকার কখনও বলে ‘সাধারণ ছুটি’, কখনো   ‘কঠোর বিধিনিষেধ’, কখনো ‘লকডাউন’ কখনো ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ কিন্তু অল্পদিন আগে পর্যন্ত চালু ছিল বইমেলা, বাংলাদেশ গেমস, অফিস-আদালত, শপিং মল, গণপরিবহন। পরিস্থিতি এমন যে ভবিষ্যতে একটা সত্যিকার লকডাউনকে কীভাবে বোঝানো হতে পারে সেটা নিয়ে নেটিজেনরা ট্রল করে দিচ্ছেন নানা প্রস্তাব–‘বিশ্বাস করেন লকডাউন’, ‘আল্লাহর কসম লকডাউন’ ইত্যাদি। এর অবশ্যম্ভাবী ফল যা হবার কথা ছিল তাই হয়েছে।

যে বিশেষণ লাগিয়েই লকডাউন হোক না কেন সেটি শুরুর আগেই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রী মিডিয়াকে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন কোনোভাবেই বন্ধ থাকবে না সেতু, মেট্রোরেল, টানেলসহ কোনও মেগা প্রকল্পের কাজ।

গত বছরও যখন সারা পৃথিবীর অনেক দেশে লকডাউন চলছিল, আমাদের দেশেও চলছিল ‘সাধারণ ছুটি’ তখন বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে কাজ করা বিদেশি প্রকৌশলী এবং পরামর্শকদের অনুপস্থিতির কারণে কাজ বন্ধ হয়েছিল দীর্ঘ সময়। সেই পরিস্থিতিতে সরকারের অস্থিরতা ছিল দেখার মতো। অতি উচ্চ পর্যায়ের একটা বৈঠকে রীতিমতো সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‌সেসব প্রকৌশলী এবং পরামর্শকদের বিশেষ বিমানে করে বাংলাদেশ নিয়ে এসে মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করা যায়।

এমন পরিকল্পনা সরকার খুব সিরিয়াসলি করছিল যখন দেশের বহু মানুষ হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন কিংবা আইসিইউর অভাবে মারা যাচ্ছিল। মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে সরকার মরিয়া চেষ্টা এমন সময়ে করছিল যখন প্রায় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ থাকার কারণে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছিল।

জীবনযাপনের অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু খাবারের সংস্থান করতে গিয়েই মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। হাজার হাজার কিংবা লক্ষাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প করা সরকারটিকে ভীষণ দরিদ্র দেখাচ্ছিলো এই সময়গুলোতে।

করোনার এই ভয়াবহ দুঃসময় হাসপাতাল উধাও হওয়া কিংবা একটি হাসপাতাল অব্যবহৃত রেখে নতুন একটি হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত দুঃখজনক হতে পারে কিন্তু আশ্চর্যজনক নয় একদমই। সরকারের উন্নয়ন বলেন কিংবা দুর্নীতি, সবকিছুই অবকাঠামো নির্ভর। অবকাঠামো তৈরি মানেই লুটপাটের আয়োজন করা যায়,অবকাঠামো তৈরি মানেই সেটা থেকে ভীষণভাবে ফুলেফেঁপে উঠতে পারে কিছু ক্ষমতাবান লোকজন। এই কারণেই দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ে প্রকল্পের, বাড়ে খরচ, প্রকল্প আর শেষ হয় না সহজে।  

অবকাঠামো বানিয়ে লুটপাটের আয়োজন করার যে চর্চা বাংলাদেশ দেখছে গত এক যুগে, সেটা কি করোনায় কিছুটা কমার প্রত্যাশা করেছিলাম আমরা কেউ? আমরা কেউ কি ভেবেছিলাম এই ভয়ংকর সংকটে আপামর মানুষকে চিকিৎসা আর বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম রসদ জোগাবে সরকার? যারা তেমন প্রত্যাশা করেছিলাম তারা নিঃসন্দেহে অপরিণত!

এই যে ৭ দিন ‘কঠোর লকডাউন’ হচ্ছে তাতে সোয়া কোটি পরিবারের জন্য ৫৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরিবার প্রতি পাঁচজন ধরলে একজন মানুষের মাথাপিছু প্রতিদিন বরাদ্দ ১৩ টাকা। এরমধ্যে আবার অর্ধেকই যাবে না সঠিক মানুষটির কাছে, যাবে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত সামর্থ্যবান মানুষের কাছে। এটা আমার কথা নয়, সরকারি পরিসংখ্যান‌ই বলছে। সবচেয়ে বড় কথা তথাকথিত লকডাউন শুরু হয়ে গেলেও এই টাকা বিতরণ শুরু হয়নি এখনো।

অথচ কয়দিন আগেও অন্তত চারগুণ বাজেট বাড়িয়ে ভাঙা- পায়রা রেলপথ তৈরির প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকায়, যা প্রাথমিক প্রাক্কলনের চারগুণ। কিছুদিন আগেই কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ের ঢাকার পাতাল রেল প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। যখন সরকার এসব ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প নিয়ে অতি উৎসাহে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি নিশ্চিতভাবেই জানি এই দেশের, এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় অনেক করোনার রোগী অপেক্ষা করছে শুধু একটা বেড পাবার আশায়। স্রেফ একটা সাধারণ বেড আর অক্সিজেন চায় শুধু তারা এখন। আইসিইউ আর চায় না তারা, তারা জানে এই দেশে সেটা পাওয়া এখন তাদের কাছে স্বর্গপ্রাপ্তির মতো ব্যাপার।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ